আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বাঙালী চরিত্র দুই শতাব্দী পূর্বে - ২ (শেষ)

আগের পর্ব - Click This Link বিভিন্ন জেলার বিবরণ------- চার্লস গ্রান্টের প্রতিবেদন রচনার প্রায় দশ বছর পর ১৮০১ সালে তৎকালীণ গভর্ণর জেনারেল লর্ড ওয়েলেসলী বাংলার বিভিন্ন জেলার জজ ও ম্যাজিস্ট্রেটদের কাছে নতুন রাজস্ব ও বিচার ব্যবস্থার ফলাফল জানতে চেয়ে এক প্রশ্নাবলি প্রেরণ করেন। প্রশ্নাবলির একটি অংশে প্রত্যেক জেলার অধিবাসীদের নৈতিক চরিত্র ও স্থানীয় অপরাধ সম্বন্ধে তাঁদের অভিজ্ঞতা জানতে চাওয়া হয়েছিলো। তাঁরা যে জবাব পাঠিয়েছিলেন সেগুলো গ্রান্টের মতামতই সমর্থন করে। তাঁদের মতে বাঙালীরা কপট, অকৃতজ্ঞ ও মিথ্যাচারী। নৈতিক অধপতনও অত্যন্ত প্রকট।

চুরি, ডাকাতি ও নরহত্যা সব জেলাতেই অত্যন্ত ব্যাপক। সাধারণ মানুষ অসহায়, নির্বিকার। এই অবস্থার উন্নতিবিধানে তাঁরা যেসব সুপারিশ করেছিলেন সেগুলো অত্যন্ত মূল্যবান। যেমন মুর্শিদাবাদের আপীল ও সার্কিট আদালতের বিচারপতিদ্বয় টি. প্যাটেল এবং আর. রোশ বলেছিলেন, একমাত্র শিক্ষার দ্বারাই এ জাতির নৈতিক চরিত্রের উন্নতি সম্ভব। অপরদিকে নদীয়ার জজ ও ম্যাজিস্ট্রেট সি. ওল্ডফিল্ড পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছিলেন, মদের ওপর চড়া হারে শুল্ক বসিয়ে পানদোষ বন্ধ করা সম্ভব নয়।

এখানে কয়েকটি প্রধান প্রধান জেলার বিবরণ সংক্ষেপে উল্লেখ করা হলো। প্রসঙ্গত তৎকালীন বাংলার প্রশাসনিক বিভাগ সম্বন্ধে একটা কথা বলা দরকার। না হলে বুঝতে অসুবিধা হতে পারে। তখন কলকাতা বিভাগের অধীনে ছিলো যশোহর, বীরভূম, হুগলি, নদীয়া, বর্ধমান ও ২৪ পরগনা জেলা। ঢাকা বিভাগের অধীনে ছিলো বাখরগঞ্জ, ত্রিপুরা, সিলেট, ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম ও ঢাকা-জামালপুর জেলা।

মুর্শিদাবাদ বিভাগের অধীনে ছিলো রাজশাহী, ভাগলপুর, পূর্ণিয়া, মুর্শিদাবাদ ও রংপুর। প্রত্যেক জেলায় সাধারণত জজ ও ম্যাজিস্ট্রেট পদে একজন করে ইংরেজ অফিসার থাকতেন। নিম্নের বিবরণগুলো তাঁদের রচনা তবে স্বতন্ত্রভাবে কারও নাম বা পদ উল্লেখ করা হলো না। শুধু জেলার নামের পাশে বন্ধনীতে তাঁদের প্রেরিত চিঠির তারিখ নির্দেশ করা হলো। মেদিনীপুর (৩০ জানুয়ারি ১৮০২) এখানে শঠতা, জালিয়াতি, আদালতে ঘুষ দেয়া ও মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়া খুবই সাধারণ ব্যাপার।

আমলাদের মধ্যে ষড়যন্ত্র ও দুর্নীতি এতো বেশি যে সুবিচার কখনই হয় না। চুরি ও ডাকাতি ছাড়া অন্যান্য অত্যাচার, নৃশংসতা অনেক হ্রাস পেয়েছে। নারী, ভৃত্য ও ক্রীতদাসদের ওপর অত্যাচার প্রায় বন্ধ হয়েছে। যে ব্যবস্থায় মুসলিম আইন প্রয়োগের প্রতিশ্রুতি দেয়া হলেও প্রকৃত আপরাধী শাস্তি পায় না (তখন মুসলিম আইন অনুসারে ফৌজদারী বিচার হতো) সেখানে মদ্যপান, বেশ্যাবৃত্তি, অশালীনতা ও ভ্রষ্টাচার বৃদ্ধি পাবে এটা খুব স্বাভাবিক। অবশ্য এই জেলায় এই সব অপরাধ ভয়ঙ্কররূপে প্রকাশ পায়নি।

মেদিনীপুর জেলায় বড় কোন শহর নেই। এই প্রসঙ্গে আমি নিজস্ব একটা অভিমত ব্যক্ত করতে চাই। তা হলো, কোন বিচারালয়ে নৈতিকতা শিক্ষার সুযোগ নেই। আমার একথা বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ আছে। কলকাতায় ইংরাজ আইন ও কড়া পুলিশী ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও সেখানকার লোকদের নৈতিক চরিত্র সবচেয়ে খারাপ।

শহরের বিরাট আয়তন, বিপুল লোকসংখ্যা ও অসংহত সমাজ এর কারণ বলে মনে করিনা। সুপ্রীম কোর্ট এর জন্য অংশতো দায়ী। সুপ্রীম কোর্টের সাথে যুক্ত এমন একজন নেটিভকেও জানিনা যার আচরণ ও নৈতিকতা তার সংস্পর্শে কলুষিত হয়নি। এই ত্রুটি নির্দেশ করবার সময় আমি কোন ব্যক্তি বিশেষকে দোয়ারোপ করছি না বা বিচার ব্যবস্থার প্রতি অসম্মান করছি না। মেদিনীপুরের বেশিরভাগ অধিবাসীর চরিত্রে সরলতা ও নমনীয়তা বর্তমান।

এরা হিন্দুদের বৈশিষ্ট্য রক্ষা করে চলেছে। পার্শ্ববর্তী জেলাগুলোর তুলনায় এরা অনেক কম কলহপরায়ণ এবং কম ঝামেলা সৃষ্টি করে। তবে একটু মামলাবাজ। আমার মনে হয় কাচারিতে কি কারবার চলে এবং সেখানে দুর্নীতি যে কতোটা ব্যাপক তা জানবার সুযোগ এদের ঘটেনি। যশোর (৭ ডিসেম্বর ১৮০১) নিম্ন শ্রেণীর অধিবাসীদের নৈতিক চরিত্রের উন্নতি হয়েছে বলে আমি মনে করিনা।

নরহত্যা, গৃহদাহ ও ডাকাতি খুব ব্যাপক। পুলিশ সংগঠন ত্রুটিপূর্ণ হওয়ায় অপরাধ প্রমান করা কঠিন; জমিদারদের কর্মচারীদের সাথে চোর-ডাকাতদের যোগ-সাজস থাকায় এবং সাক্ষ্য দিলে সাক্ষীর খুন হবার আশঙ্কা থাকায় লোকে সাক্ষ্য দিতে ভয় পায়। কাজেই কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা না করলে এইসব অপরাধ দমন করা সম্ভব নয়। নরহত্যা, গৃহদাহ ও অন্যান্য নৃশংসতার অপরাধে দণ্ডিত ব্যক্তিদের ও তাদের সাহায্যকারীদের মৃত্যুদণ্ডের বিধান থাকা উচিৎ। আমি আরও মনে করি, জঘন্য অপরাধে দণ্ডিত ব্যক্তিদের সদাচরণের মুচলেকা না দিলে তাদের আর সমাজে ফিরতে দেয়া উচিৎ নয়।

বীরভূম (২৫ মার্চ ১৮০২) এই জেলার অধিবাসীদের নৈতিক চরিত্র সম্বন্ধে আমার ধারণা খুব খারাপ। আমি মনে করি বৃটিশ সরকার যে কোমল শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তন করেছেন তা এদের দু:শীল চরিত্রে উপযুক্ত প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। একমাত্র ভয়ই এদের দু:স্বভাব দমনে রাখতে পারে। বর্তমানে বিভিন্ন অপরাধের জন্য যে শাস্তির ব্যবস্থা আছে তার প্রতি এদের ভয় খুব কম। নদীয়া (৬ জানুয়ারি ১৮০২) অত্যন্ত দু:খের সাথে বলতে হচ্ছে যে, এই জেলার অধিবাসীদের নৈতিক চরিত্র আমার মতে মোটেই ভালো নয়।

সরকার যে শাসনব্যবস্থা চালু করেছেন তার ফলে এদের নৈতিক চরিত্রের কোন উন্নতি তো ঘটেইনি, বরং অবনতি ঘটেছে। বর্তমান ব্যবস্থা এদের পক্ষে খুবই কোমল; কারণ, ছোটবেলা থেকে এরা নিছক প্রবৃত্তির তাড়নায় চালিত হয়, আর এদের শিক্ষাও সম্পূর্ণ উপেক্ষিত। ডাকাতি ও নরহত্যা এ-অঞ্চলের প্রধান অপরাধ। এর কারণ প্রধানত: গ্রামের গোমস্তা বা প্রধানেরা দুবৃত্তদের শাস্তি দেয়ার ব্যাপারে কোনরকম সহযোগিতা করে না। তাছাড়া অভিযোগ দায়ের করলে ফরিয়াদীর সপরিবারে প্রাণনাশের আশঙ্কা থাকে (অন্তত হিন্দুদের পক্ষেতো বটেই); আবার হলফনামা পাঠ করে মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়ারও ভয় আছে।

এদের চরিত্র এমন কাপুরুষোচিত যে, কোনো ব্যক্তি বা গ্রামের ওপরে ডাকাতেরা সদলে আক্রমন করলে গ্রামবাসী পরষ্পরকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসে না; বরং খবর পেলে সঙ্গে সঙ্গে কাছেভিতে জঙ্গলে বা অন্য কোথাও গিয়ে লুকিয়ে থাকে। চৌকিদার ও পাহারাদার হিশেবে যাদের নিয়োগ করা হয় তারাও অত্যন্ত দুর্বৃত্ত। পুলিশ অফিসারের ওপর এতো বিস্তৃত এলাকার ভার থাকে যে তার পক্ষে সকল অধিবাসীর নিরাপত্তা বিধান করা সম্ভব নয়। দেশী মদের ওপর শুল্ক বৃদ্ধি করায় মদ্যপান মোটেই কমেনি। শুল্ক দ্বিগুণ বৃদ্ধি করলেও ফল হবে বলে আমি মনে করিনা।

নেটিভরা যে মদ খায় তা এতো সহজে ও অল্প খরচে তৈরি করা যায় যে যারা নেশাখোর তাদের পক্ষে উপযুক্ত পরিমানে পাণীয় সংগ্রহ করা মোটেই কঠিন নয়। শুল্কের হার যদি এমন অসম্ভব পরিমানে বৃদ্ধি করা হয় যে, লাইসেন্সপ্রাপ্ত দোকান থেকে মদ ক্রয় করা নিম্ন শ্রেণীর লোকের পক্ষে দু:সাধ্য হয়ে দাঁড়ায় তাহলে তারা সরকারী আইন ফাঁকি দিয়ে বনেজঙ্গলে গিয়ে চোলাই তৈরি করবে। বর্ধমান (৯ মার্চ ১৮০২) এই জেলায় ডাকাতি খুব বেশি। ডাকাতি এক শ্রেণীর লোকের বংশগত বৃত্তি বিশেষ, যেমন নিম্ন শ্রেণীর হিন্দুরা অন্যান্য বৃত্তি অবলম্বন করে থাকে। এরা ধনসম্পত্তি লুঠ করবার জন্য বড়- বড় দল বাঁধে।

আর এরা জানে যে এদের ধরে শাস্তি দেওয়া খুবই কঠিন। তাই ডাকাতি করাই বেশি পছন্দ করে। ২৪ পরগনা (১ জুলাই ১৮০২) এ অঞ্চলের অধিবাসীদের সম্বন্ধে অনুকূল মত প্রকাশ করতে পারছি না বলে দু:খিত। নিম্ন শ্রেণীর লোকেরা সাধারণত ইন্দ্রিয়পরায়ণ ও দুরাচারী। উচ্চ শ্রেণীর লোকেরাও নৈতিক কর্তব্য পালন করে না।

সকলেই অত্যন্ত মামলাবাজ। মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়া সকল শ্রেণীর মধ্যে ব্যাপকভাবে প্রচলিত। হিন্দু ধর্মে যে নীতি ও সদাচার শিক্ষা দেয়া হয়, সেগুলো সম্পূর্ণ উপেক্ষা করাই নেটিভদের চারিত্রিক অধ:পতনের জন্য অনেকাংশে দায়ী। মুসলিম সরকারের আমলে হয় এগুলোকে নেহাৎ অর্থোপার্জনের উপায় হিশেবে ব্যবহার করা হয়েছে, আর না হয় সম্পূর্ণ উপেক্ষা করা হয়েছে। এখন শুধু ধর্মের বহিরঙ্গ আচরণ করতে দেখা যায়।

আগে মদ্যপান, ইন্দ্রিয়পরায়ণতা ও অন্যান্য অপরাধ দমনের জন্য কঠোর ব্যবস্থা ও শাস্তির বিধান ছিলো। এখন সকল শ্রেণীর লোকই অবাধে এই সব অসদাচরণ করে চলেছে। ঢাকা শহর (৯ ডিসেম্বর ১৮০১) বাংলার অধিবাসীদের মনের অত্যধিক দুর্বলতাহীন বৃত্তিগুলো দমনে সাহায্য করে না, বরং উদ্দীপ্ত করে তোলে এবং এগুলোকে প্রশ্রয়দানের ফলে নীতিবোধ প্রায় লোপ পেয়ে যায়। তবে স্বীকার করতে বাধা নেই যে, ঢাকার লোকেরা কর্তৃপক্ষের কাছে বাধ্য থাকে। এই শহরে মারাত্মক অপরাধ তেমন নেই।

যাদের টাকা-পয়সা খরচ করবার মতো ক্ষমতা আছে তারা সাধারণত ইন্দ্রিয়পরায়ণ। এই অধ:পতন সাম্প্রতিক কালের। ঢাকা-জামালপুর (২৮ জুলাই,১৮০২) ফৌজদারী মামলার ফাইলপত্র ঘেঁটে মনে হয় যে, এই জেলার প্রধান অপরাধগুলো হলো ডাকাতি, নরহত্যা, চুরি, মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়া, আর জমিদারদের প্রধান অপরাধ হলো জোর করে অন্যের সম্পত্তি দখল করা। এদিকে পেশাদার গোয়েন্দারা ডাকাতিতে উস্কানি দেয়, ডাকাতদের আগলে রাখে এবং তার বদলে ডাকাতি করা ধনে ভাগ বসায়। স্থানীয় অধিবাসীদের ভীরু স্বভাবই ডাকাতির সুযোগ করে দেয়।

বাল্যকালে নীতি শিক্ষার কোন ব্যবস্থা নেই; ইন্দ্রিয় সংযমের শিক্ষাও দেয়া হয় না। এটাই অপরাধ প্রবণতার কারণ বলে মনে করি। এর আগে এক পত্রে (৩০ আগস্ট ১৭৯৯) জেলার জজ ও ম্যাজিস্ট্রেট লিখেছিলেন,’’এদের মন অসংস্কৃত। নৈতিক কর্তব্য সম্পর্কে এদের কোন ধারণা নেই। সাধারণ লোকে যে রকম ছলচাতুরি করে চলে তাতে এদের হৃদয়ের দৈন্যই প্রকাশ পায়।

এরা অলস ও ইন্দ্রিয়পরায়ণ; নৃশংস অথচ কাপুরুষ; উদ্ধত আবার হীনমন্য। এরা ধর্মবোধহীন কুসংস্কারাচ্ছন্ন। বর্বর জীবনের সব দোষই এদের আছে, কিন্তু তার কোন গুণ এদের নেই। একটু উপরের মহলে দৃকপাত করলে সেই একই নীতিহীনতা লক্ষ্য করা যায়। তবে তার রূপ কিছুটা পরিমার্জিত।

আত্ম-স্বার্থ ছাড়া আত্মিক যোগ বলে এদের কিছ নেই। ’’ হিন্দুদের এই অধ:পতনের কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেছেন,’’মুসলমানেরা বিজিত হিন্দুদের কাফের বলে গণ্য করেছে এবং তাদের ওপর নিরন্তর অত্যাচার ও নিপীড়ন চালিয়েছে। তারা মনে করতো হিন্দুদের অপমান বা আঘাত করলে আল্লা খুশী হন। ধ্বংসাত্মক অন্ধবিশ্বাসে চালিত হয়ে তারা হিন্দুদের গ্রন্থ ও শিক্ষার ওপর আঘাত হেনেছে। ব্রাক্ষ্মণেরা ক্রমাগত অত্যাচারে বিব্রত হয়ে নিজেদের ক্রিয়াকর্ম ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছে।

নতুন বংশধরদের সুপথে চালিত করার কেউ ছিলো না। তাই তারা বিজেতাদের আচার আচরণই অতিরিক্ত মাত্রায় অনুসরণ করেছে। ক্রমে স্বেচ্ছাচারী হয়ে ওঠায় নৈতিকতাবোধ লোপ পায়। এইভাবে কালক্রমে দেশবাসীর মনের সম্পূর্ণ বিবর্তন ঘটে যায়। পাঠান শাসনে সেই অবস্থায় কয়েক শতাব্দী অতিবাহিত হয়।

সুপ্রাচীন নিয়ম-শৃঙ্খলা ভেঙে পড়ায় তাদের ক্রমাবণতি ঘটতে থাকে এবং বিজেতাদের ঘৃণা ও অবজ্ঞার পাত্র হয়ে ওঠে। নিম্ন শ্রেণীর অনেকেই ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। নতুন ধর্ম যে তাদের পূর্বতন ধর্মের চেয়ে অধিক যুক্তিবাদী এই বিশ্বাস থেকে তারা ধর্মান্তর গ্রহণ করেনি। শাসকদের অত্যাচারের হাত থেকে রক্ষা পাবে বলেই তারা নতুন ধর্মের আশ্রয় নিয়েছে। কিন্তু এর ফলে তাদের মানসিক উন্নতি ঘটেনি।

শাসকদের নির্মম স্বেচ্ছাচারিতার কাছে তারা পদানতই থেকে গিয়েছে। যে ভাষায় তাদের ধর্মকথা লিখিত সে ভাষায় তাদের কোন জ্ঞান ছিলো না। কাজেই ধর্মাচরণ কয়েকটি বাহ্যিক অনুষ্ঠানের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতো। মোগল আমলে সম্রাটের পারসিক প্রতিনিধিরা ছিলো শিয়া। তারা সুন্নী আইনের খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামাতো না।

তাদের বিচার ছিলো সংক্ষিপ্ত; শাস্তি ছিলো নির্মম, খেয়ালখুশিমতো। তারা বিশ্বাস করতো ত্রাসের সৃষ্টি করে অপরাধ দমন করা যায়, প্রতিরোধ করা যায়। কিন্তু যে ব্যবস্থায় এই ত্রাস সৃষ্টির প্রয়োজন হয় না তা তারা উপেক্ষা করতো। ’’ বাখরগঞ্জ (৭ জানুয়ারি ১৮০২) এই জেলার অধিবাসীদের নৈতিক চরিত্র অতি জঘন্য। এর ব্যতিক্রম খুব কম।

এমন কোনো জুয়াচুরি বা দুষ্কর্ম নেই যা উচ্চশ্রেণীর মধ্যে দেখা যায় না। আর নিম্নশ্রেণীর ক্ষেত্রে এর সাথে যোগ দিতে হবে ডাকাতি, নরহত্যা ইত্যাদি। এমন কি যদি বলি যে এ জেলার প্রত্যেকটি লোক ডাকাত তাহলেও খুব বেশি বাড়িয়ে বলা হবে না। কারণ, নিম্ন শ্রেণীর মধ্যে খুব কম লোকই কোন ব্যবসা, বৃত্তি বা কৃষিকার্যে নিযুক্ত থেকে জীবিকা অর্জন করে। চুরি, ডাকাতিই এদের বাঁচার প্রধান পথ।

সব জমিদার ও তালুকদার (অল্প কিছু সংখ্যক বাদে) গোপনে ডাকাতদল পোষণ ও রক্ষা করে। জমি বা জমির সীমানা নিয়ে কোনো বিরোধ বাধলে ঐ চোর ডাকাতেরাই হয় তার প্রধান নায়ক। সরকার যে ব্যবস্থা প্রবর্তন করেছেন তার ফলে এদের নৈতিক চরিত্রের বিশেষ কোনো উন্নতি ঘটেনি। ভীতিই এই অঞ্চলের নেটিভদের ক্ষেত্রে একমাত্র কার্যকর অস্ত্র। শাস্তির ভয় এদের অপরাধ প্রবৃত্তিকে সংযত করতে পারে।

কোনো রকম নীতি শিক্ষা বা আদর্শ এদের কখনোই সৎ পথে চালিত করতে পারবে না। প্রকৃত ন্যায় বিচার ও কঠোর দণ্ডই তাদেরকে ঠিক রাখতে পারে। ডাকাতি ও নরহত্যা এই জেলার প্রধান অপরাধ। অনেক ক্ষেত্রে ডাকাতরা মশাল জ্বালিয়ে এসে ঘরদোরে অগ্নিসংযোগ করে। কখনো বা গোপন ধনের খবর আদায় করবার জন্য বাড়ির কর্তার বুকের ওপর একটা আর পিঠের নীচে আরেকটা বাঁশ বেঁধে ক্রমাগত চাপ দিতে থাকে।

চাপে নি:শ্বাস বন্ধ হয়ে আসে, অনেক সময় পাঁজরার হাঁড় ভেঙে যায়। আবার কখনো চোখেমুখে লঙ্কার গুঁড়ো ছিটিয়ে দেয়। এ জেলার সাধারণ লোক, বিশেষ করে নিম্ন শ্রেণীর লোক—নারী ও পুরুষ উভয়ই অত্যন্ত কামুক। নারীদের অবিশ্বস্ততা ও পুরুষের ঈর্ষা ব্যাপক নরহত্যার প্রধান কারণ। তবে অতি তুচ্ছ কারণে ছেলে-মেয়েদের ঝগড়া নিয়ে বা সামান্য একটা হুঁকো নিয়েও খুনোখুনি হয়ে যেতে পারে।

অনেক সময় কামুকতা আত্মহত্যার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আমি যে সব অঞ্চলে থেকেছি তার মধ্যে এই জেলাতেই আত্মহত্যার ঘটনা সবচেয়ে বেশি। ডাকাতির কারণ দু’টি। প্রথমত ডাকাতেরা নিজেদের একটা স্বতন্ত্র জাতি বা বৃত্তির লোক বলে মনে করে। অনেকে বংশ পরম্পরায় ডাকাতি করে চলেছে।

আমি একটা ঘটনার কথা জানি। প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত জনৈক ডাকাত ফাঁসি-কাষ্ঠে ঝুলবার পূর্ব-মুহূর্তে তার ছেলেকে বলেছিলো, আমার অবস্থা দেখে ভয় পেয়ো না, আমার মতোই ডাকাতি চালিয়ে যেও। দ্বিতীয়ত: এরা ছিঁছকে চুরি দিয়ে শুরু করে। তার পর ক্রমে বড়ো চুরি ও ডাকাতি রপ্ত করে। ত্রিপুরা (২৯ অক্টোবর ১৮০১) এখানকার অধিবাসীদের নৈতিক চরিত্র অতি শোচনীয়।

খুব কম খরচে জীবিকা নির্বাহ করা যায়; সরকারী ব্যবস্থায় এদের স্বাধীনতা ও বিষয়-সম্পত্তির নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়েছে। কিন্তু তার ফলে এদের মন সৎ কর্মের দিকে যায়নি; বরং আরো অলস হয়ে উঠেছে। অন্যের পাওনা ফাঁকি দেয়ার যদি কোনো সুযোগ থাকে অথবা পরিবারের মধ্যে যদি মামলা করার কোনো পথ থাকে তবে এরা যে কতো দূর যেতে পারে তা বিশ্বাস করা কঠিন। নতুন আইন চালু হওয়ার আগে কি জমিদার, কি রায়ত, সকলেই রাজস্ব ফাঁকি দিতো। সরাসরি বিচার প্রবর্তনের ফলে বিস্ময়করভাবে তা বন্ধ হয়েছে।

ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও অনুরূপ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলে সুফল পাওয়া যেতো। এদেরকে সৎপথে আনতে হলে দ্রুত সরাসরি বিচার চালু করতেই হবে। নিম্ন শ্রেণীর মধ্যে যে কর্মবিমুখতা রয়েছে তা দূর করতে হলে মূলে আঘাত করতে হবে। অর্থাৎ মজুরির হার বেঁধে দিতে হবে। অত্যাবশ্যক পণ্যের মূল্যহারের অনুপাতে মজুরির হার নিরূপণ করা দরকার।

বিভিন্ন লোকের সঙ্গে কথাবার্তা বলে আমার এ বিশ্বাস আরো দৃঢ় হয়েছে যে, মজুরির হার বেঁধে দেয়ার জন্যে কোনো না কোনো ব্যবস্থা নিতেই হবে। বর্তমানে জীবিকা নির্বাহের ব্যয় খুব কম এবং সেই অনুপাতে মজুরি বেশি হওয়ায় ব্যবসা-বাণিজ্যের খুব ক্ষতি হচ্ছে। কারণ মজুর নিয়োগ করে কোনো একটা কাজ নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে শেষ হবে বলে কেউ নিশ্চিন্ত হয়ে বসে থাকতে পারে না। বেশ কিছু টাকা রোজগার করবার পর অনেক মজুরই আর কাজ করতে চায় না। যেমন, এক মাস কাজ করলেই সেই টাকায় অনায়াসে তিন মাস বসে খাওয়া চলে।

অনেকে এক মাস কাজ করবার পর দু’মাস বসে থাকে। তাই প্রায়ই দেখা যায়, মাঠে পাকা ধান পচছে বা গোরুতে খেয়ে নষ্ট করছে। অথচ মজুরের অভাবে ধান কেটে আর ঘরে তোলা যাচ্ছে না। আবার খুব বেশি মজুরি দিয়ে লোক লাগালে মোট খরচা ধানের বাজার দর অপেক্ষা অনেক বেশি পড়ে যায়। এই একই কারণে তাঁতবস্ত্র উৎপাদনের পরিমানও হ্রাস পেয়েছে।

যাঁরা বস্ত্রের ব্যবসা করেন তাঁদেরই এই অভিজ্ঞতা। তাঁরা বলেন, আকাল পড়লেই বস্ত্র প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়। মজুরির হার যে এখন খুবই চড়া এটা তারই একটা প্রমাণ। এই হার নিয়ন্ত্রণে ম্যাজিস্ট্রেটের কিছু ক্ষমতা থাকা দরকার। নিম্ন শ্রেণীর মেয়েদের মধ্যে আত্মহত্যা খুব বেশি।

অতি সামান্য কারণে, এমনকি সংসারের কাজে ক্রুটি হলে স্বামী যদি বকাবকি করে তাহলেও অনেকে আত্মহত্যা করে। দারিদ্র্য বা ঈর্ষাজনিত কারণে -- আত্মহত্যা ঘটেছে এমন একটি ঘটনার খবরও পাওয়া যায়নি। ময়মনসিংহ (২০ জানুয়ারি,১৮০২) কিছ সংখ্যক হিন্দু আচার-অনুষ্ঠানে নিষ্ঠাবান। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এই সব লোক দেখানো ব্যাপার বলে মনে হয়। অধিকাংশ জমিদার অপদার্থ।

তাদের ম্যানেজার ও এজেন্টরাও খুব সৎ চরিত্রের লোক নয়। তবে জমিদার ও রায়তদের তারা ছলচাতুরিতে এমন মুগ্ধ করে রাখে যে তাদেরকে মূল্যবান বলে গণ্য করা হয়। তাদের অধস্তন কর্মচারীরা মূর্খ। তবে তারাও নিজেদের ক্ষমতা অনুযায়ী ম্যানেজারদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে চলে। নিজেদের মধ্যে ঝগড়া-বিবাদে তারা অত্যন্ত হিংস্র হয়ে উঠতে পারে; সামান্য কারণেও অনেক সময় খুন-খারাবি হতে দেখা যায়।

রাজশাহী (১০ এপ্রিল,১৮০২) যুবা থেকে বৃদ্ধ প্রায় সকলের মধ্যেই শঠতা ছলচাতুরির প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। এই দোষ সংশোধন করা কঠিন। ডাকাতি, নরহত্যা ও জালিয়াতি অত্যন্ত ব্যাপক। ডাকাতির সময় যাকে সম্মুখে পায় তাকে খুন করাই এখানকার ডাকাতির একটা বৈশিষ্ট্য। বাড়ির কর্তা যতি প্রথমেই পালিয়ে যেতে পারে এবং পরে যদি কোনোমতে ধরা পড়ে তবে ডাকাতেরা তার গায়ে তেল ঢেলে আগুন জ্বালিয়ে দেবে।

উদ্দেশ্য হলো, গোপন ধনের সন্ধান আদায় করা। মুর্শিদাবাদ (১৩ ডিসেম্বর,১৮০১) এই জেলার অধিবাসীদের নৈতিক চরিত্র খুব খারাপ বলে আমি মনে করি। এমন কোনো গুণের নাম করা কঠিন যা এদের চরিত্রে বিদ্যমান; অথচ লোভ, প্রতিহিংসা,মিথ্যাচার,ছলচাতুরি, অকৃতজ্ঞতা বস্তুত এমন কোনো দোষ নেই যা এদের মধ্যে নেই। এরা ভয়ঙ্কর রকমের কুসংস্কারাচ্ছন্ন এবং অত্যন্ত অলস। তবে মোটের ওপর আমার মনে হয়, মুসলমানদের তুলনায় হিন্দুরা ভালো লোক।

সকল রকম অপরাধের মধ্যে ডাকাতি অত্যন্ত ব্যাপক। নরহত্যাও প্রায়ই ঘটে থাকে। রংপুর (১৩ এপ্রিল,১৮০২) আমার মতে এখানকার লোকেরা অধিকাংশই অত্যন্ত অলস, অজ্ঞ ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন; হীনচেতা ও অকৃতজ্ঞ এবং অনেক সময়েই প্রতিহিংসাপরায়ণ, স্বার্থপর, মিথ্যাচারী ও নির্লজ্জ। শিশুকাল থেকেই শেখানো হয় যে, বিষয়-সম্পত্তি সঞ্চয় করাই জীবনের একমাত্র লক্ষ্য। তাছাড়া শঠতা, প্রবঞ্চনা প্রভৃতি পরিবেশের মধ্যে এরা বড় হয়ে ওঠে।

জালিয়াতি ও ফাঁকিবাজিকে এরা খুব বাহবার কাজ বলে মনে করে। যে ক্ষেত্রে লালসা বা প্রতিহিংসা-প্রবৃত্তি অবাধে চরিতার্থ করা যায় সেখানে এই হীন আচরণে এদের ক্লান্তিবোধ নেই। এর ফলে প্রত্যেক গোষ্ঠি, এমন কি প্রত্যেক পরিবারে একে অপরকে বিশ্বাস করতে পারে না। তবে এ কথা স্বীকার করতেই হয় যে, পিতা-মাতার প্রতি এদের সশ্রদ্ধ কর্তব্যবোধ যথেষ্ট। পিতা-মাতা বৃদ্ধ হলে বা অন্য কোনো কারণে নিজেদের ভরণ-পোষণে অশক্ত হলে ছেলেরাই তাদের ভার গ্রহণ করে।

এদের আর একটি বড় গুণ হলো এদের পানদোষ নেই। উচ্চশ্রেণীর লোকেরা কখনো মদ স্পর্শ করে না। আরক খুব সস্তা আর অতি সহজে যে কোন সময় পাওয়া যায়। কাজেই মনে হতে পারে নিম্ন শ্রেণীর মধ্যে পানদোষ ব্যাপক। বাস্তবে কিন্তু এদের মধ্যে মাতলামি খুব কম দেখা যায়।

ধর্মীয় নীতির একটা সুফল এই পরিমিতাচার। বিবরণ কি যথার্থ ? বাঙালী চরিত্রের এই বিবরণ এ যুগের বাঙালীর কাছে এক প্রচণ্ড আঘাত স্বরূপ। তাৎণিক প্রতিক্রিয়ায় একে সাম্রাজ্যবাদী শোষক শ্বেতাঙ্গদের স্থানীয় কালা নেটিভদের প্রতি স্বভাবজাত ঘৃণা ও বিদ্বেষের প্রতিফলন বলে মনে হবে। অবশ্যই প্রশ্ন হতে পারে সব মানুষের মতো বাঙালী চরিত্রেও কিছু দোষ ছিলো ও আছে। কিন্তু ইংরেজরা তৎকালীন বঙ্গের বাঙালীদের চরিত্রে কি কিছুই ভালো দেখতে পাননি ? এটা অস্বাভাবিক ও অসম্ভব।

তাদের এ বিবরণ গ্রহণীয় নয়। কিন্তু বিষয়টি একটু বিশদ বিচার করে দেখা দরকার। প্রথমত, কিছু দায়িত্বশীল কর্মচারী সরকার বা কোম্পানীর কাছে তাদের মতামত ব্যক্ত করেছেন সরকারী চিঠি বা গোপন রিপোর্টে। তাদের প্রধান উদ্দেশ্য ছিলো দেশ শাসনকার্যে বাস্তবসম্মত নীতি নির্ধারণে সরকারকে সাহায্য করা। কাজেই বিবরণ রচনায় নিজস্ব বুদ্ধি, বিচারশক্তি ও অভিজ্ঞতা সম্পূর্ণ প্রয়োগ করা হয়েছিলো।

লক্ষ্যণীয় যে অনেকেই উত্তরদানে দীর্ঘ সময় নিয়েছিলো এবং তাদের মধ্যে কেউ কেউ প্রচুর নথিপত্র ঘেঁটেছিলেন অনেক ক্ষেত্রেই সেকথা স্পষ্ট করে উল্লেখ করা আছে। কালা নেটিভদের প্রতি ইংরেজদের ঘৃণা ও বিদ্বেষ থাকা অস্বাভাবিক কিছু নয়। বৈদিক যুগেও দেখি আর্য ঋষিরা স্থানীয় আদিম অধিবাসী দাসগোষ্ঠীকে ঘৃণাভরে ’কৃষ্ণ-যোনী:’ অর্থাৎ কালা আদমী বলে উল্লেখ করেছেন (ঋগ্বেদ ২/২০-৭)। কিন্তু এ ক্ষেত্রে বৃটিশ সরকারকে সহায়তা করবার উদ্দেশ্যে নিয়ে যখন কলম ধরেছিলেন তখন-ইংরেজ কর্মচারীরা সম্পূর্ণভাবে ঘৃণা ও বিদ্বেষের দ্বারা পরিচালিত হয়েছিলেন এ কথা বিশ্বাস করা সঙ্গত হবে না। দ্বিতীয়ত, এই বিবরণগুলো তখন ছিলো গোপনীয়, সাধারণ্যে প্রকাশিত হবার কোন সম্ভাবনাই ছিলো না।

তাই তাঁরা যা বিশ্বাস করেছেন সে কথাই নির্ভয়ে লিখেছেন। তৃতীয়ত, মিথ্যা রিপোর্ট দিয়ে পরিণামে সরকারের তথা ইংরেজ স্বার্থেরই ক্ষতি হবার সম্ভাবনা এবং তাতে নিজেদেরও বিপদ ডেকে আনা হবে। কাজেই বিদ্বেষবশেই হোক বা অন্য কোনো কারণেই হোক তাঁরা জেনেশুনে ভুল রিপোর্ট পাঠাবেন এ ধারণা যুক্তিগ্রাহ্য নয়। চতুর্থত, সদ্য অধিকৃত দেশ সুষ্ঠু নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রীয়নীতি রচনাকালে প্রজাবৃন্দের চারিত্রিক ত্রুটি-বিচ্যুতি বেশি জানা দরকার। প্রধানত সেই কারণেই হয়তো তাঁরা বাঙালী চরিত্রের ঘাটতির দিকটাই বড় করে দেখিয়েছিলেন।

তবে সৎ গুণাবলীর কথা কেউ কেউ যে উল্লেখ করেননি তা নয়। রামমোহনের অভিমত যে কালে এই চরিত্র-চিত্রণ ঘটে ঠিক তখনই রাজা রামমোহন রায়ের আবির্ভাব। দীর্ঘকাল তাঁর বাংলার গ্রামাঞ্চলে কেটেছে। পল্লী মানুষের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্টতা ছিলো নিবিড়; তাদের প্রতি ছিলো সশ্রদ্ধ ভালোবাসা এবং তাদের মঙ্গলের জন্যই তিনি আজীবন সংগ্রাম করে গিয়েছেন। তাঁর জন্ম রাধানগর গ্রামে।

কর্মজীবনে ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর কর্মচারী হিশেবে বা অন্য কাজে ফরিদপুর ও মুর্শিদাবাদে (১৮০৩-১৮০৫) যশোহরে (১৮০৮) এবং রংপুরে (১৮০৯-১৮১৫) দীর্ঘকাল কাটে। তাছাড়া বিহার, গোয়ালপাড়া, ভূটান ইত্যাদি বহু স্থানে তিনি ছিলেন বা পরিভ্রমন করেছেন। কাজেই পল্লী বাংলা সম্বন্ধে তাঁর অভিজ্ঞতা প্রত্যক্ষ ও বাস্তব। বিস্ময়ের কথা, সাধারণ বাঙালী চরিত্রের অন্তত প্রধান কয়টি দিক সম্বন্ধে রামমোহনের নিজস্ব অভিজ্ঞতা শাসক ইংরেজ কর্মচারীদের অভিজ্ঞতা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন নয়। রামমোহন এ বিষয়ে অবশ্য কোনো স্বতন্ত্র গ্রন্থ বা প্রবন্ধ রচনা করেননি; তার প্রয়োজনও ছিলো না।

তবে চিঠিপত্রে এ বিষয়ে তিনি তাঁর অভিমত সুস্পষ্টভাবে ব্যক্ত করেছেন; এবং একমাত্র ব্যক্তিগত চিঠিপত্রেই নিজস্ব মনোভাব অপ্রিয় হলেও নির্দ্বিধায় প্রকাশ করা চলে। চার্লস গ্রান্ট ১৭৯২ সালে মন্তব্য করেছিলেন যে, বাঙালীদের দেশপ্রেম নেই। রামমোহনও ঠিক একই কথা বলেছেন। ১৮২৮ সালে এক পত্রে তিনি লিখেছিলেন, ’’ জাতিভেদ প্রথা তাদের (হিন্দুদের) মধ্যে অসংখ্য ভাগ-উপভাগের সৃষ্টি করেছে; ফলে তাদের দেশপ্রেমের মনোভাব একেবারে লোপ পেয়েছে। ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের এবং শুদ্ধিকরণের বাহুল্য তাদেরকে যে কোনো কঠিন কর্মে ব্রতী হওয়ার সম্পূর্ণ অনুপযুক্ত করে তুলেছে।

’’ (Rammohun Roy and Modern India-Ramananda Chatterjee,1906) ১৮০১-১৮০২ সালে বিভিন্ন জেলার জজ ও ম্যাজিস্ট্রেটরা তাঁদের রিপোর্টে বলেছিলেন, হিন্দুরা অত্যন্ত অলস ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন। রামমোহনও অনরূপ কথা বলেছেন। জন ডিগবিকে এক পত্রে (১৮১৬ বা ১৮১৭) তিনি লিখেছিলেন, আমি দেখেছি সাধারণ হিন্দুরা পৃথিবীর অন্যান্য জাতির তুলনায় ধর্মাচরণে ও সাংসারিক কাজকর্মে অনেক বেশি কুসংস্কারচ্ছন্ন ও দুর্দশাগ্রস্ত। (English works of Raja Rammohun Roy part IV edited by Dr. Kalidas Nag & Debaiyoti Barman)| । নারীদের প্রতি সাধারণ বাঙালীর আচরণ সম্বন্ধে গ্রান্ট ও রামমোহনের অভিমতের মধ্যে খুব বেশি পার্থক্য নেই।

রামমোহন লিখেছিলেন (১৮২০), ’বিবাহের সময় স্ত্রীকে স্বামীর অর্ধাঙ্গিনী বলে গণ্য করা হয় বটে, কিন্তু পরবর্তীকালে তার প্রতি নিকৃষ্ট পশুরও অধম হিশেবে আচরণ করা হয়। কারণ স্ত্রীলোককে ঘরে ক্রীতদাসের কাজে নিযুক্ত করা হয়ে থাকে। ’ (The Life and Letters of Raja Rammohun Roy, Sophia Dobson Collet,1900). বাংলার এই শোচনীয় অবস্থার কথা আচার্য ব্রজেন্দ্রনাথ শীল দৃঢ়প্রত্যয়ের সঙ্গেই বলেছেন, ’ যে কালে রাজা জন্মগ্রহণ করেছিলেন ও বড় হয়ে উঠেছিলেন তাহলো আধুনিক ভারত ইতিহাসের সবচেয়ে অন্ধকারময় যুগ। প্রাচীন সমাজ ভেঙে পড়েছে, তার স্থানে নতুন সমাজ গড়ে ওঠেনি। দেশের সর্বত্র বিরাজ করছে ধ্বংস।

সমাজের প্রতিটি অঙ্গ বিকল। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও শিালয়; পল্লী ও গৃহ; কৃষি শিল্প ও বাণিজ্য; আইন ও প্রশাসনে চলছে অরাজক অবস্থা (বাঙ্গালোরে রামমোহনের মৃত্যুবার্ষিকী সভায় ভাষণ, ১৯২৪)। ইতিহাসবিদ ড. রমেশচন্দ্র মজুমদারও রামমোহনের আবির্ভাব কালকে চিহ্ণিত করেছেন এইভাবে- মনে হয় তখন হিন্দুদের অন্তত অধিকাংশ হিন্দুর, নৈতিক বোধশক্তি পঙ্গু হয়ে পড়েছিলো এবং মানবিকতাবোধ লোপ পেয়েছিলো। ( Glimpses of Bengal in Nineteenth Century- R.C.Majumdar,1960). . ইংরেজ কর্মচারীদের রিপোর্ট ও রামমোহনের সংপ্তি অথচ কঠোর মন্তব্য থেকে তৎকালীন বাঙালী সমাজ ও চরিত্রের এক অতি করুণ চিত্র ফুটে ওঠে। এই সংকীর্ণ স্বার্থপর ও অন্ধকার-সমাচ্ছন্ন সমাজে জন্মগ্রহণ করে কি করে তার মতো মহৎপ্রাণের উদ্ভব সম্ভব হয়েছিলো তা যথার্থই বিস্ময়ের।

পাপভাবপীড়িত পৃথিবীতে ত্রাণকর্তার আবির্ভাবের মতোই তাঁর অভ্যুদয়। তাঁর আত্মিক শক্তি যে কতো প্রবল, প্রতিভা যে কতো ব্যাপক এবং মানবতাবোধ যে কতো গভীর তা পরিমাপ করা দু:সাধ্য; সমাজ চরিত্রের প্রোপট দৃষ্টে কিছুটা অনুমান করতে পারি মাত্র। ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.