আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আমার কিশোরীবেলা পর্ব ২ : আঁধারে বসবাসকারী আমি

মনে রবে দীর্ঘশ্বাসে, আর ১মিনিট নীরবতায়....! আমি বরাবরই ফাঁকিবাজ একটা মেয়ে ছিলাম। আমার মত মেয়ে ক্লাসে একটাও ছিলোনা, টিচারদের ঘোর সন্দেহ ছিলো আমি ভুল করে মেয়ে হয়ে জন্মে গেছি মনে হয়। ক্লাসে কোন এক অজানা কারণে আমাকে সবাই পছন্দ করতো, সম্পর্ক আমার সবার সাথে ভালো তবুও আমার কোন বন্ধু ছিলোনা। আমাকে পছন্দ করার একটা নমুনা বলি, এসিস্ট্যান্ট হেডটিচারের কাজ ছিল প্রতিটা ক্লাসে চক্কর মারা। প্রায়ই সে যখন আমাদের ক্লাসে আসতো এসেই ডাক, 'দূর্বা কই? একটা গান শুনিয়ে যা'।

আমি ছিলাম মহা বদ আমিও স্যারকে আমার এই কাক-কণ্ঠী গলায় রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনিয়ে দিতাম। দিনে দিনে আমার স্টক কমতে লাগলো কিন্তু তবুও গাইতাম কারণ আমি জানতাম এই ভীষণ রাগী আর তেজী স্যারটা মন খারাপ হলেই আসতেন। একজনের মন ভালো করার জন্য রবীন্দ্রসঙ্গীতকে কাক কণ্ঠে অপমান করতে আমার খারাপ লাগতো না। আমি সবচে ঝাড়ি খেতাম হোম ইকনোমিক্স ম্যাডামের কাছে, আমাকে সবসময় বলতো দূর্বা একটু মেয়েসুলভ আচরণ করো। আমি প্রতিবার চুল একদম ছোট ছোট করে যেতাম ক্লাসে আর ম্যাডাম ক্লাসে সবার সামনে দাড় করিয়ে বলতো, আল্লাহ্ এই মেয়েটাকে কত সুন্দর চুল দিয়েছে আর এই মেয়ে সেগুলো ছেলেদের মত কেটে রাখে।

দূর্বা যতদিন না চুল বড় করবে ততদিন দূর্বাকে আমি প্র্যাক্টিক্যালে মার্কস দিবোনা। সে ঠিক তাই করেছিল ৩টা সেকশনের মাঝে আমিই একমাত্র মেয়ে যে কিনা সবচে ভাল প্র্যাক্টিক্যাল দিয়েও ৩০ এর মাঝে ১০ পেতাম। সমস্যাটা হয়ে গিয়েছিল যখন আমাদের বাসা মগবাজার থেকে যাত্রাবাড়ীতে শিফ্ট করে। আমি ঘর থেকে বের হতাম না ক্লাসের সময়টুকু বাদে বাসায় কাটাতাম। ২টা বুকসেল্ফ আর তাক ভর্তি বইগুলো আমার সবচে কাছের বন্ধু ছিলো।

সারাক্ষণ বই পড়তাম, আমার শৈশবেও অজস্র খেলনার বদলে আমি বই পেয়েছি এতে কিছু ভয়ঙ্কর সমস্যা দেখা দিলো, বাইরের বই পড়তে পড়তে আমি এত বেশি অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম যে পাঠ্য বই আমার ভালো লাগতো না। সেটা খুব স্বাভাবিক ছিল যখন আমি আরজ আলী মাতব্বরের রচনাসমগ্র পড়ছি তখন ক্লাস সেভেনের পাঠ্যবই আমার ছোটবেলায় পড়া বই মনে হত। দিন দিন আমি খুব বেশি একাকী হয়ে পড়লাম, আমার ক্লাসমেটদের সাথে মানসিকতা মিলতো না আমার, ওর আমাকে বুঝতো না ওদের কাছে আমি এক অদ্ভুত মেয়ে ছিলাম। আমার তখন একটাই বন্ধু লায়লা যে কি না আমার উল্টো পৃথিবীর। আমি অনেক বেশি বইয়ের প্রতি নির্ভরশীল হয়ে পড়লাম।

বাসায় কোন নিয়ম জারি করা ছিলোনা যে এটা বড়দের বই পড়া যাবে না, সব গোগ্রাসে গিলতে লাগলাম আমি। জীবনে এই একটা কাজে আমি কখনো ক্লান্ত হইনি.... ঠিক তখন ক্লাস সেভেনের শেষ দিকে আমি ভয়ানক অসুস্থ হয়ে পড়লাম। ক্লাস থেকে ফিরতাম ১২টায় এবং ঠিক দুপুরের দিকে আমার হুড়মুড় করে জ্বর এসে পড়তো। বাবা- মা দুজনেই ব্যস্ত চাকরি বাকরি নিয়ে, বোন ভার্সিটি নিয়ে বাসায় থাকতাম আমি একা। আমার মনে হয় ঠিক ঐ সময় আমি বুঝতে পেরেছি মানুষ কেনো অসহায়বোধ করে।

আমি জ্বরে ছটফট করতাম, খুব চাইতাম আমার পাশে কেউ বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিক। অথচ হাত বুলানো দূরের কথা মাথায় পানি ঢালার মত কেউ থাকতো না। অসুস্থ শরীরে একা থাকার মত কষ্টকর মনে হয় আর কিছুই নেই... আম্মু খেয়াল করলো, ডক্টরের কাছে নিয়ে গেলো। তারপরের ঘটনা আর কি, অসুখ...ছিল কিছু একটা হয়তো! ক্লাস এইটে উঠলাম ২০০৭ এর গল্প। আমি দিন দিন বদলে যাচ্ছিলাম, ফ্যামিলি প্রব্লেম, নিজেকে নিয়ে আমার মধ্যে প্রচণ্ড চাপা অভিমান কাজ করতো।

আমি পড়াশোনা প্রায় বলতে গেলে করতামই না। সেই গল্পের বই নইলে ছবি আঁকা। আমি টিভি পছন্দ করতাম না একদম তাই ক্লাস, বইপড়া, ছবি আঁকা ছাড়া আমার কোন কাজ ছিলো না। হুট করে আমার সবচে কাছের, আমার বোন ব্রিটিশ রেডক্রসে একটা চাকরিপেয়ে চলে গেলো কুয়াকাটায়, যেখানে ওদের প্রজেক্ট চলছিল। আমি তখন আরো একা হয়ে পড়লাম...আস্তে আস্তে ইন্টারনেটের প্রতি ঝুঁকে পড়া।

ফার্স্ট ফেবুতে একাউন্ট ২০০৭ এ খুলেছিলাম যেটা হ্যাক হয়ে গেছে। যাইহোক ক্লাস এইটের মাঝামাঝি সময়ে ইন্টারনেটে পরিচয় হলো আরমানের সাথে। আরমান সিলেটে থাকে তখন সবেমাত্র SSC দিয়েছে, সেই আরমান আমার ফার্স্ট ভার্চুয়াল ফ্রেণ্ড। বন্ধুত্বের শুরু ৩০আগস্ট ২০০৭। আমি তখন একটু একটু মেটাল গান শোনাশুরু করেছি, আমার প্রথম মেটাল ব্যাণ্ড ছিল জুডাসপ্রিস্ট।

ধীরেধীরে আমি মারাত্মক রকম মেটালফ্রিক হয় পড়লাম। ঐ সময়টায় আমি চূড়ান্ত হতাশার পর্যায়ে চলে গিয়েছিলাম। ক্লাস এইটে পড়া টিনেজ মেয়ের পক্ষে এটা অস্বাভাবিক ছিলো, কিন্তু আমি জানতাম আমি কি করছি। নিজের প্রতি প্রচণ্ড ঘৃণা নিয়ে বেঁচে থাকা, মেটাল গানের গভীর থেকে গভীরে যাওয়া। ডেথ মেটাল ব্যাণ্ডের ডেথ গ্রাউল ভয়েস, ডিসর্টটেড গিটার ওয়ার্ক, ব্লাস্ট বিট ড্রামিং সবকিছু নিয়ে আমি একটা ঘোরে চলে গিয়েছিলাম।

অতি ভয়ংকরভাবে আমি ব্ল্যাক মেটাল শোনার শুরু হয়, আমার মাঝে আত্মহত্যা করার প্রবণতা বেড়ে যায় ঐ সময়টায়। বসে বসে প্ল্যান করতাম আমি কি করে মরা যায়। পড়াশোনা একদম ছেড়ে দিয়েছিলাম আমি, অবজেক্টিভের কারণে রেজাল্ট ভালো এসে পড়তো। আমার ফ্যামিলির একটা মানুষ ও টের পায়নি যে আমি এমন হয়ে গেছি। আয়না দেখলে রাগ হতো, মূলত নিজেকে আমি সহ্যই করতে পারতাম না।

বিশ্বাস অবিশ্বাস দূরে ফেলে রেখে আমার মাথায় ঢুকলো ব্ল্যাক ম্যাজিক করবো, তারপর কেনো জানি করা হয়নি তবে আমি রক্ত ভালোবেসে ফেলেছিলাম। নিজের হাত বিশ্রীভাবে ধারালো ব্লেড দিয়ে কাটাকাটি করতাম। ব্লেড দিয়ে পায়ের নখ উঠিয়ে ফেলতাম একেবারে, ক্লাসে যখন কেডস পড়ে যেতাম তখন নখ উঠিয়ে ফেলা অংশটুকুর যন্ত্রণা আমি আজো মনে করতে পারি। একসময় দুই আলনা ভর্তি আমার প্রিয় কাচের চুড়ি সেগুলো হাতের তালুতে নিয়ে চাপ দিয়ে ভাঙতাম। কাঁচগুলো ভেঙে হাতের তালুতে ঢুকে যেতো, রক্ত পড়তো আর আমি দেখতাম.... কাঁচের চুড়ি ভেঙে হাতে ঢুকে যাওয়া কাঁচ আমি বের করতাম না, এক সময় ইনফেকশন হয়ে গেলো যেটা অনেক ভুগিয়েছে আমাকে।

কাঁচের চুড়ি ভাঙা বাদ দিয়ে আমি সেল্ফ টর্চার করার অন্যান্য পথ খুঁজতে লাগলাম। রাত জেগে বসে থাকতাম, একসময় ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়তাম। কালো ছিলাম দেখে চোখের নিচে কালি দেখা যেতোনা, কিন্তু চোখ কোটরে ঢুকে গিয়েছিল। আমার একমাত্র ফ্রেণ্ড লায়লা আমার এই অবস্থা দেখে কাঁদতো। নিজের প্রতি ঘৃণা, হতাশা, কষ্ট, আত্মহত্যা প্রবণতা আমাকে অন্য একটা জগতে নিয়ে গিয়েছিলো।

আমার একটা কালো বিড়াল ছিলো, কুচকুচে কালো। প্রতি সপ্তাহে গোসল করাতাম, বিড়ালের আচড় যন্ত্রণা ভয়ানক। তবে আমার বিড়ালটা খামচি দিয়ে আমার মাংস খুবলে বের করতে ভালবাসতো, এই বিড়ালটাকে আমি আমার ব্ল্যাক ম্যাজিকে ব্যবহার করতে চেয়েছিলাম হাঃ হাঃ হাঃ আমি ছবি আঁকা ছেড়ে দিয়েছিলাম, গান গাওয়া ছেড়ে দিয়েছিলাম, অন্ধকারে জীবনযাপন। আমার দেয়ালে শুধু একটা কথা বিশাল বড় করে লেখা ছিলো, "I HATE MYSELF, YUK THU!!!" আমার কিশোরীবেলা পর্ব ১ : একটি ঘাস অথবা নামের গল্প, নামটি দূর্বা ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।