মনে রবে দীর্ঘশ্বাসে, আর ১মিনিট নীরবতায়....! [যখন নিজের কথা লেখার ইচ্ছে হলো আমি ভেবেই রেখেছিলাম শৈশব নিয়ে কিছু লিখবো না । আমার শৈশবের স্মৃতি অতটা মধুর লাগেনা আমার কাছে । নিজের কৈশোরের স্মৃতিও তেমন আহামরি আনন্দের কিছু নয় যদিও আমি এখনো কিশোরী । তবুও আমি আমার কৈশোর নিয়েই লিখতে চাই হোক তা রঙিন অথবা বিবর্ণ...]
আমি জন্মেছিলাম আষাঢ় মাসের রাতে, ইংরেজি মাস হিসেবে তখন জুলাই চলছে আর বাংলা তারিখ ১৮আষাঢ় । আমি আমার বাবা মায়ের একমাত্র কনিষ্ঠ কন্যা হিসেবে জন্মগ্রহণ করি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হসপিটালে ।
সময়টা নিখুঁত ভাবে লেখা রয়েছে, ৩রা জুলাই ১৯৯৪, রবিবার রাত ১২.০৫ ।
সবার ভাষ্যমতে সজারুর কাটার মত মাথাভর্তি চুল, বড় বড় চোখ করে ৫পাউন্ড আমি সবাইকে ঘুরে দেখছিলাম । আমি এখনো পর্যন্ত কারো কাছে জানতে চাইনি আমার জন্মের পর কার কেমন অনুভূতি হয়েছিল, জানতে ইচ্ছে করতোও না । তবুও কে একজন যেনো মুখ ফস্কে বলে ফেলেছিলো যে, আমার নানী খুব কেঁদেছিলো সে নাকি নাতি দেখতে চেয়েছিলো তারচে বড় কথা নাতনী যদিও হলো কেনো কালো,এ নিয়ে ।
এ কথাটা শোনার পর আমি বেশ অবাক হই, একটা বাচ্চা জন্মের আনন্দের চেয়ে মানুষের কাছে ছেলে মেয়ে অথবা কালো ফর্সা ব্যাপারটা কত গুরত্বপূর্ণ হয়ে দাড়ায় !
সবচে খুশি ছিলো আমার বাবা এবং আমার বোন ।
সকালে বাবা মিষ্টি কিনে পূর্বনয়টোলার সব প্রতিবেশীকে বিলানো শেষে তার মনে হলো তার মেয়ের নাম ঠিক করা হয়নি এখনো !
বাবা বাসা থেকে হাটতে হাটতে মালিবাগ রেলগেটের কাছ আসলেন, হঠাত্ এক কোণে দূর্বাঘাস দেখে ঠিক তখনি মনে হলো তার এই মেয়েটার নাম হবে দূর্বা । কিন্তু সাথে সাথে তার মন খারাপ হয়ে গেলো, আমার ভাবুক বাবা ধরেই নিলেন তার এই প্রস্তাব প্রত্যাখান করা হবে, আম্মু আর বোন কিছুতেই মেনে নিবেনা । তবে যাইহোক তিনি জিতে গিয়েছিলেন নামটা নিয়ে
যখন নাম ঠিক হলো দূর্বা জাহান তখন বাবার কাছে তার রাজনৈতিক সহকর্মী শ্যামল জানালেন ভারতের প্রথম মহিলা পাইলটের নাম দূর্বা ব্যানার্জী । বাবার আনকমন একটি নাম রাখার আনন্দ কিছুটা মিইয়ে গেলো কিন্তু বড় মেয়ের নাম রাখার সময় তারাশঙ্করের উপন্যাস দ্বারা প্রভাবিত হওয়া আমার বাবা ছোট মেয়ের একটি সম্পূর্ণ প্রভাবমুক্ত নাম রাখতে সমর্থ হয়েছিলেন ।
আকীকা নামক ব্যাপার স্যাপারের উর্ধ্বে কিছু করার প্ল্যান ছিলো পরিবারের।
ঠিক হলো আমার নামকরণ উত্সবে বাংলাদেশের ১০০জন কবিকে ইনভাইট করা হবে । তারা আসবেন একটা উত্সবে তারচে বড় ব্যাপার কবিরা একত্রিত হবেন । বাবা পাবলিশার ছিলেন, তার কাছে এটা কোন ব্যাপার ছিলোনা । সে সব কবিকে ইনভাইট করলেন, প্রত্যেকের কাছে নামের প্রশংসা আর অনুষ্ঠানে আসার সম্মতি পেয়ে বাপ আমার খুশিতে ডগমগ । সবশেষে গেলেন স্যার হুমায়ুন আজাদের কাছে.......
হুমায়ুন আজাদ তার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনে বললেন, বাচ্চু বাংলাদেশে ১০০জন কবি আছে নাকি? খুঁজলে তো ১১জনকেও পাওয়া যাবেনা এই কথা বলে তিনি নাকচ করে দিলেন ।
বাবা আর কি করবেন তার কাছে আসলেই এই উত্তর ছিলোনা!
অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হলো নিউ ইস্কাটনের চপস্টিক চাইনিজ রেস্টুরেন্টে (আমি জানিনা রেস্টুরেন্টটা এখনো আছে কিনা),তারিখ ২১শে আগস্ট ১৯৯৪ আমার বয়স তখন ৫০দিন । অনুষ্ঠানে প্রধাণ বৈশিষ্ট্য ছিলো 'NO GIFT' (এজন্য আর জন্মদিনে গিফট-টিফট পাই না, আফসোস!)
নামকরণ উত্সবে শামসুর রাহমান, নির্মলেন্দু গুণ, মহাদেব সাহা,আল মাহমুদ,সৈয়দ শামসুল হক, হেলাল হাফিজ, রফিক আজাদ, ব্রাত্য রাইসু, সমুদ্র গুপ্ত, ত্রিদিব দস্তিদার, মিনার মনসুর, আবুবকর সিদ্দিক, খোন্দকার আশরাফ হোসেন, সুহিতা সুলতানা, সুকুমার বড়ুয়া, দিলারা হাফিজ সহ ৭২জন কবি অংশগ্রহণ করেছিলেন । আমার ভাবতেও ভালো লাগে আমার নামকরণ উত্সবে এত বিখ্যাত মানুষেরা এসেছিলেন!
আমি ২১ আগস্ট থেকে দূর্বা জাহান নামটির অধিকারিণী হয়ে গেলাম । আমি সবসময়ই নিজের নামটা নিয়ে একটু গর্ববোধ করি কারণ আমার মতে অসাধারণ সুন্দর একটা নাম অসাধারণ ভাবে রাখা হয়েছিলো
এবং এই নামকরণ উত্সবের গল্প লিখতে পারার জন্য আমি একজনকেই দায়ী করবো, সে আমার বোন বিপাশা । ও এতটা নিখুঁত আর গুছিয়ে সবকিছু লিখে রেখেছিলো বলে আমাকে কারো স্মৃতির শরণাপন্ন হতে হয়নি
কিশোরীবেলা লিখবো অথচ নিজের পরিচয়ের গল্প নেই ব্যাপারটা কেমন বিদঘুটে লাগছিলো নিজের কাছেই ।
তাই ভাবলাম গল্পটার শুরু হবে যেদিন থেকে আমি দূর্বা, তারপর কৈশোর,আমার কিশোরীবেলা...
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।