আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

"রক্তের ঋণ"

কাছাকাছি৯৬ "রক্তের ঋণ" ক্লাসের মাঝে বড় ভাইয়ের ফোন, এই শোন- “আজকে আব্বাকে thorough চেকআপ করাতে নিয়ে যাব, কোন কাজ রাখবি না। আব্বাকে অফিস থেকে পাকড়াও করব। ” ok, ভাইয়া বলে কলটা কেটে দিয়ে একটা হাসি দিয়ে মনে মনে বললাম “রহমান সাহেব, আজ তুমি কেমনে পালাও, দেখি!” আমার আব্বা ওরফে রহমান সাহেব মানুষটা লম্বা-চওড়া হলে কি হবে, ডাক্তারদের ব্যাপারে তার অদ্ভুত একটা ভীতি কাজ করত। (এই কারনেই বোধ হয় আম্মার প্রবল ইচ্ছাকে উপেক্ষা করে আমরা দুই ভাই যখন ইন্টারে থাকতেই Fourth subject হিসেবে বায়োলজিকে লিস্ট থেকে কর্তন করে ফেললাম, উনি মৌন ছিলেন, আর মৌনতাই সম্মতির লক্ষণ । ) যাই হোক, কয়েক মাস যাবৎ আব্বার শরীর খারাপ।

কিন্তু নিজেই নিজের ডাক্তারি করে যাচ্ছেন, তবু ডাক্তারের পরামর্শ নিচ্ছেন না। আজ দুই ভাই যখন জোট পাকিয়ে তার অফিসে গিয়ে হাজির হলাম ছুটির সময়ে, তিনি ভাবলেন বোধহয় সমস্যা গুরুতর। কালো মুখটা আরো কালো লাগতে লাগলো। কিন্তু ভুল ভাঙ্গিয়ে যখন আসল কাহিনী বললাম, তখন কি যে তার হাসি! গর্বমাখা অভিব্যক্তি, কলিগদের ডেকে ডেকে বলছেন “দেখ, আমার পাগল ছেলেদের কাণ্ড, তারা আসছে আমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়ার জন্য, আরে আমি কি একলা যেতে পারি না নাকি ?” আব্বার কলিগরাও উনাকে ভালোমত জানতেন, উনারা বললেন “সমস্যা কি, ভালোই তো। কয়জনের এমন কপাল হয় যে বাবাকে ডাক্তারের কাছে নিতে দুই ছেলে কাজ ফেলে দিয়ে বাবার অফিসে চলে আসে, যাও যাও, ঘুরে আস ।

” নিমের পাঁচন খেলে ছোট বাচ্চাদের মুখ যেমন হয়, তেমন মুখ নিয়ে আব্বা আমাদের সাথে রওয়ানা দিলেন। গন্তব্য – LAB AID. ল্যাব এইডের ডাক্তার সাহেব খুবই মনোযোগের সাথে আব্বার সমস্যাগুলো শুনলেন, তারপর এক গাদা টেস্ট দিলেন এবং সাহস দিলেন। ডাক্তারের চেম্বার থেকে বের হয়ে উনাকে মনে মনে স্যালুট দিলাম, কারণ – প্রায় আধা ঘণ্টা এক জন রোগীর পেছনে যে ডাক্তার ব্যয় করেন, তাঁকে তো হসপিটালে না রেখে মিউজিয়ামে রাখা উচিৎ । তিন দিন পরে রিপোর্ট এনে ডাক্তার সাহেবকে দেখাতেই উনার কপালে পুরু ভাঁজ পড়ল, উনি মুখে কিছু না বলে আরও কিছু টেস্ট দিলেন আর বললেন খুব দ্রুত সরকারি কোন হসপিটালে অ্যাডমিসন নিতে, তারপর সেখানে আরও কিছু টেস্ট করাতে হবে। এক বন্ধুর বাবা তখন পিজির প্রফেসর, বলতেই অ্যাডমিসনের ব্যবস্থা করে দিলেন।

তারপরের ঘটনাবলি খুব দ্রুত ঘটতে লাগল, এপ্রিলের ১৮ তারিখ কনফার্ম হলাম আব্বার অসুখ সম্পর্কে, Carcinoma ওরফে ক্যান্সার । ডাক্তার বললেন, “অপারেশন করলে বুঝা যাবে, ক্যান্সারটা কোন স্টেজে । আপনারা টাকা-পয়সার যোগাড় করেন আর রক্তের ব্যবস্থা করে রাখবেন, অপারেশনের পর লাগতে পারে। আল্লাহ ভরসা । ” রক্তের গ্রুপ সহজলভ্য হওয়ায় এই ব্যাপারে খুব একটা টেনশন করলাম না, টাকা-পয়সার ব্যবস্থাও করে ফেললাম, এখন শুধু অপেক্ষা আর প্রার্থনার পালা।

যথারীতি অপারেশন হল, ডাক্তার আশার বাণী শোনালেন, আমরাও আশায় বুক বাঁধলাম। অপারেশনের পর ডাক্তার যখন রক্তের কথা বললেন তখন আত্মীয়-স্বজনের আগে, স্কুল-কলেজের বন্ধুদের আগে ছুটে আসলো আমার BUET এর দুই দোস্ত। পরের দিনের Class Test, Assignment কে পেছনে রেখে আরেকজনের জীবন বাঁচানোর জন্যে, স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে তারা চলে এলো ঢাকার সেন্ট্রাল হসপিটালে। এক ব্যাগ রক্তের বিনিময়ে তাদের কপালে জুটল একটা জুস, দুই গ্লাস পানি, পরে টং দোকানের এক কাপ চা ! তার পরের ইতিহাস আরও সংক্ষিপ্ত, আব্বা আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন ১২ই মে, রাত সাড়ে তিনটায়। বলতে গেলে আমাদেরকে কোন কষ্টই উনি দিলেন না।

কর্মজীবনে অ্যাকাউনটেন্ট ছিলেন, কর্মে বিশ্বাসী ছিলেন, ঋণে বিশ্বাসী ছিলেন না; তাই মারা যাওয়ার পর এমন কাউকে খুঁজে পেলাম না যার কাছে উনার ঋণ ছিল। বরং যারা উনার কাছ থেকে টাকা ধার নিয়েছিলেন, তারা এসে তাদের সুবিধামত সময়ে টাকা ফেরত দিয়ে গেলেন। ঋণ থাকলেও ওয়ারিশ হিসেবে সেটা শোধ করার দায়িত্বটা কিন্তু আমাদের দুই ভাইয়ের উপর বর্তায়। কিন্তু আজও যখন প্রতি বছর এপ্রিল-মে মাস আসে, ঐ দুই ব্যাগ রক্তের কথা আমার খুব মনে পড়ে। মনে পড়ে ঐ দুই বন্ধুর কথা, তাদের ভালবাসার কথা, তাদের দায়িত্ববোধের কথা।

আল্লাহ পাকের অশেষ রহমতে জীবনে অর্থ-সুখ–স্বাচ্ছন্দ্য’র অভাব না হলেও রক্তের এই ঋণ শোধ করার সামর্থ্য আল্লাহ আমাকে দেননি, দেননি বলেই তাঁর প্রতি আমার অশেষ কৃতজ্ঞতা। জীবনে যদি কখনও সেই সুযোগ আসে, রক্ত দিয়েই যেন রক্তের ঋণ শোধ করতে পারি। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.