‘এই নির্জীব সময়ের বুকে তুমি এনে দাও প্রেমের স্পন্দ, চাই একবার শুধু একবার, হোক সব্বার চোখ প্রেমে অন্ধ’—কাজী কামাল নাসের
১.
কারণে অকারণে সুমন ভাই খুব মারতো আমাকে। মারামারি খেলতে গিয়েও মার খেতাম আমি। কোনোভাবেই তাঁকে মারতে না পেরে একা একাই যুদ্ধ যুদ্ধ খেলতাম। স্কুল থেকে ফিরেই বাঁশের শক্ত একটা কঞ্চি নিয়ে উঠে পড়ে লেগে যেতাম যুদ্ধ যুদ্ধ খেলায়। আমার প্রতিপক্ষ ঘরের পেছনে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকা নিরীহ কলাগাছ।
তখন বেশ মজা পেতাম এই খেলায়। সুমন ভাই দূরে দাঁড়িয়ে দেখত আর মুচকি হাসতো। তখন খুব রাগ উঠে গেলে, ওই কঞ্চি দিয়ে কলাগাছটিকে পাগলের মতো মারতাম। মাঝে মাঝে কলাগাছটিকে খোঁচা দিলে সেটির গা দিয়ে পানি বের হয়ে আসতো। এতেও যখন ঝাল মিটতো না, তখন দৃশ্যের ভেতর কলাগাছটিকে কেটে কুটিকুটি করে দিতাম।
কলাগাছটিকে যখন মারতাম মা এসে বলত, ‘বাবা, বৃক্ষরা অবলা। এদেরকে এভাবে মারতে নেই। তোমার মতো গাছেদেরও কষ্ট হয়। ওরাও কষ্টে কাঁদে। ’ মা কলাগাছটির গা দেখে বলেছিলেন, ‘এই দ্যাখো তুমি মেরেছ বলেই গাছটির গা দিয়ে রক্ত বেরোচ্ছে, আর মেরো না বাবা।
’ মা’র এই কথা শুনে সেদিন খুব কষ্ট হয়েছিল। নিজেকে খুনি, অপরাধী মনে হয়েছিল। অভিমানও জেগেছিল সেদিন; যে সুমন ভাই কী তাহলে জানে না যে, তিনি মারলে আমারও গাছেদের মত কষ্ট হয়। আমার কান্না পায়। এই অভিমান নিয়ে সেদিনই প্রথম জেনেছিলাম, গাছেদের রক্তের রং সাদা।
তাদের চোখ নেই তবু তাদের অশ্রুর রং শাদা।
২.
আমাদের বাড়ির পাশে বুড়ির হাট। ওই হাটে প্রতি সোমবার জাদু দেখাতো আসতো অচিন জাদুকর। একেক সপ্তাহে একেকজন করে জাদুকর আসতেন। পরে তাঁকে আর কখনো দেখা যেত না।
প্রতি সোমবার বাবার আঙুল ধরে জাদু দেখতে যেতাম। একদম সামনের সারিতে দাঁড়িয়ে বাতাসা খেতে খেতে দেখতাম আশ্চর্য সব ম্যাজিক। ফুল ছুঁয়ে দিলেই পাখি আর কাগজ ছুলেই বল। কখনো কাগজে ফুঁ দিলেই টাকা। আমি মুগ্ধ হয়ে এইসব জাদু দেখতাম।
আর রাতে শুয়ে শুয়ে ভাবতাম, জাদুকর তো জাদুবলে অনেক টাকা বানাতে পারে। তাহলে জাদু শেষে ওই কিম্ভূত মুখের জাদুকর সবার মতো কেন আমার কাছ থেকেও পকেটে থাকা একমাত্র এক টাকার পুরোনো নোটটা নিয়ে নিল। তবু কেন যেন, গোপনে গোপনে জাদুকর হওয়ার বাসনা পুষে রাখতাম মনে।
একদিন সোমবার হাটে কুচকুচে কালো এক জাদুকর এসে অদ্ভুত সুরে জাদু দেখার আহ্বান জানালেন। আর বললেন, কোনো কথা বলা যাবে না।
কথা বললে না কি তাঁর বিপদ হয়ে যাবে। চুপচাপ দেখছে সবাই। জাদুকর একটা চকচকে ধারালো ছুরি দিয়ে নিজেই নিজের হাত কাটছে। আর হাত থেকে মাটিতে গড়িয়ে পড়ছে লাল লাল জলের নহর। কিছুক্ষণ পরেই সেই লাল লাল জল ভ্যানিশ, আর জাদুকরের হাতও ঠিক হয়ে গেল।
সবাই হাততালি দিয়ে মুখরিত করে তুলল জাদুপাড়া। ওই লাল জল দেখে আমার ভেতরে কেমন যেন একটা মিহিন ব্যথা নাড়া দিয়ে উঠেছিল। রাতে বাড়ি ফেরার সময় বাবার আঙুল শক্ত করে ধরে জানতে চেয়েছিলাম, ওই লাল জল আসলে কী? বাবা বলেছিলেন, আসল-নকল জানি না তবে ওগুলো রক্ত। মানুষ খুন হলে রক্ত ঝরে। রক্ত মানে খুন।
সেই রাতে জেনেছিলাম, মানুষের শরীরের রক্তের রং গাঢ় লাল। তারপর পুরোটা পথ আমার চোখের ভেতরে ওই রক্তের নহর ভেসে ভেসে যায়। সেই রাতে কী এক ভয়ংকর স্বপ্ন দেখে হারিয়ে ফেলেছি আমার জাদুকর হওয়ার রঙিন বাসনা।
৩.
আমাদের বাড়িতে একটা কুকুর ছিল। নাম বাহাদুর।
ছিল মানে, গত পরশু বাবা ফোনে জানালেন, বাহাদুর কেন যেন অভিমান করে নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে। গত চার দিন বাহাদুরের কোনো খোঁজ নেই। বাবা দীর্ঘদিন ধরে বাহাদুরকে আদর-যত্ন করতেন। কেউ যদি একটু বাহাদুরকে মারতো তাহলে বাবা খুব খেপে যেতেন। বাহাদুরের আঘাত লাগা স্থানে বাবা হাত দিয়ে ওষুধ লাগিয়ে দিতেন।
তাই বাহাদুর নিরুদ্দেশ হওয়ার খবরে বাবা খুব কষ্ট পেয়েছেন। আমারও বেশ খারাপ লেগেছে। বাহাদুরের আচরণ বেশ অদ্ভুত। রাতের বেলায় বাড়িতে চোর এলে, বাহাদুর তাঁকে ঠিক ঠিক আটক করে ফেলতো। কিন্তু কখনো কামড় বসাতো না।
তারপর ডেকে ডেকে বাড়ির সবাইকে জেগে তুলে সেই চোরকে সোপর্দ করতো বাহাদুর। কী নিয়ে বাহাদুরের অভিমান, আজ খুব জানতে ইচ্ছে করছে।
৪.
গত ৯ ডিসেম্বর পুরান ঢাকায় নৃশংসভাবে হত্যা হওয়া বিশ্বজিত্ দাস আমার কেউ ছিলেন না, কখনো দেখিওনি তাঁকে। তবুও তাঁর সেই হত্যা দৃশ্য দেখলে বুকের ভেতরটা কেমন হাহাকার করে ওঠে। জানেন, খুব কষ্ট হয় আমার।
যখন ওই দৃশ্য ভেসে ওঠে চোখে, তখন অন্ধ হয়ে যাই আমি। চোখের ভেতরে শুধু লাল আর লাল।
সেইদিন বুঝি বিশ্বজিত্ আমার ছোটবেলার কলাগাছের ভূমিকায় খুব ভালোভাবে উতরে গিয়েছিল। ছেলেবেলার ওই জাদুকরের রক্তের রঙ আর বিশ্বজিতের রক্তের রঙ একই রকম, গাঢ় লাল। বাবা তাহলে সেদিন মিথ্যে বলেননি আমাকে।
বিশ্বজিতের খুনিদের সেদিন কোথায় যেন না পাওয়ার একটা হতাশা ছিল। সেই না পাওয়ার বেদনায় তাঁরা কয়েকজন মিলে একলা বিশ্বজিেক চাপাতির কোপে শেষ করে দিয়ে আশ্চর্য ম্যাজিশিয়ান হয়ে গেল। আর বিশ্বজিতের শরীর থেকে বের হওয়া রক্তের স্রোত দেখে বোঝা গেল, বিশ্বজিত্ মানুষ ছিলেন, তাঁর বাবা ছিল, মা ছিল, সুমন ভাইয়ের মতো ভাই-ও ছিল। তাহলে খুনিদের কে কে আছে?
মা আমাকে শিখিয়েছিল, শুধু মানুষ নয় গাছকে মারলেও তার কষ্ট হয়। বাবা শিখিয়েছিলেন, মানুষ খুন হলে রক্ত বের হয়, লাল লাল।
বিশ্বজিত্ও এইসব জানতেন। আর জানতেন বলেই প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে পালানোর চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু খুনিদের কী শেখানোর কেউ ছিল না?
আমাদের বাড়ির বাহাদুরও তো কোনো চোরকে ধরলে কামড় দিত না। তাহলে ওরা কারা? যারা বিশ্বজিেক প্রকাশ্যে চাপাতি দিয়ে খুন করল। বাহাদুরও যে কাজ করে না, ওরা কেন তা করল? ওঁরা তবে কোন মানুষ?
৫.
বিশ্বজিতের প্রেমিকা ছিল কী-না তা জানা হয়নি।
থাকলেও হয়তো তিনি গোপনে গোপনে কাঁদছেন কী না সে প্রশ্নও তুলছি না। তবে আমার প্রেমিকা ছিল। ছিল মানে ছিল-ই। রোজ রাতে আমি ঘুমের গোপনে তাঁর ঠোঁটে চুমু দেই। একবার, দুইবার করে মাঝে মাঝে অজস্র চুমু দিয়ে ফেলি প্রেমিকার ঠোঁটে।
আমার প্রেমিকা তা কোনোকালে জানবে কী-না জানি না।
৬.
বাবা আমাকে কখনো বলেননি, খুনিদের রক্তের রঙ কেমন? খুনিদের প্রেমিকারা কেমন হয় জানি না। খুনিদের ঠোঁটও কী চকচকে চাপাতির মতো ধারালো? তাঁরাও কী প্রেমিকার ঠোঁটে চুমু দেয়? যদি দেয়, তাহলে তো প্রেমের নামে রোজ রাতে তাঁরা প্রেমিকা হত্যা করে! যদি তা না হয়, তাহলে তাঁদের প্রেমিকাদের ঠোঁট তবে কী দিয়ে বাঁধা। ........... ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।