সাপের শরীর হয়ে আঁধারের গাছ/ কুয়াশার বন্যায় ডুবো দেবী মাছ! মর্জিনা ভাতের হাঁড়িটা চুলার পাশে রাখা মাটির ডাঁইয়ের উপর নামিয়ে রেখেই ছটফট করতে থাকে। রোজ এই নির্জন দুপুরটাতে সে দীঘিতে নেমে শান্তি খোঁজে। মাথার উপর খাড়া রোদে নিজের ছায়া নিজের ভেতর ঢুকে যায়। ভাতের হাঁড়ির চারপাশে লুতা দেয় নরম পাটের আঁশ ভিজিয়ে। তারপর সকালের এঁটো বাসন আর একটা টিনের কলস কাঁখে নিয়ে গলা বাড়িয়ে শাশুড়িকে জানান দেয়।
ঝট করে ঘর থেকে শুকনো কাপড় এনে পুব দিকের পাটখড়ির বেড়াতে ঝুলিয়ে দিয়ে হাঁটা ধরে।
মর্জিনা গায়ের ব্লাউজ টা খুলে ফেলে দিঘীর পাড়ে এসে। দাঁতে চেপে ধরে ঘন সবুজ লতাপাতার আঁচলটাকে। গাঢ় গভীর জল টানতে থাকে! কি যে আকর্ষন। কোন মতে শরীরে পেঁচিয়ে নেয় শাড়ীটাকে।
তারপর তাল গাছের গুঁড়ি ফেলে করা ঘাট থেকে পা ছড়িয়ে দেয় পানিতে। চুম্বকের মত জল তাকে টানতে থাকে। এঁটো বাসন ধুতে ইচ্ছেই করেনা। পাশেই গাদা খানেক ছাই। জলের ছিটেই ভিজে সপসপ করছে।
বোধহয় একটু আগেও কেউ বাসন মেজে গেছে।
যখন হাটুজল হয়ে কোমর জলে মর্জিনা। গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। মনে হয় চারপাশে শনশন করে ঝড় বয়ে গেল। কানের কাছে বাতাসের ঝড়ো গান।
লম্বা কালো চুল জল স্পর্শ করেছে ততক্ষনে! মর্জিতা হাওয়ায় পাওয়া মানুষের মত নামতেই থাকে।
আজ সকালেই তার ঘরের মানুষটার সাথে এক চোট ঝগড়া হয়েছে। রোজই কমবেশি হয়। ঘুমের ভেতর শরীরের জ্বালাতন মর্জিনার সহ্য হয়না।
লোকটাকে রোজই ভুতে পায়।
ভোরের আজান হয় আর খাবলে খাবলে ধরতে থাকে। তখন তো সে ঘুমিয়ে কাদা! টের পেলেই গায়ে আগুন ধরে যায়। আজ ঝটকা মেরে হাত সরিয়ে দিতেই ঝগড়া।
পায়ের নিচে কিছু একটা ঠেকছে যেন! মর্জিনার শরীর ধাতব কিছুর স্পর্শ অনুভব করে। হাতের নরম পশম দাঁড়িয়ে যায়।
বিয়ের চার মাসেও মানুষটা ঠিক সেইরকমই আছে। যেন শরীরের অলি গলি এখনো খুব অচেনা! ঠোঁটের কোনে হাসি লেগে থাকে বিজলীর মত। আরো গভীরে নামতে থাকে সে।
স্পর্শটা বেড়ির মত বাড়তে থাকে যেন। হাত নিচু করে পায়ের নিচটা ছুঁয়ে দেখতে যায়।
দড়ির মত কিছু যেন দু পা আটকে ধরছে। হঠাৎ করে ভয়ে হিম হয়ে যেতে থাকে শরীর টা। এক গোছা চুল যেন। সুতলির মত আকুলি বিকুলি করে তার পা লেপ্টে দিচ্ছে।
প্রানপনে ঘাটের দিকে আসতে চায়।
অসম্ভব! অসম্ভব জোর লাগে পায়ে। ঝট করে কেউ ছেড়ে দেয় বুঝি। তালগাছের শ্যাওলা ধরা কালো গুঁড়ি র উপর বসেই হাঁফাতে থাকে। দ্বিতীয়বার আর জলে নামার সাহস হয়না। এখনো শরীর কাঁপছে!
কোমরের কাছে শাড়ীর বাঁধন টা আলগা করে সারা গায়ে জড়িয়ে নেয়।
মুহূর্তে সারা গা ঢেকে যায় সবুজ লতাপাতা আর বুনো ফুলে। ধীরে ধীরে অলস হাতে বাসন গুলো ধুতে থাকে। তার কলসটা বাঁকা করে ডুবিয়ে অর্ধেক ভরে নেয় জলে। ফিরতে থাকে বাড়ির দিকে। উঠানের কাছাকাছি আসতেই নুয়ে পড়া বাঁশের ডগায় আঁচল আটকে যায়।
পায়ে পায়ে বেধে যেতে থাকে ভেজা শাড়ি। মাথার ভেতরটাতে যেন কেমন করে ওঠে। আম্মাজ্বি বলেই হাতের বাসন কোসন আর কাঁখের কলস ঝনঝন শব্দ করে পড়ে যেতে থাকে। সাথে মর্জিনাও।
কয়েকটা দিন যে কেমন করে কাটে মর্জিনার সে নিজেও হুঁশ করতে পারেনা।
সেই দুপুরে শুরু। এর পর প্রায়ই এমন হয়। মাঝ দুপুরে ভীষন ভয় ভয় করে মর্জিনার। যেন চারপাশে বামন বামন কিছু ছেলে আর মেয়ে তাকে ঘিরে ফিসফিস করতে থাকে। চালের বাতায় গুঁজে রাখা লাকড়ি খুলে নিয়ে হাতে করে মর্জিনা।
তারপর ছুঁড়ে মারে। সারা মুখে ভয় আর হিংস্রতা লেগে থাকে মর্জিনার।
বিকেল হয়ে আসে। মর্জিনা প্লাস্টিকের লাল রঙের আয়নাটা নিয়ে বহুদিন পর মাটির বারান্দায় বসে। চুলে কতদিন তেল দেয়া হয়না।
চিরুনী পড়েনা। সোনার রঙ দিন দিন কেমন হয়ে যাচ্ছে!
খেতে পারেনা। সুডৌল শরীরটা ক্ষীণ হতে হতে যাচ্ছেতাই রকমের ঢল ঢল করে। হাঁটতে গেলে পায়ে পায়ে বাড়ি খায়। দুপুরে কোন রকমে দু মুঠ মুখে দিয়েছে।
তারপর বিছানায় গড়িয়ে পড়তেই দেখে কোথা থেকে মাথার বালিশের কাছে সুড় সুড় করে বামন বামনি গুলো এসে বসে আছে। চুলের ভেতর ঢুকে গিয়ে দু একবার সুড়সুড়ি ও দেয়।
মর্জিনার ভাল লাগেনা। জোর করে ঘুম ভেঙে জেগে উঠতে চায়। ওরা স্বপ্নে কিচমিচ করে করে কত কি যে বলে!
নতুন একটা কবিরাজের খোঁজ পেয়েছে মানুষটা।
কবিরাজের কাছে যেতে মর্জিনার ভয় ভয় করে। খুব ভোরে তবু সাহস করে মানুষটির হাত ধরে গ্রামের পথ দিয়ে টাল খেতে খেতে মর্জিনা এগিয়ে যায়। দীঘির পাড় ঘেষা জামগাছটায় তখন একটা অজানা পাখি অস্থির হয়ে ডেকে চলেছে!
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।