আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

প্রসঙ্গ: মিয়ানমারের সাথে সমুদ্র বিরোধ নিষ্পত্তি সাক্ষ্য ও যুক্তির দুর্বলতায় হেরেছে বাংলাদেশ বঙ্গোপসাগরের মহীসোপানের অধিকার হারিয়ে বিরাট ক্ষতিগ্রস্থ হবে বাংলাদেশ ইতোমধ্যে হারিয়েছে তেল-গ্যাসের ১০টি ব্লক এরপরও কী বলতে হবে সমুদ্র বিজয়? জনগণ এত বিভ্রান্ত

বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে সমুদ্র বিজয় উপরক্ষে যুব সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে শেখ হাসিনাকে বিশাল গণসংবর্ধনা দেয়া হয়। বিভিন্ন রাজপথে যানবাহন চলাচল বন্ধ করে শুধু মিছিলের জন্য পথ খোলা রাখা হয়। মিছিলের পর মিছিল সমবেত হতে থাকে। কিন্তু আগতদের চেহারা-সূরত, ভাব-ভঙ্গী দেখে প্রশ্ন উদ্ভৃত হয় সমুদ্র জয় সম্পর্কে সত্যিই কী এরা কিছু জানে? আসলেই কী সমুদ্র জয় হয়েছে? নাকি সত্যিকার অর্থে পরাজয়ই হয়েছে। হলে এর ক্ষতি কতদূর পর্যন্ত? গতকালের মিছিলে সমুদ্র জয়ের প্রচারণার পরিবর্তে সত্যিকার বিষয় নিয়ে আলোচনা কতটুকু? সমুদ্র জয় নিয়ে বিভ্রান্তি কেন? এর কী অপনোদন হওয়া উচিত নয়? উল্লেখ্য, জার্মানির হামবুর্গ শহরে স্থাপিত সমুদ্রসীমাবিষয়ক জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল ১৪ মার্চ বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের সমুদ্রসীমাবিষয়ক বিরোধ নিষ্পত্তির রায় প্রদান করেন।

এই ট্রাইব্যুনাল বা সালিসি আদালতে আমাদের জয় অবশ্যই কাম্য ছিল। কিন্তু এই রায়ের ফলে বাংলাদেশের একতরফা জয় হয়েছে কি বলা যায়? অবশ্যই নয়। প্রথমত: ট্রাইব্যুনালের ৫০৬টি ধারাসংবলিত রায়ে সালিসি আদালত গঠন বিষয়ে বিবরণ দেওয়ার পরই রয়েছে উভয় পক্ষের দাবিনামার বিবরণ। আদালত এরপর পূর্বাপর বৈঠকসমূহের উল্লেখ করে যেসব বৈঠকে বিবদমান উভয় পক্ষ নিজেদের দেশের কন্টিনেন্টাল শেলফের সমুদ্রসীমা নিয়ে বিরোধ নিষ্পত্তি করতে পারেনি। বিরোধ নিষ্পত্তি করার জন্য সালিসি আদালতের কাছে বাংলাদেশের নিবেদন ছিল যে, সমুদ্রসীমা বিষয়ক আন্তর্জাতিক আইন টঘঈখঙঝ ওওও অনুযায়ী সমুদ্রতট থেকে ২০০ নটিক্যাল মাইলের বাইরে কন্টিনেন্টাল শেলফের (সিএস) সীমানা বিরোধ নিষ্পত্তির বিষয়টি।

ট্রাইব্যুনালে বাংলাদেশের প্রথম দাবি ছিল, ১৯৭৪ সালের দুই দেশের ঘোষিত সমুদ্রসীমা অনুযায়ী দু’ দেশের মধ্যে সমুদ্রসীমা নির্ধারণ করে দেয়া হোক, যাতে ২০০৮ সালেও দুই দেশ সম্মত ছিল বলে উল্লেখ করেছে বাংলাদেশ। মিয়ানমার এতে আপত্তি করে বলে- ওই সমঝোতাগুলো ছিল জাহাজ চলাচল বিষয়ক, সীমানা নির্ধারণের চুক্তি নয়। ট্রাইব্যুনাল মিয়ানমারের যুক্তির প্রতি সমর্থন জানায়। বাংলাদেশ ওই চুক্তির প্রয়োগ সম্পর্কে নানা প্রমাণ দেখালেও মিয়ানমার তা অগ্রাহ্য করে। ট্রাইব্যুনালও বাংলাদেশের দাবি গ্রহণযোগ্য মনে করেনি।

মিয়ানমার বলে, সেন্ট মার্টিন দ্বীপ তার স্থলসীমানার ভেতরে পড়ে। তাই একে পৃথকভাবে দেখা হোক। ট্রাইব্যুনাল মিয়ানমারের যুক্তিকে মেনে নিয়ে সেন্ট মার্টিন দ্বীপকে মূল ভূখ- থেকে বিচ্ছিন্ন ধরে বাংলাদেশকে সর্বাধিক ১২ নটিক্যাল মাইল (১ নটিক্যাল মাইল = ১.৮৫২ কিলোমিটার) রাষ্ট্রীয় সমুদ্রের অধিকার প্রদান করে। ফলে বাংলাদেশ সমুদ্রতটের দক্ষিণ সীমানা সেন্ট মার্টিন দ্বীপের দক্ষিণ থেকে মূল ভূখ-ে টেকনাফের কাছে সরে আসে। এটি ছিল বাংলাদেশের পরাজয়।

দ্বিতীয়ত: সমুদ্রসীমা নিয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের বিরোধের মূল বিষয় ছিল এই যে, মিয়ানমার সমুদ্রতট থেকে সমদূরত্ব নীতির মাধ্যমে এলাকা নির্ধারণের কথা বলে। যাতে বাংলাদেশের আপত্তি ছিল। কারণ তাতে বাংলাদেশ থেকে আসা পলির স্তরের উপর মিয়ানমারের অধিকার বর্তায়। বাংলাদেশ ট্রাইব্যুনালের কাছে উভয় দেশের ইইজেড নির্ধারণের জন্য সমদূরত্ব নীতি প্রয়োগের বিরোধিতা করে। কিন্তু মিয়ানমার সমদূরত্ব নীতি অবলম্বনের কথা বলে।

ট্রাইব্যুনাল নাফ নদের মুখকে সমদূরত্ব রেখা শুরুর বিন্দু সাব্যস্ত করে। বাংলাদেশ টঘঈখঙঝ ওও-এর ৭৬.১ ধারার পলিপাতন নীতি দাবি করলেও ট্রাইব্যুনাল সমদূরত্বের নীতিই গ্রহণ করে। বাংলাদেশ বঙ্গীয় সমুদ্রে পলিপাতনের বিবরণ দিলে মিয়ানমার তার উপর আপত্তি জানায়। ট্রাইব্যুনাল মিয়ানমারের দেওয়া আপত্তি গ্রহণ করে বাংলাদেশের যুক্তি অগ্রাহ্য করে। এটি ছিল বাংলাদেশের পরাজয়।

তৃতীয়ত: বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের সমুদ্রসীমা বিরোধের সালিসি লড়াইয়ে বাংলাদেশ অনেক যুক্তি দেখিয়েছে, অনেক পরিশ্রম করেছে, যার প্রমাণ ১৫১ পৃষ্ঠাসংবলিত রায়ের পাতায় পাতায় আছে। বাংলাদেশ সমুদ্রসীমাবিষয়ক টঘঈখঙঝ ওওও-এর আলোকে যে ভূতাত্ত্বিক যুক্তিগুলো দেখিয়েছে তার সবটা মিয়ানমার অস্বীকারও করেনি। কিন্তু মিয়ানমারের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ট্রাইব্যুনাল ওই যুক্তিগুলো গ্রহণ করেনি। তাই বাংলাদেশ তার সম্ভাব্য সিএস এলাকার মধ্যে অনেক এলাকা হারিয়েছে, যা মিয়ানমার পেয়েছে। চতুর্থত: নদী, সমুদ্র ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞদের মতে, বঙ্গোপসাগরে সমুদ্রসীমা নিয়ে বেশিরভাগ বিষয়ে বাংলাদেশের নীতিগত ও অধিকারগত হার হয়েছে।

অর্জন কেবল বিরোধ নিষ্পত্তি ও সমুদ্রসীমা নির্ধারিত হওয়া। ১ লাখ ১১ হাজার ৬৩১ বর্গ কি.মি. সমুদ্রসীমা প্রাপ্তির তথ্যও সঠিক নয়। ২০১৪ সালে ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা বিরোধ নিষ্পত্তির পরই এ পরিমাণ সমুদ্র বাংলাদেশের অধিকারে আসবে। আর না বুঝে হৈ চৈ এবং আনন্দ-উল্লাসের মাধ্যমে জাতিকে ধোঁকা দেয়া হয়েছে। পঞ্চমত: সমুদ্রসীমা নির্ধারণ নীতির বদলে সমদূরত্ব নীতি প্রয়োগ করায় বাংলাদেশ ২০০ নটিক্যাল মাইল দক্ষিণে ১৫০ নটিক্যাল মাইল মহীসোপানের বিস্তীর্ণ এলাকা হারিয়েছে।

এ এলাকায় বাংলাদেশের তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের ২০টি গভীর সমুদ্র ব্লকের ১৮, ২২, ২৩, ২৬, ২৭ ও ২৮ ব্লক পুরোপুরি এবং ১৩, ১৭, ২১ ও ২৫ নম্বর ব্লক আংশিক হাতছাড়া হয়ে গেছে। সেন্টমার্টিন দ্বীপের দক্ষিণে বাংলাদেশের মূল ভূখ-ের বিষয়টি নিশ্চিত করে মিয়ানমারের সঙ্গে ১৯৭৪ ও ২০০৮ সালে সমঝোতা চুক্তি আছে বলে বাংলাদেশ পক্ষের কৌঁসুলিরা যুক্তি তুলে ধরলেও আদালতে তা পাত্তা পায়নি। এতে বাংলাদেশ সেন্টমার্টিন দ্বীপের দক্ষিণ-পশ্চিম বরাবর তার এক্সক্লুসিভ ইকোনমিক জোন এলাকা হারিয়েছে। ষষ্ঠত: মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা মামলার রায়ে ‘সমুদ্রসীমা নির্ধারিত হলে বাংলাদেশের লাভের সুযোগ ছিল। মিয়ানমারের দাবি অনুযায়ী সমদূরত্ব নীতিতে সীমা নির্ধারণ করায় আমরা কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ব্লক হারিয়েছি।

এক্সক্লুসিভ ইকোনমিক জোনের ক্ষেত্রেও আমাদের হার বেশি। ’ ১ লাখ ১১ হাজার ৬৩১ বর্গ কি.মি. সমুদ্র প্রাপ্তির সরকারি প্রচারণার বিষয়ে ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা বিরোধ নিষ্পত্তির পরই উল্লিখিত পরিমাণ সমুদ্র বাংলাদেশের অধিকারে আসবে। আর এজন্য ২০১৪ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। ওই মামলায় বাংলাদেশকে জিততে হবে। আন্তর্জাতিক আদালতের রায়ে বাংলাদেশের মূল দাবিকৃত বিপুল সমুদ্রাঞ্চল পেয়েছে মিয়ানমার।

ফলে মিয়ানমার তার দাবিকৃত মহীসোপানের হাইড্রো-কার্বনসমৃদ্ধ (গ্যাস ও খনিজ তেল) বেশিরভাগ ব্লকের মালিকানা পেয়েছে। পক্ষান্তরে বাংলাদেশ দূরবর্তী গভীর সমুদ্রের তুলনামূলকভাবে কম সম্ভাবনাময় অঞ্চলেই এক্সক্লুসিভ ইকোনমিক জোনের মালিকানা পেয়েছে। (ইনশাআল্লাহ চলবে) ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।