আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আমার খাদক জীবন বিয়ে বাড়ি পর্ব

সবুজের বুকে লাল, সেতো উড়বেই চিরকাল যারা খেতে ভালোবাসেন, তারা এই সিরিজের আগের লেখাগুলি পড়ে নিতে পারেন। আমার খাদক জীবন ১ আমার খাদক জীবন ২ আমার খাদক জীবন ৩ আমার জ্ঞাতি গুস্টি এতই বিশাল যে, বলতে গেলে ১২ মাসই দূর বা কাছের কোন না কোন আত্মিয় স্বজনের বিয়ে লেগেই থাকতো। আর ঢাকার আদিবাসিদের বিয়ে মানে এলাহি কান্ডকারখানা। বাসা যত ঘুপচি ঘিঞ্জিই হোক না কেন, পরণে হাল ফ্যাশনের জামা পড়া না থাকুক, অর্থনৈতিক অবস্থা যেমনই থাকুক, বিয়ের সময় বিশাল অর্থ ব্যায়ের ব্যাপারটি থাকতেই হবে। বিশেষ করে খানাপিনার ব্যাপারে যেন এঁকো ফোটা বদনাম না হয়, সে ব্যাপারে তীক্ষ্ম নজর থাকতো।

তাই ঢাকাইয়া বিয়েতে খাওয়া খারাপের ব্যাপারটা খুবই ব্যাতিক্রমি একটি ঘটনা। বাবার ন্যাওটা থাকার সুবাদে যে কোন দাওয়াতে সেই ছোটকাল থেকেই বিভিন্ন বিয়ের দাওয়াত খেতে অভ্যস্থ আমি। কালের বিবর্তনে বিয়ের খাওয়া দাওয়া আসরের হাল্কা চালচিত্র জেনে নিন। এক সময় দস্তরখান বিছিয়ে সেখানে অতিথিদের আপ্যায়নের চল ছিল। সাদা ধপধপা চাদর মাটিতে বিছিয়ে দেয়া হতো।

খাবার প্রাক্কালে প্রথমে অতিথিদের উপর গোলাপদানি থেকে গোলাপ জল ছিটিয়ে দেয়া হতো। এর পর চিলমচি আর বদনায় পানি দিয়ে খুবই সযতনে হাত ধোয়ানো হতো। এর পর সাদা প্লেট পরিবেশন। এর পর বিশাল একটা গামলায় অদ্ভুত মোহনীয় সুগন্ধে ভরপুর সাদা পোলাও এর আগমন। একটা পিরিচে করে পাতে পাতে সেই পোলাও দেয়া হতো।

পোলাও এর গন্ধ এমনই মনহারিনী হতো যে অনেকে তরকারির অপেক্ষা না করেই পোলাও খাওয়া শরু করে দিতেন। পোলাও পিছু পিছু আলু সহযোগে গরুর মাংসের লাল রেজালা উপস্থিত। সবার পাতে পাতে এক টুকরা করে কাগজি লেবু। আর শেষ পাতে ফিরনি অথবা সেরবেরেন। না, ঘাবড়ানোর কিছু নেই।

সেরবেরেন কোন অতি অচেনা কোন মিস্টান্ন নয়। বেশ তরল ফিরনির নামই হচ্ছে সেরবেরেন। তখন প্লেট চামচের বাড়াবাড়ি ছিল না। তাই এটো পাতেই ফিরনি দেয়া হতো। আর হাড্ডি টাড্ডি ফেলা হতো সাদা চাদরের উপরেই।

পরের ব্যাচেকে খাওয়ানোর সময় সেই চাদরটিই ঝেড়ে বিছানো হতো। অবশ্য চাদরের সেই শ্রী আর অক্ষত থাকতো না। ------------------------------------------------------------------ ঢাকা শহরের জনসংখ্যা পাল্লা দিয়ে বাড়ার সাথে সাথে ঘরে বিয়ের অতিথি আপ্যায়নে নিজ নিজ বসতবাড়ির পরিধি বেশ ছোট মনে হতে লাগলো। তাই বাস্তবের প্রয়োজনেই বিভিন্ন স্কুল ভাড়া করে সেখানে অতিথি আপ্যায়ন করার চল শুরু হলো। আর সেই প্রয়োজনেই এক সময় ঢাকার নবাবদের নাটক থিয়েটারের জন্য নির্দিস্ট স্থান শায়েস্তা খান সমাজকল্যাণ কেন্দ্র পরিণত হলো নব্য কমুনিটি সেন্টারে।

এর অবস্থান ওয়াটার ওয়ার্কস রোডে। নামটা বেশ ফিরিঙ্গি। তবে লালবাগ কেল্লা থেকে মাত্র কয়েক মিনিটের হাটা পথ মাত্র। সবেধন নীলমনি হিসাবে সেটাই পুরানো ঢাকার বাসিন্দাদের বিয়ীর অতিথি আপ্যায়নের মুল কেন্দ্র হিসাবে এক সময় গণ্য হতো। এটা যে এক সসময় সিনেমা হল ছিল, সেটা তার নকশা দেখলেই দিব্যি বোঝা যেতো।

উন্মুক্ত মঞ্চ। আর সারি সারি চেয়ার একটা বিশেষ এংগেলে বসানো। সাধারণ সিনেমা হলে যেমনটি থার্ড ক্লাস আর রিয়াল স্টল থাকে। আবার ডিসি মানে দোতলাও ছিল। বিয়ের সময় সেই মঞ্চটিকে বর বসানোর জন্য প্যান্ডেল করে দেয়া হতো।

আর সাম্নের সারি সারি চেয়ারে অতিথিরা খাবার সময়ের জন্য অপেক্ষা করতেন। কমুনিটি সেন্টারের আপ্যায়নের ব্যবস্থার সাথে সাথে খাবার মেনুতেও বেশ পরিবর্তন আসলো। বাবার মুখে শুনেছি, অবস্থাপন্নরা ছোট বড় নির্বিশেষে সবার পাতে আস্ত মুরগির রোস্ট দিতো। পরে অনেক খাবার নষ্ট হবার কারনে এটি শুধু বড়দের দেয়া হতো। ছোটদের জন্য থাকতো একটা অংশ ।

প্রতিদিনের খাবারে বিরিয়ানি খাওয়ার চল থাকাতে, বিরিয়ানি বিয়ের মেনুতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল অনেক পরে। সাধারণত সাদা পোলাও-মুরগির রোস্ট, খাসি বা গরুর ঝাল রেজালা, টিকিয়া(সামি কাবাব), এবং শেষ পাতে মাটির খোরায় ফিরনি বা জর্দা দেয়া হতো। সাথে বোরহানি। আবার অনেকে মোরগ পোলাও টিকিয়া খাসির রেজালা দিয়েও আপ্যায়ন করতেন। বিরিয়ানির সংজ্ঞা অনেকটা বদলে গিয়েছে কিনা জানি না।

তবে বিরিয়ানি খাসির মাংস দিয়ে রান্না করা। গরুর মাংস দিয়ে যা হয় সেটি তেহারি। আর মুরগির মাংস দিয়ে হয় মোরগ পোলাও। এই শায়েস্তা খান সমাজ কল্যাণ সমিতিতে অজস্র দাওয়াত খাবার অভিজ্ঞতা আমার রয়েছে। আর ক্লাস ফাইভে থাকতেই মারামারি করার অভিজ্ঞতার শুরু এখান থেকেই।

-------------------------------------------------------------------------- এর পর সময়ের সাথে সাথে মানুষের সাধ্যে পরিবর্তন আসা শুরু হলো। গরু আর খাসির মাংসের মুল্য বিবেচনা করে অনেকেই মুরগির দিকে ঝুকলেন। তখনও ফার্মের ওমাইনা মুরগির চল শুরু হয়নি। তাই স্বাদ ছিল সেই রকম। মোরগ পোলাও, মুরগির রোস্ট, মুরগির রেজালা, খোরার ফিরনি/কিসমিস-মাওয়া-কুমড়ার মোরব্বা দেয়া অপুর্ব স্বাদের জর্দা , বোরহানি/হাল্কা পানীয়, এই ছিল মেনু।

-------------------------------------------------------------------------- গরু খাসির সাথে সাথে মুরগির দাম ও নাগালের বাইরে চলে যাওয়াতে মেনুরও পরিবর্তন ঘটলো। । সাদা পোলাও, এক পিস করে মুরগির রোস্ট, এক পিস করে টিকিয়া/নার্গিসি কাবাব আর খাসির রেজালা। বোরহানির বদলে কোমল পানীয় আর ছোট পিরিচে এক পিস শশা, এক পিস পনির দেয়া শুরু হল। -------------------------------------------------------------------------- তবে সাধারণ অতিথিদের জন্য মেনু সংক্ষিপ্ত করা গেলেও বরের জন্য যে বিশেষ খাবারের ব্যাবস্থার সংস্কৃতি সেখানে কোন কার্পণ্য হতো না।

তবে কিনা জামাই বাবাজির সাথে বসার সৌভাগ্য অল্প লোকেরই হতো। আমার অনেকবারই সেই অভিজ্ঞতা হয়েছে। আপনাদের একটা প্রশ্ন করি। বিরতীহীনভাবে কত দিন পর্যন্ত আপনারা মোগলাই খাবার খেয়েছেন? বিরতীহীন মানে গড়ে আড়াইবেলা করে। আমার অভিজ্ঞতা হচ্ছে মাত্র ৭ দিনের।

এর পর প্রায় ২ মাস আমি বা আমার পরিবারের কেউ মোগলাই খানা ছুয়েও দেখিনি। আমার মামা নিজেও অবস্থাপন্ন। বেয়াইটিও এক কাঠি সরেস। ভোজন রসিক বলতে যা, দুজনই তাই। তাই মামাতো ভাইয়ের বিয়ের ৭ দিন আগে থেকেই শুরু হল খাওয়ানোর প্রতিযোগিতা।

আর দুই শাসালো পার্টির খপ্পরে পরে, আমাদের মানে বাকি আত্মিয় স্বজনদের ত্রাহি মধুসুদন। এত্ত এত্ত খাবার খাবে কে? শুধু আত্মিয় স্বজনই না পাড়া প্রতিবেশি এবং গরিবদের মধ্যে বিলিয়েও কুল প আওয়া যাচ্ছিল না। তাই পাছে খাবার নষ্ট হয় এই ভয়ে আত্মিয় স্বজনরা ২ থেকে ৩ বেলা করেই মোগলাই খাওয়া গিলতে বাধ্য হতো। মেনুর কথা থাক। শুধু বলি এমন কোন পদ ছিল না, যা সেই ৭ দিন খাওয়া পড়েনি।

মামাতো ভাই আমার চেয়ে অনেক বড় হলেও, দুইজনে অনেক মিল ছিল। মারামারি থেকে শুরু করে বিভিন্ন ইত্রামি দুস্টামি এক সাথেই চলতো। তাই ওর বিয়েতে বরের আমিই ছিলাম মধ্যমণি। সবাই যখন খেতে ব্যাস্ত তখন আলাদা করে বরের খাবার এলো। বিশাল গামলায় মোরগ পোলাও এলো।

পোলাও এর সুউচ্চ মাথায় বসানো আস্তা একটা খাসির রোস্ট। সাথে কম করে হলেও ২৫ থেকে ৩০টা আস্ত মুরগির রোস্ট। টিকিয়ার সংখ্যা অগণিত। সাথে মুরগির রেজালা, খাসির রেজালা, গরুর ঝাল। ফিরনি, জর্দা, দই মিস্টি, বোরহানি, কোমল পানীয়।

সঙ্গি বড় জোর ৮-১০জন। যে খাবার দেয়া হয়েছিল তাতে দিব্যি ৪০-৫০ জন খেতে পারে। কতগুলি টিকিয়া কাবাব খেয়েছিলাম গুনিনি। দুইটা আস্ত মুরগির পেটে চালান করেছিলাম সেটা মনে আছে। খাসির রোস্টের সামনের পায়ের অর্ধেকটা।

আর গরু খাসির মাংসের পরিমান কম না হলেও ১ থেকে ১ ১/২ কেজি। আর মিস্টি জাতিয় জিনিসগুলি সবই চাখতে হয়েছিল। নইলে বেয়াই বেয়াইনরা ছাড়বেই না। এখন তো ফার্মের ওমা মুরগির দিয়ে বড় বড় রোস্ট হয় ঠিকই, কিন্তু দেশি মুরগির সে স্বাদ তাতে কোথায়? হুজুগে অনেকে কাচ্চি বিরিয়ানি করে করে পাগল হলেও, আমার সেটা খুব উপাদেয় মনে হয় না। ===================================== এক সময় বরের সামনে রাংতা মোড়ানো পান সাজিয়ে দেয়া হতো।

একমাত্র বিয়ের আসরেই সেই সুস্বাদু পান খাবার অনুমতি ছিল। ------------------------------------------------------------------------ অজানা কিছু তথ্য জেনে রাখুন। ১) খাবার কমতি পড়ার আশংকা থাকলে, পোলাও এ চিনি মেশানো হয় যাতে কেউ অল্প খেলেই মনপুর্তি হয়ে যায়। ২) বাবুর্চি তার ফর্দের মধ্যে অবশ্যই একটা নতুন গামছা রাখবেই। আর বাবুর্চির ফর্দ অনুসারে হু বুহু বাজার করে দিলে সেখান থেকে উল্লেখযোগ্য পরিনামে মসলা পাচার হবে।

৩) একান্ত নিজের লোক তত্ত্বাবধায়ন না করলে, নতুন খাবারের সাথে এটো খাবার মিশিয়ে পরিবেশনের ঝুকি থাকে। তাছাড়া গামলা গামলা খাবার পাচার করে দিতে পারে বাবুর্চি আর তার সাগরেদরা। ৪) শক্ত লোক না হলে, নামকরা হিসাবে যে বাবুর্চি ভাড়া করা হয়ে থাকে, সে না এসে তার চ্যালাকে পাঠিয়েই দ্বায়িত্ব শেষ করে থাকে। ৫) বিয়ে বাড়ির খাবারে সর্বোচ্চ পরিমান উপকরণ ব্যাবহার করা হয় বলেই, ঘরে বা রেস্তোরার খাবারের চেয়ে বিয়ের খাবার বেশি উপাদেয়। ৬) তবে ওরশ বা মাজারের সিন্নির উদ্দেস্যে যে বিরিয়ানি রান হয়, তার স্বাদ বিয়ের বাড়ির খাবারের চেয়ে কম তো নয়ই, বরং বেশিই হতে পারে।

-------------------------------------------------------------------------- দুপুরের চেয়ে রাতের বিয়ের দাওয়াতই আমি বেশি উপভোগ করে থাকি। ভরপেট খেয়ে বাহারি পোষাকের নতুন আত্মিয়স্বজনদের সাথে গপ্প গুজব হাসি ঠাট্টা শেষে বাড়ি ফিরতে বিয়ের বাড়ির আলো ঝলমল গেটে বাইরে বেড়ুতেই চোখে পড়তো সারি সারি ভুখা নাঙ্গাদের ভীড়। যত রাতই হোক, ওরা অপেক্ষায় থাকতো কখন সবার খাওয়া শেষ হবে। আর ফেলে দেয়া উচ্ছিস্টের একটা অংশ পাতে পড়বে ওদের। কস্ট হতো।

সত্যি ভীষন কস্ট হতো এদের দেখলে। এক রাতের জন্য যেখানে লক্ষ লক্ষ টাকা ফু হয়ে উড়ে যেতে পারে, সেখানে তার এক ভগ্নাংশ দিয়ে হলেও অন্তত যদি এক্ট পরিবারকে এই হাভাতে অবস্থা থেকে বের করে আনা যেতো , তাহলে না কতই ভালো হতো। এজন্যই খাদক হিসাবে গর্বের পাশাশি অনুশোচনাও যে হয় না, এমন নয়। কিন্তু আমি মোটে একটা সামান্য মানুষ। আমাকে দিয়ে কতটুকুই বা সম্ভব? ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.