আমি স্বপ্ন দেখি কিন্তু বাস্তববাদী।
আমরা কার কথা বিশ্বাস করব? স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী, না মাননীয় প্রধানমন্ত্রী?
বিএনপির নেতা ও সাবেক সাংসদ ইলিয়াস আলীর নিখোঁজ হওয়া সম্পর্কে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক বলেছেন, ‘এ ঘটনায় সরকার বিব্রত। ’ বিএনপির নেতারা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীর কাছে গিয়েছিলেন স্মারকলিপি দিতে। তাঁরা ফিরে যাওয়ার পর সাংবাদিকদের কাছে এটা ছিল তাঁর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া।
এর আগে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন আইজিপি খন্দকার হাসান মাহমুদকে নিয়ে ইলিয়াস আলীর বাসায় গিয়েছিলেন তাঁর স্বজনদের সান্ত্বনা দিতে।
তিনি বলেছেন, ‘তাঁকে উদ্ধারে সরকার আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে। ’ তাঁর মতো একজন রাজনীতিকের নিখোঁজ হওয়ার ঘটনায় ব্যক্তিগতভাবে তিনি দুঃখ প্রকাশ করেছেন।
কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বৃহস্পতিবার মুজিবনগর দিবসের আলোচনা সভায় রীতিমতো বোমা ফাটিয়েছেন। বোমাটি হলো, ইলিয়াস আলী দলীয় নেত্রীর নির্দেশে কোথাও লুকিয়ে আছেন। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘বিএনপির এক নেতা নাকি হারিয়ে গেছে।
তাদের আরেক নেতা হারিছ চৌধুরী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় থেকেই হারিয়ে আছে। সেও হারিছ চৌধুরীর মতো লুকিয়ে আছে কি না, কে জানে! আন্দোলনের ইস্যু তৈরি করতে বিরোধীদলীয় নেত্রীর নির্দেশে সে লুকিয়ে থাকতে পারে। ’ (প্রথম আলো, ২০ এপ্রিল ২০১২)।
তাঁর এই বক্তব্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কী বার্তা পাবে? কী বার্তা পাবেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বা প্রতিমন্ত্রী? তাহলে ইলিয়াস আলী সম্পর্কে তাঁরা যা বলেছেন, তা বাতকে বাত কথা? প্রধানমন্ত্রী যেসব কথা বলেছেন ও প্রশ্ন তুলেছেন, তার সঙ্গে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীর বক্তব্য আকাশ-পাতাল ফারাক। বিরোধীদলীয় নেত্রীর নির্দেশে আন্দোলনের ইস্যু তৈরি করতে যদি ইলিয়াস আলী লুকিয়ে থাকেন, তাহলে তো সরকারের বিব্রত হওয়ার কারণ নেই।
কারণ নেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দুঃখ প্রকাশেরও।
দেশের সর্বোচ্চ নির্বাহীর বক্তব্য বিশ্লেষণ করলে আমরা কী পাই? প্রথমত, তিনি দাবি করেছেন, বিরোধীদলীয় নেত্রী আন্দোলনের ইস্যু খুঁজে পাচ্ছেন না বলে দলীয় নেতাকে লুকিয়ে রেখে আন্দোলনের ইস্যু তৈরির চেষ্টা করছেন।
বাংলাদেশে আন্দোলনের ইস্যু বিরোধী দলের তৈরি করতে হয় না। বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের ভাষায়, সব সরকারই ‘স্বউদ্যোগে ও স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে’ বিরোধী দলের হাতে আন্দোলনের ইস্যু তুলে দেয়। অতীতে বিএনপি সরকার দিয়েছে, এখন আওয়ামী লীগ সরকার দিচ্ছে।
দেশে গ্যাস, বিদ্যুতের সংকট চলছে, পানির সংকট চলছে, নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে চলেছে, রেলসহ বিভিন্ন দপ্তরের কালো বিড়াল বেরিয়ে পড়েছে, দু-দুবার ওয়াদা করেও সরকার ঢাকা সিটি করপোরেশনের নির্বাচন করতে পারছে না। দুর্নীতির অভিযোগে পদ্মা সেতুর বিনিয়োগ আটকে আছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে চলছে অচলাবস্থা। মানুষ ঘরে-বাইরে বেঘোরে মারা যাচ্ছে।
এর পরও যদি প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিরোধীদলীয় নেত্রী আন্দোলনের ইস্যু পাচ্ছেন না, সে কথা কেউ বিশ্বাস করবে না।
এক সমুদ্রজয়ের আনন্দ মানুষের নিত্যদিনের দুঃখ-কষ্ট ও বেদনা মুছে দিতে পারবে না।
প্রধানমন্ত্রী কি মনে করেন, বিরোধী দলের তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্বহালের দাবি মানুষ উপেক্ষা করছে? পত্রপত্রিকাগুলো হররোজ মিথ্যা কথা লিখছে? তাহলে সরকারি সংস্থাগুলো দিয়ে একটি জরিপ করে দেখতে পারেন। সংবিধান সংশোধন করার পর সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে মৃত ইস্যু মনে করলেও দেশের অধিকাংশ মানুষ তা মনে করছে না।
ওপরে যেসব ঘটনার কথা উল্লেখ করলাম, তার যেকোনো একটি নিয়েও সরকারের বিরুদ্ধে জোরদার আন্দোলন হতে পারে। বিএনপি পারছে না, সেটা তাদের ব্যর্থতা।
প্রধানমন্ত্রীর এ কথা ভাবার কারণ নেই যে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর যারা ভোট দিয়ে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় এনেছিল, তারা সবাই সরকারের পক্ষে আছে। মোটেই না। আশা করি, ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনেই তার পরীক্ষা হয়ে যাবে।
আমরা বিশ্বাস করতে চাই, প্রধানমন্ত্রী অসত্য বলেননি। তাঁর কাছে নিশ্চয়ই তথ্য-প্রমাণ আছে।
এখন প্রধানমন্ত্রীরই দায়িত্ব হয়ে পড়ে সেই লুকিয়ে থাকা জায়গা থেকে ইলিয়াস আলীকে বের করা। সেই কাজটি করতে পারলে জনগণ প্রধানমন্ত্রীকে দুই কারণে বাহবা দেবে। এক. তিনি নিখোঁজ ইলিয়াস আলীকে খুঁজে বের করেছেন। দুই. তিনি বিএনপির রাজনৈতিক ধাপ্পাবাজির মুখোশটি উন্মোচন করেছেন।
কিন্তু প্রধানমন্ত্রী যদি সেই সম্ভাব্য লুকিয়ে থাকার আস্তানা থেকে ইলিয়াস আলীকে খুঁজে বের করতে না পারেন, তাহলে সব দায়দায়িত্ব কিন্তু তাঁর ও সরকারের ওপর বর্তাবে।
প্রধানমন্ত্রী সব সময় বলেন, স্বজন হারানোর ব্যথা তিনি বোঝেন। রাজনীতিক হিসেবে ইলিয়াস আলী কেমন, ছাত্রনেতা হিসেবে তিনি কী করেছেন, সেই বিশ্লেষণে আমরা যাব না। এমনকি তাঁর বিরুদ্ধে কোন আমলে কয়টি মামলা হয়েছে, এই মুহূর্তে তা-ও বিচার্য নয়। মানুষ চাইবে, নিখোঁজ ইলিয়াসকে সরকার খুঁজে বের করবে। যারা নিখোঁজ করেছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে।
কঠোর শাস্তি দেবে। কিন্তু সেই দুরূহ কাজ করতে না পারলে বিরোধী দলের দাবিই প্রতিষ্ঠিত হবে যে সরকারের লোকেরাই ইলিয়াস আলীকে গুম করেছে।
এই মুহূর্তে ইলিয়াস আলীর স্ত্রী ও সন্তানের মনের কথা ভাবুন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীর বক্তব্যে যদি তাঁরা সামান্য আশার আলো দেখে থাকেন, প্রধানমন্ত্রীর অমিয় বচনে তা কি নিঃশেষ হয়ে যায়নি? রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহীর আসনে থেকে এ ধরনের বক্তব্য দেওয়া কতটা দায়িত্বশীলতার পরিচয়?
রাজনীতিতে মতপার্থক্য থাকবে, থাকবে নীতি ও আদর্শের ভিন্নতা। তাই বলে একটি দল আরেকটি দলের নেতা-নেত্রীদের সম্পর্কে যাচ্ছেতাই কথা বলতে পারেন না, অপমান করতে পারেন না।
ক্ষমতাসীনেরা হয়তো যুক্তি দেখাবেন, বিএনপি ক্ষমতায় থাকতে কী করেছে। তারা তো বিরোধী দলের জনসভায় গ্রেনেড মেরে নেতা-কর্মীদের হত্যা করেছে। সারা দেশে জঙ্গিদের লেলিয়ে দিয়েছে। বিএনপির সেই অগণতান্ত্রিক কর্মকাণ্ডের জন্যই বিগত নির্বাচনে দলটির ভরাডুবি হয়েছে। তাহলে আমরা ধরে নিতে পারি, আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগকেও সেই ভরাডুবির জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।
কেউ ঠেকাতে পারবে না।
প্রধানন্ত্রী বিএনপির রাজনীতি সম্পর্কে আরও অনেক কথা বলেছেন। চট্টগ্রামের বিএনপি নেতা জামাল উদ্দিনের অপহরণের কথা বলেছেন। সেটি আট-নয় বছর আগের কথা। কিন্তু তিনি মহাজোট সরকারের আমলে সাবেক কমিশনার চৌধুরী আলম কিংবা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে যুবলীগের নেতা লিয়াকত হোসেনের অপহরণ সম্পর্কে একটি কথাও বলেননি।
কেন?
লিংক এখানেঃ সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।