পথ্য তো রোগীরও লাগে না ভালো! যদিও এটা তার রোগ সারিয়ে তুলতে সাহায্য করবে,তথাপিও! - নাহ্, কিছু না... অ হ্যাঁ বলছিলাম কি, কৃষ্ণ রাধার ভাগ্নে হল কি করে? এমন ডাহা মিথ্যা কথা কি করে বানাও তুমি?
- সেটাই তো বলতে চাচ্ছিলাম... চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণ কীর্ত্তন এর বৃন্দাবন খণ্ডে পাওয়া যায় :
.............................................
এ তোর নব যৌবনে ল
আহোনিশি জাগে মোর মনে।
তাহাত তোক্ষা রমণে ল
খেতি করে আক্ষার পরাণে\\
.............................................
\\ শ্রীকৃষ্ণ কীর্ত্তন (চণ্ডীদাস বিরচিত) : বৃন্দাবন খণ্ড পৃষ্ঠা-৮৯ \\
(শব্দার্থ : আহোনিশি- অহরহ, তোক্ষা - তোমার, খেতি করে - কর্ষণ করে বা আঘাত করে, আক্ষার - আমার)
অর্থ : "রাধে, তোমার এই নব যৌবনের সুষমা অহরহ আমার মনে জাগিতেছে। তাহাতে আবার তোমার সহিত রমণেচ্ছা প্রবল হইয়া আমার হৃদয়কে অতিমাত্রায় কর্ষণ করিতেছে। " (শ্রীকৃষ্ণ কীর্ত্তন : ভাষাসবর্্বস্ব টীকা-২৫২পৃষ্ঠা)
শ্রীকৃষ্ণ কীর্ত্তনের যমুনা খণ্ডে বলা হয়েছে :
আহা।
গোপীর বসন হার লয়িআঁ দামোদর।
উঠিলা গিআঁ কদম্ব তরুর উপর \\
তথাঁ থাকী ডাক দিআঁ বুইল বনমালী।
কি চাহি বিকল হঅ সকল গোআলী \\১\\
নিকট আইস মোর মরণ সব গোপীগণে।
আজি কথা সুণ মোর মরণ জীবনে \\ধ্রু\\
দেখি[ল] হরষে তা সব গোপযুবতী।
গাছের উপরে কাহ্নাঞিঁ উল্লাসিত মতী \\
হরিআঁ গোপীর হার আঅর বসনে।
হাসে হাসি খলখলি কাহ্নাঞিঁ গরুঅ মনে \\২\\
কুলে পরিধান নাহি দেখি গোপনারী।
হৃদঞঁ জানিল তবে নিলেক মুরারী \\
তবে বড় গল করী বুইল জগন্নাথে।
তোক্ষার বসন হের আক্ষার হাতে \\৩\\
যাবত না উঠিবেঁহে জলের ভিতর।
তাবত বসন নাহি দিব দামোদর \\
এহা জাগী তড়াত উঠিআঁ নেহ বাস।
বাসলী শিবে বন্দী গাইল চণ্ডীদাস\\৪\\
\\ শ্রীকৃষ্ণ কীর্ত্তন : যমুনা খণ্ড \\ পাহাড়ীআরাগ \\ পৃষ্ঠাঃ ১০২\\
- এখানে রাধা-কৃষ্ণের প্রেমের বর্ণনা করা হয়েছে। রাধা তার অষ্টসখিদের নিয়ে পুকুরে স্নান করতে যায়।
সখিরা তাদের নিজ নিজ বসন খুলে বিবস্ত্র হয়ে জলেতে নামিল। বিবস্ত্র হয়ে জলে নামার কথাটা উল্লেখ আছে পরের শ্লোকে। পৃষ্ঠা : ১০৩, ধানুষীরাগ : \\ একতালী\\
.............................................
আল বড়ায়ি
সাত পাঁচ সখিজন লআঁ।
জলেত ণাম্বিলী লাঙ্গট হআঁ \\ল\\
.............................................
\\ শ্রীকৃষ্ণ কীর্ত্তন : যমুনা খন্ড : পৃষ্ঠা : ১০৩ : ধানুষীরাগ :\\
(শব্দার্থঃ কদম্ব তরুর- কদম গাছ, তোক্ষার- তোমার, আক্ষার- আমার, যাবত- যতক্ষণ, উঠিবেঁহে- উঠিয়া আসিবে, জলের ভিতর- জল থেকে, তড়াত- তাড়াতাড়ি করে, বুইল- বলল, দিআঁ- দিয়ে, গিআঁ- গিয়ে, দামোদর - কৃষ্ণ, করী- করে, লআঁ- নিয়ে, ণাম্বিলী- নামিল, লাঙ্গট- উলঙ্গ। )
এখানে, তোক্ষার বসন আক্ষার হাতে \\৩\\
তোমার কাপড় আমার হাতে।
যাবত না উঠিবেঁহে জলের ভিতর।
যতক্ষণ না উঠিয়া আসিবে জল থেকে।
তাবত বসন নাহি দিব দামোদর \\
ততক্ষণ কাপড় নাহি দিবে কৃষ্ণ।
সখিসব স্নান শেষে কূলেতে তাকিয়ে দেখে তাদের পরিধানের বসন নেই। এদিক সেদিক তাকিয়ে দেখে শ্রীকৃষ্ণ তাদের বসনগুলো নিয়ে কদম গাছের ডালে বসে বাঁশি বাজাচ্ছে।
বসন চাইলে কৃষ্ণ তাদেরকে জলের ভিতর থেকে উঠে আসতে বলে। সখিসব বিবস্ত্র অবস্থায় কূলে উঠতে ইতস্ততঃ বোধ করল। কিন্তু না উঠে উপায় কি? যতক্ষণ পর্যন্ত তারা জল থেকে না উঠে আসবে ততক্ষণ পর্যন্ত কৃষ্ণ তাদেরকে বসন ফিরিয়ে দিবে না বলে জানিয়ে দেয়।
কৃষ্ণকে কাহ্ন, কাহ্নাঞিঁ, বনমালী, জগন্নাথ, দামোদর বলা হয়। জাননি না কোনো কারণে পবিত্র দেবতা যিনি সকল ভগবানের স্রষ্টা তাঁর প্রেমের কাহিনী রচনা করেছেন চণ্ডিদাস? ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তো ঐসব গালগপ্প থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত-পবিত্র।
তিনি তো কোনো স্ত্রী গ্রহণ করেননি আবার কোনো সন্তানও জন্ম দেননি। না তাঁর কোনো বংশ আছে না তাঁর কোনো অংশ আছে।
''এই জগতে তাঁহার প্রভু কেহ নাই, নিয়ন্তাও কেহ নাই। এমন কোনোও লিঙ্গ বা চিহ্ন নাই যাহাদ্বারা তাঁহাকে অনুমান করা চলে। তিনি সকলের কারণ; তাঁহার কোনোও জনক বা অধ্যক্ষ নাই।
''
(শ্বেতাশ্বতর উপনিষদঃ অধ্যায়-৬ :৬, শ্লোক- ৯, অতুল চন্দ্র সেন, সীতানাথ তত্ত্বভূষণ ও মহেশচন্দ্র ঘোষ কতর্ৃক সম্পাদিত)
চন্ডিদাস যে কৃষ্ণের প্রেমকাহিনী রচনা করেছেন হয়ত তা অন্য কোনো কৃষ্ণ হবে? যিনি এই পৃথিবীতে জন্ম নিয়ে এমন সব লীলা করেছিলেন। তবে নিশ্চিত ভাবেই বলা চলে, এমন কাহিনী পরমেশ্বর কৃষ্ণের (কৃষ্ণ অর্থ কালো, অন্ধকার, ঘোর-অন্ধকার; অর্থাৎ যাকে দেখা যায় না, না দেখে যার উপর বিশ্বাস স্থাপন করা হয় তিনিই হলেন কৃষ্ণ অর্থাৎ নই যার আকার কোনো কিছুর মতো যা আছে এই বিশ্বচরাচরে 'ন তস্য প্রতিমা অস্তি। ' অর্থ : কাহারও সহিত তাঁহার তুলনাও হয় না। ) জন্য গ্রহণযোগ্য নয়। তাহলে শ্রীকৃষ্ণ কীর্ত্তনে কোনো কৃষ্ণের কথা বলা হয়েছে - এ প্রশ্ন করেছিলাম মাস্টার মশাইকে।
তিনি তো রীতিমতো চেঁচিয়ে উঠে বলেন-কৃষ্ণ আবার দুইটা হলো কোনো দিন থেকে? আমিও বললাম- এমন চিরসত্য কি কেউ অস্বীকার করতে পারে। কৃষ্ণ তো একজনই... কৃষ্ণের তো কোনো অংশ বংশ নেই, তিনি তো বৈসাদৃশ্য, পরমেশ্বরের স্বরূপ ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয়, কেহই ইহাকে চক্ষুদ্বারা দর্শন করিতে পারে না। আমি আর সামনে বাড়লাম না। আশা করছিলাম মাস্টার মশাই হয়ত আরো কিছু বলবেন কিন্তু মাস্টার মশাইও চুপ মেরে গেলেন। আমি তো ভাবলাম যত জোড়ে চেঁচিয়ে উঠেছিলেন হয়ত এবারে মতো মাস্টার মশায়ের কন্ঠস্বরই আলাদা হয়ে গেছে।
কিছুক্ষণ বাদেই বলে উঠলেন, স্রষ্টা তাঁর সৃষ্টিকে উলঙ্গ অবস্থায় দেখলে তোমার সমস্যা কোথায়?
- নাহ্, কোনো সমস্যা নেই... তবে সমস্যাটা দেখা দিবে যদি শ্রীকৃষ্ণ কীর্ত্তনের স্রষ্টা কৃষ্ণ তার কোনো পুরুষ বান্দাকে উলঙ্গ অবস্থায় দেখতে থাকেন আর একবার যদি তা কোনো মাধ্যমে মানুষের কাছে প্রকাশ পেয়ে যায় তখন পশ্চিমা দেশগুলো ভাবতে পারে শ্রীকৃষ্ণ কীর্ত্তনের স্রষ্টা তো 'গে' (সমকামি) হয়ে গেছেন। আর সেই দেখাদেখি যদি পৃথিবীর সব মানুষ সমকামি হয়ে যায় তবে পৃথিবীতে মানুষের বংশ বিস্তার চিরতরে বন্ধ হয়ে যাবে আর এমনিভাবে একদিন পৃথিবী হয়ে যাবে মানুষশূন্য। শ্রীকৃষ্ণ কীর্ত্তনে যে কৃষ্ণের কীর্ত্তন গাওয়া হয়েছে চণ্ডিদাসের গলায় সে কৃষ্ণ কেবলমাত্র নারীদের বিবস্ত্র স্নান দর্শন করিতেছিলেন, কেননা চণ্ডিদাসের বর্ণনায় পাওয়া যায় এ কৃষ্ণ ছিলেন পুরুষ। কিন্তু পরমেশ্বর কৃষ্ণ নারী-পুরুষ লিঙ্গের ঊধের্্ব। তিনি তা থেকে পবিত্র।
এ জগতে তাঁহার তুলনা কোথায়?
শ্রীকৃষ্ণ কীর্ত্তনে যে কৃষ্ণেরই কথায় বলা হোক; তবে চন্ডিদাসের ঐ কৃষ্ণের মতো প্রেমিক আমি হতে চাই না...
- ক্যান... ক্যান...?
- প্রেমের মধ্যে যদি পবিত্রতাই না থাকল, তবে সে প্রেমের মূল্য কোথায় বল? সেখানে তো রাধা একা ছিলেন না, তার অষ্ট সখীগণও বিবস্ত্র অবস্থায় ছিলেন। সেখানেই শেষ নয়? এতক্ষণ যে রাধা-কৃষ্ণের কথা বলছিলাম, তাদের মধ্যে একটা মজার সম্পর্কও আছে। রাধা হল কৃষ্ণের মামী। অর্থাৎ মামা কংসের স্ত্রী হলো রাধা। শ্রীকৃষ্ণ কীর্ত্তন দানখণ্ড : রামগিরীরাগ : পাঠ করলেই রাধা-কৃষ্ণের সম্পর্কটা পরিষ্কার হয়ে যায়।
মাউলানীর যৌবনে কাহ্নের মন।
বিধুমুখে বোলেঁ কাহ্নাঞিঁ মধুর বচন\\
সম্বন্ধ না মানে কাহ্নাঞিঁ মোকে বোলেঁ শালী।
লজ্জা দৃষ্টি হরিল ভাগিনা বনমালী \\
.............................................
দেহ বৈরি হৈল মোকে এরুপ যৌবন।
কাহ্ন লজ্জা হরিল দেখিআঁ মোর তন \\
\\ শ্রীকৃষ্ণ কীর্ত্তনের দানখণ্ড : রামগিরীরাগ : পৃষ্ঠা : ২০ \\
(শব্দার্থঃ মাউলানী- মামী, কাহ্নের- কৃষ্ণের, বোলেঁ- বলে, হরিল- হারাল, বনমালী- কৃষ্ণ, মোকে- আমাকে, দেখিআঁ- দেখে, তন- স্তন। )
এখানে, মাউলানীর (মামীর) যৌবনে কাহ্নে (কৃষ্ণের) মন।
মাউলানী শব্দের অর্থ মামী। অথর্াৎ রাধা হলো কৃষ্ণের মামী। শেষ লাইনে বলা হয়েছে কাহ্ন (কৃষ্ণ) লজ্জা হরিল (হারাল) দেখিআঁ (দেখে) মোর (আমার) তন (স্তন)।
এই যদি হয় প্রেমের উপাখ্যান, তবে এমন প্রেম করার চাইতে আত্মহত্যা করাই ভালো। তাও আবার সাধারণ মানুষের প্রেম হলে এক কথা, এ যে দেবতাদের প্রেমলীলা! এই রূপ নর-নারী যদি প্রেমের দেবতা হয় তবে সাধারণ মানুষ কিসের দেবতা? এমন কাহিনী কি করে ধর্ম গ্রন্থগুলোতে স্থান পায়? এ তো লেখকগণের কল্পনার অতি আদিখ্যেতা ছাড়া কিছুই নয়।
- হায় রাম! এমন কথা বুঝি শাস্ত্রে লিখা থাকে? তোমার মুখে রক্ত উঠবে দেবতাদের অভিশাপে পঁচে যাবে... দোহাই তোমার, অমন কথা আর বল না...
- তা নয় তো কি... একি আমার মুখের কথা? সব তো শাস্ত্রেই আছে, আমি তো শুধু পাঠ করে যাচ্ছি... শুধু কি তাই!
সূত্রঃ "সত্যভূত" , খন্ড-১, লেখক- মোঃ মোস্তাফিজুর রহমান
http://www.oneallah.org/books.php ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।