চোখের দেখা , মনের কল্পনাঃ আমার লেখা বিঃদ্রঃ এই লেখাটি তথাকথিত ধনবানদের ধিক্কারস্বরূপ লেখা হয়েছে যারা অভুক্ত , অসহায় কে উপেক্ষা করে ছোট মানসিকতার পরিচয় দেয় । কোন ধর্মকে বা ধর্মাবলম্বীদেরকে হীন প্রমাণ করার জন্য নয় ।
রবিকান্ত বাবু শহরের একজন নামকরা ব্যবসায়ী । তার ছ-ছটি কাপড়ের দোকান। সকাল হইতে রাত্রি অব্দি লোকজনের আনাগোনা লাগিয়াই থাকে ।
অন্যান্য দোকানের তুলনায় তাহার দোকানে ভিড় বাড়াবাড়ি রকমের বেশী ।
- “সব ভাগবানের কৃপা । তার ইচ্ছাতেই সব হয়েছে । ” বলিতে বলিতে তার স্থূলদেহ মালিশরত ১০ বছরের ছেলেটিকে ঠাশ করিয়া এক চড় বসাইয়া দিলো !
- “গায়ে শক্তি নাই ? এতো আস্তে কেন ? জোরে মালিশ কর । ”
ছেলেটি থতমত খাইয়া প্রাণপণে সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করিতে লাগিলো ।
তাহার মা রবিকান্ত বাবুদের বাড়ি কাজ করিয়া থাকে আর সে এই দোকানের ফাইফরমাশ খাটে ।
১ ঘণ্টা পর রবিকান্ত বাবুর গা ম্যাজম্যাজ ভাবটা কমিলে ছেলেটিকে থামিতে বলিয়া ৫ টাকার একটা নোট ধরাইয়া দিয়া বিদায় হইতে বলিলেন ।
- “মাত্র ৫ টাকা ? অন্তত ২০ টা টেকা দ্যান !”
এই কথা বলার ফলস্বরূপ আরও একটা চড় খাইতে হইল উহাকে । চোখের জল ফেলিতে ফেলিতে বিদায় নিল ।
রবিকান্ত বাবুদের বাড়ি রোজ বৃহস্পতিবার লক্ষ্মীঠাকুরণকে সন্তুস্ট করিবার আয়োজনস্বরূপ ঘটা করিয়া লক্ষীবন্দনা হয়।
ফল-ফলাদি , মিষ্টান্ন এর অভাব থাকেনা । সে দূর হইতে দাঁড়াইয়া দেখে এতো আয়োজন । দাঁড়াইয়াই থাকে । কেহ তাহাকে প্রসাদ দিবার জন্য ডাকেনা । ক্রমে রাত্রি হইয়া যায় ।
সে ক্লান্ত হইয়া বারান্দার কোণে ঘুমাইয়া পড়ে ।
তাহার মা অন্যত্র কাজে ব্যস্ত থাকে । কাজ শেষে আসিয়া সব বুঝিয়া লইয়া চোখের জল ধরিয়া রাখিতে পারেনা ।
এইভাবেই তাহাদের দিন কাটিয়া যায় ।
প্রত্যেক বৎসরের কার্তিক মাসে রবিকান্ত বাবু পরিবারসহ গ্রামের বাড়িতে যায় ।
গ্রামে উহাদের প্রতিষ্ঠিত বিগ্রহ আছে । ধনসম্পদের বৃদ্ধিতে সন্তুষ্ট হইয়া উহারা দেবতাকে সন্তুষ্ট করিতে যায় । যাতে ঘুষ পাইয়া দেবতা তাহাদের আরও দেন এই আশায় ।
পুরো মাস জুড়িয়া প্রত্যহ সকালে পুষ্পান্ন ও বিকালে বৈকালিক ভোগ হয় । চিনিগুড়া চাল , সোনামুগের ডাল , ঘৃত , দুগ্ধ , তরিতরকারি ইত্যাদির যোগাড়যন্ত্র করিবার হিড়িক পড়িয়া যায় ঐ একমাস ।
গ্রামের সম্ভ্রান্ত ভুঁড়িওয়ালা থলথলে দেহের বামুনগণ প্রত্যহ নিমন্ত্রিত হইয়া আসেন এবং আষ্টেপৃষ্ঠে গিলিয়া পান চিবাইতে চিবাইতে বাড়িতে রওনা করেন ।
কাজের ছেলেটা ও তাহার মাও এখানে আসিয়াছে । সে এইরূপ আয়োজন কখনো দেখেনাই । হতবাক হইয়া তাকাইয়া সে বিগ্রহের পূজা দেখে । সেগুন কাঠের সিংহাসন , রূপার মুকুট , সোনার হাতপাট্টা ইত্যাদিতে সুশোভিত বিগ্রহ ।
ধূপধুনার সুবাসে ঘরদোর বিমোহিত ।
তার উপর ভোগের মনমাতানো সুবাস ! তাহার পেট চোঁ চোঁ করিতে থাকে । বাড়ির ছেলেগুলা যখন তখন খাইতে আরম্ভ করে । সে কাছে গেলেই ধাক্কা মারিয়া সরাইয়া দেয় ।
আর রবিকান্ত বাবু ও উহার পরিবার ধনলাভের আশায় সজীব অনাহারী মানুষগুলোকে লাথি মারিয়া নির্জীব পাথরের বিগ্রহকে সেবা করিতে থাকে ।
সে সেবা কোথা যায় তা কে জানে !!
একদিন সন্ধ্যারাত্রে একটা অন্নব্যাঞ্জনপূর্ণ ভোগের থালায় ধুপকাঠির ছাই পড়িয়া গেল । গিন্নীর চিৎকার চেঁচামেচি আরম্ভ হইল । এই ভোগ কোনমতে দেয়া যাইবেনা । তৎক্ষণাৎ ঐ ভোগ বাহিরে কুয়ার পাশে ফেলিয়া নতুন ভোগের ব্যবস্থা করা হইল ।
ছেলেটি সব দেখিল ।
চোখদুটো চকচক করিয়া উঠিয়া তাহার । সে ছুটিয়া গেল কুয়াপাড়ে অন্ধকারে ।
ওদিকে ঠাকুরঘরে রবিকান্ত ও তাহার পত্নী ভক্তিভরে বিগ্রহের সামনে করজোড়ে দাঁড়াইয়া বলিতে লাগিল – “প্রভু , গ্রহন করেছ তো এই কাঙালের ঘরের অন্ন ?”
ছেলেটা গোগ্রাসে কুয়াপাড়ে নিক্ষিপ্ত অন্ন খাইতে লাগিলো । তার আনন্দপরিপূর্ণ মন হইতে একটি কথাই বাহির হইয়া আসিল – “খাইতেছি। ”
ঠাকুরঘরের বিগ্রহ তখনও নির্বাক চাহিয়া আছে আর ভোগের থালাটাও আগের মতই পরিপূর্ণ
আর ছেলেটি সব অন্ন নিঃশেষ করিয়া তৃপ্ত হইয়া ফিরিয়া আসিলো ।
রবিকান্ত কি বুঝিবে , আজই সে কিছু পুণ্য লাভ করিলো ? বুঝিবে ? হয়তো না ।
হয়তো তাহার চেতন হইবেনা এই কথা ভাবিয়া যে মানবচেতনার সেবা করাটাই আসল সেবা ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।