বুকের ভেতর বহু দূরের পথ...
চার্লি চ্যাপলিনকে নিয়ে আমার মুগ্ধতার শেষ নেই। ছেলেবেলায় চ্যাপলিনের মুভিগুলো খাপছাড়াভাবে দেখেছিলাম। তখন তাঁকে নিছক একজন ভাড় বলেই মনে হত। বড়বেলায় এবং বলা যায় অনেকটা দেরীতে চ্যাপলিনের একটার পর একটা ছবি দেখা শুরু করলাম। চ্যাপলিনকে খুঁজতে গিয়ে চমৎকৃত হলাম, মগ্ধতার মাত্রা ছাড়িয়ে গেলো, শ্রদ্ধায় অবনত হলাম বারবার।
তাঁর চলচ্চিত্রগুলো দেখে দর্শক হাসতেই হাসতেই খুঁজে পাবে প্রতিটি মনের গহিনে লুকিয়ে থাকা যন্ত্রণার উপস্থিতি। অট্টহাসির মাঝেই ধরা দেবে রূঢ় বাস্তবতা। হাসিতে হাসিতে দর্শকের পেটে খিল ধরতে না ধরতেই সামনে এসে উপস্থিত হবে যুদ্ধের উন্মত্ততা আর নিষ্ঠুরতা। ভেবে অবাক হই কোন সংলাপ ছাড়াই হাসি-তামাশার মধ্য দিয়ে কত দারুন দারুন বিষয়ই না তিনি অবলীলায় আমাদের মাঝে গেঁথে গেছেন তাঁর সৃষ্টিকর্ম ও শিল্পীসত্তা দিয়ে! স্যালুট!
চ্যাপলিনের জন্মদিনে তাঁর ছয়টি মুভি নিয়ে এই আয়োজন।
The Kid (1921)
চ্যাপলিন প্রযোজিত প্রথম ছবি।
এ ছবিতে চ্যাপলিন হাজির হয়েছেন তাঁর চিরাচরিত ট্র্যাম্প বা ভবঘুরে স্টাইলে। দি ট্র্যাম্প এখানে অনাথ এক শিশুর পালক পিতা! প্রথম অংশে দেখা যাবে বাপ-বেটার খুনসুটি, জোচ্চুরি, নানান কিসিমের অদ্ভূত সব কান্ডকারখানা। আর দ্বিতীয় পর্বে দর্শক আবেগে সিক্ত হবে। এ ছবিতে শিশুটির অভিনয় চোখে লেগে আছে। বাচ্চাটির প্রতিটি মুহূর্তের এক্সপ্রেসন আপ্লুত করে।
বিশেষ করে বাপ-ছেলের বিচ্ছেদের সময় বাচ্চাটির কান্না ও পিতার প্রতি আকুলতা দর্শককে কাঁদাবে।
আইএমডিবি
টরেন্ট
The Gold Rush (1925)
এ ছবিটি তখন নির্মিত যখন টকিজর আগমনী বার্তা আকাশে বাতাসে ধ্বনিত হচ্ছে। চ্যাপলিন একটা খেল দেখালেন। যদিও এটি একটি নির্বাক মুভি কিন্তু নির্বাক মুভিতে সংলাপের পরিবর্তে ব্যবহৃত স্ক্রিনটাইটেল তিনি এ ছবিতে ব্যবহার করলেন না। বরং তার জায়গায় ছবিটিতে তিনি ধারাবিবরনী যোগ করলেন।
ধারাবিবরনীতে তিনি নিজেই কন্ঠ দিলেন। মজার বিষয় ধারাবিবিরণীতে তিনি বিভিন্ন কন্ঠে কথা বলেছেন। আগে থেকে জানা না থাকলে বুঝা যাবেনা পাঠক আসলে একজনই।
আইএমডিবি
টরেন্ট
The Circus (1928)
চ্যাপলিনের ছবির মূলমন্ত্র ভালোবাসার জয়গান। এ ছবিটিও তার ব্যতিক্রম নয়।
এক সার্কাস কন্যার প্রেমে মজে আমাদের ভবঘুরে। কিন্তু প্রিয় মানুষটাকে কাছেও পেয়েও বাস্তবতার কাছে হার মানে আমাদের ভবঘুরে। না! আমাদের ভবঘুরে হারতে পারেনা! ভালোবাসার মানুষটিকে শুধু নিজের করে পেলেই কী তা সার্থকতা লাভ করে? প্রিয় মানুষটিকে আজীবন নি:স্বার্থভাবে উজাড় করে ভালোবাসতে পারাটাই তো সত্যিকারের ভালোবাসা। আমাদের ভবঘুরের আর কিছু না থাকুক আছে বুক ভরা ভালোবাসা। আর যে ভালোবাসতে জানে সে কখনই পরাজিত হয়না, পরাজিত হতে পারেনা।
আইএমডিবি
টরেন্ট
City Lights (1931)
এ ছবিটি নিয়ে বেশি কিছু বলার প্রয়োজন নেই। এটি আমার দেখা চ্যাপলিনের প্রথম চলচ্চিত্র। প্রথম চলচ্চিত্র হিসেবে একদম সঠিক ছবিটি বেছে নিয়েছিলাম এতে কোন সন্দেহ নেই। ভবঘুরে চ্যাপলিন এ ছবিতে একজন প্রেমিক। অন্ধ একটি মেয়ের জন্য যার বুকে লুকিয়ে আছে সত্যিকারের ভালোবাসা।
ভবঘুরেটি ভালোবাসার প্রতিদান দেয় দুর্দান্তভাবে। সর্বকালের সেরা রোমান্টিক ছবির যেকোন তালিকায় এ ছবিটি সব সময়ই উপরের দিকের স্থান দখল করে। অবশ্যই দেখেতে হবে এ ছবি। An Emotional Powerhouse!!!
আইএমডিবি
টরেন্ট
Modern Times (1936)
এটি আমার খুব প্রিয় ছবি। এ ছবিটির কাজগুলো অবাক করার মত।
চল্লিশের দশকে চ্যাপলিন প্রযুক্তির এরকম দুর্দান্ত কাজ কী করে দেখালেন তা ভীষণ আশ্চর্যের ব্যাপার! ছবিটির গভীরতাও দুর্দান্ত। প্রযুক্তির অভাবনীয় সাফল্যে মানুষের জীবন বদলে গেছে। জীবন সহজতর হলেও তা হয়ে পড়ছে যান্ত্রিক। কিন্তু বেঁচে থাকার জন্য আমাদের যন্ত্রের প্রয়োজন নেই, প্রয়োজন ভালোবাসার। ছবিটিতে তৎকালীন সময়ে বিশ্ব অর্থনীতির মন্দা অবস্থা তুলে ধরেছেন চ্যাপলিন।
এমন একটি সময়কে তিনি ফ্রেমে মুলে ধরেছেন যখন অর্থনৈতিক মন্দা ও যান্ত্রিক সভ্যতার বিকাশের কারনে মানুষ চাকরি হারাচ্ছে, পাচ্ছেনা কোন কাজ। বৃহৎ জনগোষ্ঠী ক্ষুধা আর দারিদ্রের তাছে নিজেদের সঁপে দিতে বাধ্য হচ্ছে। এ ছবিটিতে চ্যাপলিন একটি নাচের দৃশ্যে অভিনয় করেন। আমার মনে হয় এটি বিশ্ব চলচ্চিত্রের অন্যতম অর্থবহ কৌতুক দৃশ্য। মজার বিষয় নাচের সঙ্গে চ্যাপলিন নিজেই যে গানটি করছিলেন তা অর্থবোধক ছিলোনা।
প্রতীকি এ অংশটি যেন আমাদেরকে জানান দিচ্ছে বেঁচে থাকার জন্য অর্থহীন কত কিছুতেই না আমাদের জড়িয়ে যেতে হয়। ক্ষুধা আর দারিদ্র্যের নিকট অসহায় মানুষের কাছে যখন টিকে থাকাটই গুরুত্বপূর্ণ তখন কোন কিছুই আর অর্থহীন নয়, নয় অপ্রয়োজনীয় কোন কিছুই । এ অংশটুকুতে চ্যাপলিনের পারফরম্যান্স দেখে পুরাই চক্ষু চড়কগাছ!
আইএমডিবি
টরেন্ট
The Great Dictator (1940)
চ্যাপলিনের সবাক ছবি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে হিটলারকে ব্যঙ্গ করে চলচ্চিত্রটি নির্মিত হয়েছে। দৃর্দান্ত সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছিলেন চ্যাপলিন এ ছবিটি বানিয়ে।
আবারও প্রমাণ করেছিলেন তিনি পর্দার সামনে আসেন দর্শকদের শুধু বিনোদন দিতে নয় । তিনি আসেন দর্মকরে বিবেক হয়ে। ছবিটির শুরু প্রথম বিশ্বযুদ্ধে আর শেষ হয়েছে দ্বিতীয়তীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে। চ্যাপলিন দ্বৈত চরিত্রে অভিনয় করেছেন- ইহুদী নাপিত হয়ে আর ফ্যাসিস্ট রাস্ট্রনায়কের ভূমিকায়। চ্যাপলিন একট স্বপ্ন দেখেছিলেন- সংঘাতমুক্ত সুন্দর পৃথিবীর।
এই ছবিটি তাঁর চিন্ত-চেতনার বহি:প্রকাশ ছিলো। একটি হৃদয়গ্রাহি ভাষণের মধ্য দিয়ে চলচ্চিত্রটি শেষ হয়। পুরো ছবিটির সার্থকতা খুঁজে পাওয়া যাবে এই ভাষণে।
আইএমডিবি
টরেন্ট
চ্যাপলিনকে নিয়ে আমার আরো একটি পোস্ট-
***চার্লি চ্যাপলিন: শুধুই কমেডিয়ান নন, অসামান্য এক বোদ্ধা***
___________________________________________________
উৎসর্গ:
শেখ আমিনুল ইসলাম।
যার হাত ধরে বাংলা ব্লগে চলচ্চিত্র বিষয়ক ইবুকের জন্ম ।
আমার জানামতে চার্লি চ্যাপলিনের একনিষ্ঠ ভক্ত।
অত্যন্ত মেধাবী, নিভৃতচারি, প্রচারবিমুখ এবং সত্যিকারের ভালোমানুষ আমিনুল ভাইয়ের জন্য অনেক অনেক ভালোবাসা।
ভাই, ব্লগে আপনাকে নিয়মিত চাই। অনেক শুভকামনা আপনার জন্য ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।