আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ঘৃণিত এক বিশিষ্টজন

অবয়ব থাকলেই কেউ প্রকৃতপক্ষে মানুষ হয় না। মানুষ হতে হলে তাকে অর্জন করতে হয় সুশিক্ষা। তা মানুষ অর্জন করে পরিবার, সমাজ ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে। রুচিবোধ, নৈতিকতা, মানবিক আচরণ থেকেই একটি মানুষের মানবিক গুণাবলির মাত্রা নির্ধারিত হয়। শুধু উচ্চশিক্ষার সঙ্গে প্রয়োজন বিবেকবোধ ও নৈতিকতার শিক্ষা।

এর অন্যথা হলে শিক্ষিত মানুষও হয়ে যায় অমানুষ, ঘৃণিত পশুর চেয়েও অধম। জ্ঞানতাপস ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বলেছেন, ‘দুর্জন জ্ঞানী হইলেও পরিত্যাজ্য। ’ এ ধরনের এক অধম ও ঘৃণিত ব্যক্তির প্রসঙ্গেই ইকতেদার আহমেদ লিখেছেন ‘তুমি কেন এত ঘৃণিত’ নিবন্ধে। তা দৈনিক আমার দেশ-এ গত ২৭ মার্চ ছাপা হয়েছে। লেখক ইকতেদার আহমেদকে এই তথ্যসমৃদ্ধ নিবন্ধ লেখার জন্য মোবারকবাদ জানাই।

সেইসঙ্গে আমার দেশকেও জানাই অনেক মোবারকবাদ। বাক, ব্যক্তি ও খবরের কাগজের স্বাধীনতার এই দুর্যোগময় সময়ে লেখক ও পত্রিকার সাহসিকতাকে অবশ্যই প্রশংসা করি। ঘৃণিত ওই লোকটি তার প্রায় পৌনে আট মাসের কার্যকালে দেশ ও জনগণের অনেক ক্ষতি করে গেছে। ক্ষমতা ও পদের মোহ যে মানুষকে কত নিচে নামায়, এই লোকটি তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। রঙচটা একটা ব্যাগ নিয়ে ঋণখেলাপিদের পক্ষে তাকে কাজ করতে দেখা গেছে।

ঋণখেলাপিদের আইনের চোখ থেকে আড়াল করার জন্য তার কার্যক্রম কতটুকু নৈতিক ছিল, তা সংশ্লিষ্টরাই বলতে পারবেন। এই ব্যক্তিকে গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়নের উদ্যোগ নেয়া হলে তাতে বাধ সেধেছিলেন তত্কালীন রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমেদ। কিন্তু সে বাধা টেকেনি। অগ্রজপ্রতিম এক সহকর্মী আমাকে তার বাসায় নিয়ে গিয়েছিলেন ২০০৮ সালের বসন্তকালের এক রাতে। তিনি বাসায় ছিলেন না, গ্রিলঘেরা বারান্দায় চেন দিয়ে বাঁধা দুটো বিশালদেহী বিদেশি কুকুর দেখেছিলাম।

জানলাম, তিনি পীরের আস্তানায় গিয়েছেন। প্রতি বৃহস্পতিবারই তিনি সেখানে যান। আমাদের অপেক্ষার পালা শেষ হলো, তিনি এলেন। পাজামা, পাঞ্জাবি ও টুপি—সবই সফেদ। ধার্মিক ভূষণ।

কথাবার্তাও বললেন অনেক। বাংলা ভাষার প্রতি অনেক শ্রদ্ধাবোধ দেখালেন। অনুজপ্রতিম এক আইনজীবী বললেন, উনি খুবই ভালো লোক। টেলিফোনেও কয়েকবার আলাপ হয়েছে। ভাই সম্বোধন ছাড়া কথা বলেন না।

মনে হতো বাংলাদেশ উনার অপেক্ষায়ই আছে। কুকুর প্রভুভক্ত ও বুদ্ধিমান প্রাণী হলেও সে নাপাক; বাড়ির সামনে বড় করে লেখা ‘কুকুর হইতে সাবধান’; আগত মেহমানকে এভাবে সতর্ক করে দেয়া এবং কুকুরের ঘেউ ঘেউ করে তেড়ে আসার দৃশ্য ও শব্দ দিয়ে মেহমানকে সম্ভাষণ জানানো, তার সঙ্গে আবার ধার্মিকতা—এসবই আমার মনে ওই লোকটি সম্পর্কে খটকা ধরিয়ে দেয়। তবুও আমি অগ্রজ ও অনুজকে সরলভাবে বিশ্বাস করেছিলাম। আমার ঘোর কাটতে সময় লেগেছিল। সেদিনটা আমার কাছে অত্যন্ত বিস্ময়ের এবং স্মরণের।

অপরাহেপ্ত একজন কর্মকর্তা ঢাকা থেকে জানাল, ওই লোকটি চেয়ারে বসে প্রথমেই আমার ক্যারিয়ারের ওপর আঘাত করেছেন। সাড়ে চার মাস ধরে যে নিয়োগ কার্যকরণের অপেক্ষায় ছিল, তা তিনি প্রথম দিনেই বাতিল তো করলেনই, সেইসঙ্গে নতুন নিয়োগও অনুমোদন করলেন। ত্বরিত গতিতে তা কার্যকরও হয়ে গেল। তিনি একবারও তুলনামূলক বিচার-বিবেচনা করলেন না। এভাবে আমার ২৮ বছরের চাকরিজীবনের সব অর্জন তিনি ধূলায় মিশিয়ে দিলেন।

আমার মেধা, সততা, সুনাম, কৃচ্ছ্র, বিচারিক দৃঢ়তা, জ্যেষ্ঠতা সবকিছুই ভূলুণ্ঠিত করে দিলেন তিনি। আমি হতবাক। স্বজন, সুহৃদ, শুভানুধ্যায়ী, ভক্তরাসহ কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও বিশ্বাস করতে পারছিল না, এমনটি হতে পারে। পরক্ষণেই তারা সবাই অনুধাবন করল, যাকে তারা ধার্মিক, সজ্জন ও বিবেকবান ভেবেছিলেন, তিনি আসলে মস্ত বড় এক ভণ্ড। লেবাস ধরে তিনি সাধু সেজেছিলেন।

বুঝতে বাকি রইল না, এদেশে মেধা, সততা, সুনাম, কৃচ্ছ্র, বিচারিক দৃঢ়তা, জ্যেষ্ঠতা—সবকিছুই মূল্যহীন হয়ে গেছে, মুখে নীতিকথার ফুলঝুরি ছড়ানো লেবাসধারী ভণ্ডের হাতে সর্বনাশা কার্যক্রম শুরু হয়েছে। তার কাছে মধ্যম সারির পদমর্যাদার কর্মকর্তার মর্যাদা অনেক। যাকে সম্মান শ্রেণী থেকে উত্তীর্ণ হতে পরপর তিন বার পরীক্ষায় অবতীর্ণ হতে হয়েছে, তাতেও শেষ রক্ষা হয়নি; চিকিত্সা মহাবিদ্যালয় ছাত্র-সংসদের সহসভাপতি সুলতান আহমেদকে সঙ্গে নিয়ে শিক্ষকদের দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হয়েছে। ওই লোকটির কাছে এ ধরনের কর্মকর্তারাই মেধাবী এবং যোগ্য বলে বিবেচিত। তার খাসকামড়া এদের জন্য অবারিত।

এদের নিদের্শনামূলক সুপারিশ ওই লোকটির কাছে শিরোধার্য। এসব লোক বিবেকবর্জিত, তাই ঘৃণিত। পদপ্রাপ্তির এক মাসের মধ্যেই মেধাবী, সত্ ও সুনামের অধিকারী কর্মকর্তাদের অসম্মানজনকভাবে বদলির কার্যক্রম শুরু হয়। আমি নিজেও এই তালিকার অন্তর্ভুক্ত ছিলাম। পূর্ববর্তী পদায়নের প্রস্তাব বাতিলের পক্ষকাল পর জেলা ও দায়রা জজ পদ থেকে সরিয়ে আমাকে সমমর্যাদার একটি বিশেষ আদালতে বদলি করা হলো।

সহানুভূতিশীল জিপি ও পিপি সাহেবেরা এতে ব্যথিত হন। তারা ওই লোকটির সমগোত্রীয় বিষয়ে একজন প্রবল ক্ষমতাধর ব্যক্তির কাছে সুপারিশ করলেন, অবমাননাকর বদলির আদেশ সংশোধন করতে। তাদের বলা হয়েছিল, ‘অবমাননাকর কোথায়, তাকে তো জেলা থেকে বিভাগীয় পর্যাযে বদলি করা হয়েছে। ’ বিজ্ঞ দুই জিপি ও পিপিকে আরও বলা হলো, বেশি কথা বললে তাদের জিপি-পিপি পদও বাতিল হয়ে যেতে পারে। আমি দায়িত্বভার হস্তান্তরের দিনেই নতুন কর্মস্থলের পথে রওনা হই এবং পরদিনই নতুন পদে যোগদান করি।

একই আদেশে বদলি করা হয় এমন একজন কর্মকর্তাকে যিনি বিচার বিভাগ পৃথক্করণের কাজে অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন, তার এ অবদান এদেশের বিচার বিভাগের ইতিহাসে চিরস্মরণীয়। পবিত্র রমজান মাসেও যিনি দায়িত্ব পালনের স্বার্থে নিজ খাসকামড়াতেই সাহরি খেয়েছেন, আবার ইফতারিও করেছেন। তাকে অবমাননাকর বদলির সময় এ অবদানকেও মূল্যায়ন করা হয়নি। তিনি এই অবমাননাকর বদলি বাতিলের জন্য নিজের অনুভূতি ব্যক্ত করে পত্র দেন। তার এই পত্রটিকেই পদত্যাগপত্র হিসেবে ওই লোকটি গ্রহণ করেন।

যুগ্ম সচিব পদ থেকেও একজনকে সরিয়ে দেয়ার জন্য ওই লোকটি পত্র দেন এবং তা কার্যকর করা হয় সঙ্গে সঙ্গে। এই যুগ্ম সচিব বিচারিক কাজে অত্যন্ত সততা, দৃঢ়তা, সময়ানুবর্তিতা ও সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন। দফতরে আসতে ৩০ মিনিট বিলম্ব হওয়ায় তিনি ওই দিন ছুটি নিয়েছিলেন। ২০০৭ সালের নভেম্বর মাসের শেষে প্রধান বিচারপতি এম রুহুল আমিন একটি জেলা পরিদর্শনে যান। একজন বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেটের কার্যক্রম দেখে তিনি অভিভূত হন।

জেলা জজের কাছে তিনি তার অভিব্যক্তি ব্যক্ত করে বলেন, নিয়ম থাকলে ওই বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেটকে তিনি জেলা ও দায়রা জজ পদে পদোন্নতি দিয়ে দিতেন। কিছু পরেই ওই বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেটকে ঢাকায় বদলি করা হয়। ওই লোকটির আমলে ওই বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেটকে কাঞ্চনজঙ্ঘার চূড়া দেখা যায় এ ধরনের একটি নতুন জেলায় বদলির উদ্যোগ নেয়া হয়, কারণ এমন কর্মকর্তাকে কিছুতেই ঢাকায় রাখা যাবে না! পরে তাকে বদলি করা হয় সাগরতীরবর্তী একটি নতুন জেলায়। স্বামী ও স্ত্রী দু’জনেই ঢাকাতে সুনামের সঙ্গেই দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। ওই লোকটির কাছে তো এদের কোনো মর্যাদা পাওয়ার কথা নয়।

তাই এই দম্পতিকে ঢাকা থেকে সরিয়ে দেয়া হয় দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের দুটি জেলায়। স্বামী ও স্ত্রীকে একই কর্মস্থলে পদায়নের জন্য সুস্পষ্ট সরকারি নির্দেশনা রয়েছে। কিন্তু এদের বেলায় তা প্রযোজ্য হয়নি। কারণ এদের সততার সুনাম আছে। স্ত্রী ছিলেন সাড়ে সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা।

ওই লোকটি এটা জানার পরও বিবেচনার জন্য উপযুক্ত মনে করেননি। আরেক দম্পতিকে ঢাকায় বদলি করে আনা হয়। স্বামী নিজে নতুন পদে যোগদান করতে পারলেও স্ত্রী যোগদান করতে পারেননি। তার যোগদানের ব্যবস্থা করতে ওই লোকটির ছিল চরম আপত্তি ও অনীহা। ওই লোকটি যতদিন স্বপদে বহাল ছিলেন ততদিন মেয়েটি যোগদান করতে পারেননি।

তাকে দুঃশ্চিন্তায় কাটাতে হয়েছে অনেক দিন। এভাবে তিনি হয়ে পড়ে অসুস্থ। মেধাবীরা যাতে বিচার বিভাগে আসতে না পারে সেজন্য ওই লোকটি প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে গেছেন। বার কাউন্সিলের সনদ নিয়ে বিচারবিভাগীয় পদে ঢুকতে হলে দু’বছর সময় বেশি প্রয়োজন। তাই নতুন প্রজন্ম আইন বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি নিয়েই পুলিশ, জনপ্রশাসনসহ বিভিন্ন চাকরিতে চলে যাচ্ছে।

পাঠক এবার আপনারাই বলুন, এই লোকটি কি মানুষ, তার ভিতর কি মানবিক মূল্যবোধ ও ন্যায়সঙ্গত বিচার-বিবেচনাবোধ আছে? আমাদের চরম দুর্ভাগ্য যে, এ ধরনের লোককেই আমরা সংবিধান ও আইন রক্ষার দায়িত্বে পেয়েছিলাম। পৃথিবীতে অনাচারীরা দাপটের সঙ্গে পদচারণা করেছে বটে, তবে তাদের বরণ করতে হয়েছে করুণ পরিণতি। যুগ-যুগান্তরেও তারা হয়েছে ঘৃণিত। ওই লোকটিকেও সে ধরনের মানুষই মনে হয়। আমার স্নেহময়ী মা প্রায়ই বলতেন, যার এক কান কাটা সে চলে রাস্তার পাশ দিয়ে, যার দু’কান কাটা সে চলে রাস্তার মাঝ দিয়ে।

আল্লাহ বলেছেন, যারা হক ইনসাফ করে না, তারাই জালিম। তাদের জন্য ইহকাল ও পরকালে রয়েছে অনন্ত অভিসম্পাত। আমরা তুচ্ছ মানুষ, ওই লোকটি সম্পর্কে আমাদের আর কীই বা বলার আছে? মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, জালিম শাসকের বিরুদ্ধে হক কথা বলা সর্বোত্তম জেহাদ। রসুলে (সা.)-র উম্মত হিসেবে তাই এই হক কথাগুলো বললাম। লেখক : সাবেক জেলা ও দায়রা জজ ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.