প্রতি বছর আমাদের মাঝে পহেলা বৈশাখ আসে আমাদের এটা মনে করিয়ে দেয়ার জন্য যে, বাংলা সন বলে একটা সন আছে । এই পহেলা বৈশাখ এলে চারিদিকে সাড়া পড়ে যায় । অনেকেই নববর্ষকে বরণ করে নেয়ার জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকেন । বৈশাখ উপলক্ষে ইলিশ মাছের দাম হয়ে যায় আকাশ ছোঁয়া ! সবাই বর্ষবরণ করতে চায় ইলিশ পান্তা খেয়ে । যে পান্তাভাত সারাবছর ছুঁয়েও দেখেনা কেউ, সেই পান্তাভাতের কদর বেড়ে যায় সবার কাছে ! রমনার বটমূলে যাওয়ার জন্য ব্যকুল হয়ে থাকে অনেকেই ।
সবাই পহেলা বৈশাখে বাঙালি সাজতে চায় ! ছেলেরা পাঞ্জাবি আর মেয়েরা শাড়ী পড়ে বৈশাখকে বরণ করতে বের হয় । মিডিয়াগুলোও সীমাহীন উচ্ছ্বাসে বৈশাখ নিয়ে নানা আয়োজন করতে থাকে । আমরা উৎফুল্ল হয়ে গাইতে থাকি- ‘এসো হে বৈশাখ, এসো এসো.........’
আমাদের নিজেস্ব ক্যালেন্ডারের প্রথম দিনকে বরণ করে নেয়ায় আমাদের কোন আপত্তি নেই । কিন্তু বরণ করে নেয়ার পদ্ধতিতে আপত্তি আছে । কারণ বৈশাখ এলে আমরা সবাই একদিনের বাঙালি সাজতে মশগুল হয়ে যাই ।
সারাবছর বাংলা ক্যালেন্ডারের কোন গুরুত্বই আমাদের কাছে থাকেনা, কিন্তু বৈশাখের আগে দিন গণনা শুরু হয়ে যায় চৈত্রের পনেরো দিন বাকি থাকতেই ! সারা বছর বিদেশী পোষাক পরিচ্ছেদের সাথে অতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকি, কিন্তু বোশেখ এলেই পাঞ্জাবি কিংবা শাড়ি পরা আমাদের চাইই চাই ! আর ইলিশ পান্তা না খেলে তো বৈশাখকে বরণ করা হয়ই না আমাদের !
প্রশ্ন জাগে, আমরা যে বৈশাখ এলে পান্তা খাই সে পান্তা কী আমাদের ঐতিহ্যের কোন অংশ ? ইলিশ নাহয় আমাদের জাতীয় মাছ, কিন্তু পান্তা কী আমাদের জাতীয় খাবার যে নববর্ষে আমরা পান্তা খাবো ? আগেকার যুগে যখন ইলেকট্রিসিটি কিংবা ফ্রিজ ছিলোনা তখন ধনী গরীব নির্বিশেষে সবাই রাতে খাবার পর গরমে ভাত নষ্ট হয়ে যাবে বলে ভাত ভিজিয়ে রাখতো । তারপর সকালে সে ভাতকে পান্তা হিসেবে খেতো । আর এই পান্তা এখন হয়ে গেলো আমাদের সংস্কৃতির অংশ ! ছোটবেলায় পড়েছিলাম আমাদের মাছেভাতে বাঙালি হয় । কোথায় দেখিনি যে আমাদের ইলিশ পান্তায় বাঙালি বলা হয় । পান্তা খেলেই যদি বাঙালি সাজা যেতো তাহলে দিনমজুরের চেয়ে বড় বাঙালি কেউ থাকবেনা এদেশে !
এবার আসি পোষাকের কথায় ।
আমাদের অতি আধুনিক মেয়েরা সারাবছর জিন্স, শার্ট, টি শার্ট, টপস, ফতোয়া, স্ক্রিন টাইট সালোয়ার কামিজে ডুবে থাকে । কিন্তু বৈশাখ এলেই শাড়ির প্রতি আকৃষ্ট হয়ে যায়। শাড়ি পরে রমনা বটমূলে না যেতে পারলে বৈশাখটাই তাদের মাটি হয়ে যায় ! যদিও শাড়িতেও তারা আজকাল ফ্যাশন খুঁজে । অনেকেই মশারি মার্কা শাড়ি পরে থাকে গরমের অজুহাতে ! সেদিন একটা পত্রিকায় লাইফস্টাইল পাতায় দেখলাম শাড়ির বৈশাখী কালেকশন । মডেলরা এমন সব শাড়ি পরে আছে, যেগুলোর দিকে তাকালে মনে হয় এরচেয়ে জিন্স টি-শার্ট অনেক ভদ্র পোষাক ! একই অবস্থা ছেলেদের বেলায়ও ।
তারা পাঞ্জাবি-পাজামা কিংবা প্যান্ট পরে বৈশাখ উদযাপন করে । কিন্তু পাঞ্জাবি কী আমাদের জাতীয় পোষাক ? সেটা কে, কখন, কোথায় নির্ধারণ করেছে ? আসলে আমাদের জাতীয় পোষাক কী ? জাতীয় ফল, ফুল, মাছ, পাখি, গাছ থাকলেও আমাদের জাতীয় পোশাক বলে কিছু আছে কী ? একবার এক বিদেশি আমাকে প্রশ্ন করেছিলো- বাংলাদেশের জাতীয় পোষাক কী ? আমি অনেক ভেবেও সেদিন তার প্রশ্নের কোন উত্তর দিতে পারিনি । দেবো কীভাবে ? আমাদের কোন জাতীয় পোষাক আদৌ আছে কী ?
অনেকেই মনে করেন লুঙ্গী পাঞ্জাবি আমাদের জাতীয় পোশাক । কিন্তু যদি তাই হয় তাহলে এই লুঙ্গী পাঞ্জাবি বাংলাদেশের বেশিরভাগ অফিস আদালতেই এলাউ নয় কেন ? আবার নববর্ষ উদযাপন করতে গিয়ে অনেকে পাঞ্জাবি পরলেও সাথে লুঙ্গী পরেনা কেন ? একবার কলামিস্ট ফরহাদ মজহার ঢাকা ক্লাবে লুঙ্গী পাঞ্জাবি পরে ঢুকতে চেয়েও ঢুকতে পারেননি ! তখন উনি (সম্ভবত) প্রশ্ন করেছিলেন, রবীন্দ্রনাথকেও কী তাহলে ঢাকা ক্লাবে ঢুকতে দেয়া হতোনা শুধু লুঙ্গী পাঞ্জাবি পরার কারণে ? মনে প্রশ্ন জাগে, বাংলাদেশের রাজধানীর একটা সম্ভ্রান্ত ক্লাবে যদি দেশীয় পোশাক এলাউ না হয়, তাহলে আর কোথায় রইলো দেশীয় পোশাকের মূল্য ? তাহলে কী লাভ আমাদের এমন একদিনের জন্য বাঙালি সেজে ? যেখানে সারাবছর সারাদেশে দেশীয় পোষাক অবহেলিত, অনাদৃত, যেখানে বাংলা ক্যালেন্ডার সারাবছর কেউ মনে রাখেনা, যেখানে বাঙালি সংস্কৃতির কোন কদর নেই কারো কাছে, যেখানে সবাই হিন্দি আর ইংরেজীতে মশগুল, যেখানে গরিবের পান্তাকে একদিনের জন্য বিলাসিতার খাদ্যদ্রব্য মনে করা হয়, যেখানে সবাই সারাবছর চায়নিজ আর ফাস্টফুডে মত্ত থাকে, যেখানে দেশের বেশিরভাগই মানুষের ইলিশ কেনার সামর্থ্য নেই সেখানে পহেলা বৈশাখে মেকি বাঙালি সাজার কোন মানে হয়না ! অন্তত তাদের নববর্ষ পালনের কোন অধিকার নেই যারা দেশে থেকেও নিজেদের আপাদমস্তক কিংবা মন ও মননকে বিদেশের মধ্যে ডুবিয়ে রাখে । কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, এরাই বৈশাখ নিয়ে বেশি মাতামাতি করে ! এরাই পহেলা বৈশাখকে বরণ করে নিতে নানা আয়োজনে নিমগ্ন হয়ে যায় !
অনেক আগে কোথায় যেন একটা কৌ্তুক পড়েছিলাম ।
এক বন্ধু আরেক বন্ধুকে বলছে- দোস্ত, আজ পহেলা বৈশাখ । আজ সারাদিন শুদ্ধ বাংলায় কথা বলবো । পাঞ্জাবি পাজামা পরে রমনা বটমূলে যাবো । তারপর মঙ্গল শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণ করবো । তারপর দুপুরে ইলিশ পান্তা দিয়ে লাঞ্চ করবো ।
এরপর সিনেমা হলে গিয়ে একটা খাঁটি বাংলা সিনেমা দেখবো । সন্ধায় প্রেমিকার সাথে দেখা করে প্রেমিকাকে একটা খাঁটি বাংলাদেশী পণ্য উপহার দেবো । আর রাতে ? বন্ধু প্রশ্ন করলো, রাতে কী করবি ? রাতে বাংলা মদ খেয়ে বাসায় ফিরবো ।
আমাদের অবস্থাও কি হয়েছে ঐ বন্ধুর মত ? যদি নাই হয়, তাহলে এই বৈশাখ থেকেই প্রতিজ্ঞা করা উচিত আমরা একদিনের বাঙালি হবোনা । আজ থেকে সারাবছরের জন্য, সারাজীবনের জন্য প্রকৃত দেশপ্রেমিক বাঙালি হয়ে যাবো ।
তাহলেই আমাদের বৈশাখ, আমাদের নববর্ষ উদযাপনটা হবে অর্থবহ ও প্রকৃত আনন্দময় । সবাইকে নববর্ষের শুভেচ্ছা ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।