আজ অব্দি রয়ে গেলাম আগাগোড়া গ্রাম্য মেয়ে... ...
প্রতিটি সকালেই এক চিত্র । অফিসে দেরি। হবে না!! বাসা থেকে বের হয়ে রিক্স্বা পাই না। সব রিক্স্বাওয়ালা নাকি ধান কাটতে গ্রামে চলে গেছে। প্রতিদিনই ইচ্ছে হয় আমিও যাই।
এক সময় যেমন যেতাম ।
আমি শৈশবে হাওড়ে যেতাম । ধান কাটতে না কুড়াতে। নিতান্তই শখের বশে নয় ভয়ংকর অভাবের যন্ত্রণায় । সেইবার আমার বাবা হুট করেই চাকরি খোয়ালেন ।
ঘরে খাবার নেই। মাসের মাস চলে যায় আব্বার টাকা পাঠানোর খবর নেই। আম্মা অসহায় আমাদের দুটি বোন কে নিয়ে। খুব কাছের যারা বিষয়টা টের পেল তারা ক্ষুদ(ভাঙ্গা চাল) দিয়ে যেত। আমরা কোনদিন একবেলা খেয়ে কোন দিন না খেয়ে দিন কাটাতে লাগলাম।
দুপুরবেলা খিদে বেড়ে গেলে দু'বন গলাগলি করে আব্বার নাম ধরে কাঁদতাম। পাশের জঙ্গল থেকে কোচর ভরতি করে পানিফল আর কালজাম নিয়ে আসতাম খাওয়ার জন্য। আম্মা খেত না। পানি খেত। খুব বড় ঘরের মেয়ে বলে লজ্জায় কাউকে অভাবের কথা বলত না।
আমরাও আম্মাকে ভয় পেয়ে কাউকে কিচ্ছু বলতাম না।
দেখতে দেখতে ধান কাটার সময় এল। দাদার বিশাল বাড়িটিতে কয়েক ঘর আশ্রিত ছিল। খুব ভোরে পান্তা নিয়ে ওঁরা হাওড়ে যেত । পুরুষরা ধান কাটতে আর মহিলা - বাচ্চারা ধান কোড়াতে ।
আমি তখন ক্লাস থ্রিতে পড়ি । আমার স্কুল শুরু হয় বারোটায়। তাই সেই হাওড় যাত্রী দের দলে ভিড়লাম । আমাদের ঘরে পান্তা থাকত না। আমি যেতাম পলিথিনে লবন নিয়ে।
আমাদের বাড়ি থেকে হাওড় ছিল অনেক দূরে। কত্ত সেতা জানি না। ছোট বেলায় মাপতে পারতাম না। শুধু দুপুরে ভাত পাব এই লোভে মাইলের পর মাইল হাঁটতাম । মাঝ পথে আম গাছ পেলেই ঢিল ছুড়তাম ।
আম খেতাম লবন দিয়ে। ইশ কত্ত মজা।
সূর্য মামা জাগার আগেই পৌঁছে যেতাম হাওড়ে। পুরুষরা ধান কাটত আটি হিসেবে। আর আমরা ধান কোড়াতাম যত পারি।
সূর্যের তেজ কড়া হলেই সবাই পান্তা খেতে বসত টিলার উপরে। হাওড়ে যারা যান নি তাদের বলছি সেখানে মাঝে মাঝেই টিলার মত জায়গা পাবেন যেখানে ধান শুকানো হয়। টিলার পাশেই থাকত ডোবা । পান্তা খেয়ে সেই ডোবার জল খাওয়া হত পেট ভরে । তারপর আবার ধান কাটা, ধান কোড়ানু।
মাঝ দুপুর হবার আগেই আবার বাড়ি ফেরা। কাঁধে পাকা সোনালী ধান। মিষ্টি গন্ধে পেতের খিদেতা মাথা চাড়া দিয়ে উঠত । আম্মা বাড়ির সামনে এসে দাড়িয়ে থাকত স্কুলের বই নিয়ে। আম্মার কাঁধে ধান দিয়ে বই নিয়ে দৌড় দিতাম স্কুলে।
হেটে গেলে পনের মিনিট । দৌড় গেলে এক নিঃশ্বাস । স্কুলের পাশেই মাদ্রাসার পেছনে মস্ত পুকুর। পুকুরে ডুব দিয়েই ছাত্রী হয়ে যেতাম। ক্লাস এ রোল এক হওয়ায় দেরি হইলেও বকা খাইতাম না।
স্কুল ড্রেস ছিল কিনা জানি না তবে আমার ছিল না।
এইভাবে তিন বছর। আব্বা ততদিনে আবার গুছিয়ে নিয়েছেন সব। একটা রিক্স্বা সবসময় ঘরের দোরগোঁড়ায় দাড়িয়ে থাকে। আব্বার বড় মেয়েটি বের হলেই সে নিয়ে যাবে এই রকম একটা নির্দেশ সে পেয়েছে।
আমার সুখ হজম হয় না। আমি পেছনের দরজা দিয়ে দৌড় দেই স্কুলে। তবে আর কোনদিন হাওড়ে যাই নি। বেড়াতেও না। লঞ্চে করে যেদিন জেলা শহরে যাই সেদিন হাওরের মাঝ দিয়ে যাই।
বুকের ভিতরটায় চিনচিন করে। কথা বলতে পারি না। তাকিয়ে থাকি।
আমার সব চেয়ে ছোট বোনটা এইবার থ্রি পাশ করেছে। আবার স্কুল ড্রেস চেয়েছে।
শহরের নামী স্কুল বলে কথা। আব্বা প্রতি দিন টাকা দেয় রিক্স্বা করে স্কুল যেতে। সে হেটে যায়। বলে " বড়পা'র মত করে পড়বে । আমার হাসি পায়।
আবার বুকের ভিতরটায় চিনচিন করে। কথা বলতে পারি না। তাকিয়ে থাকি।
অফিসে ছুটি নেই তাই বাড়ি যেতে পারি না। একটু আগে গ্রাম থেকে অনেক আম এসেছে।
কাকারা, মামারা কুরিয়ার করেছে। হাসি পেল। আবার বুকের ভিতরটায় চিনচিন করে উঠল । কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। তাকিয়ে আছি।
গ্রামে যেতে ইচ্ছে করছে, হাওড়ে, শৈশবের হাওড়ে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।