হরিষে বিষাদ পাহাড়ে বসবাসরত উপজাতিদের প্রধান সামাজিক উৎসব ‘বৈসাবি’। আগামী ১৪ এপ্রিল আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হতে যাচ্ছে এ বৈসাবি উৎসব। এখন এ উৎসবকে ঘিরে পাহাড়ি পল্লীগুলোর ঘরে ঘরে চলছে ব্যাপক প্রস্তুতি ও উৎসবের আমেজ।
উৎসবের দিনগুলোতে পাহাড়ী বাঙ্গালীর স¤প্রীতির এক মিলনমেলা হয়ে উঠবে। ইতোমধ্যে এলাকা ভিত্তিক নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছে উৎসবকে বরণ করে নেওয়ার যাবতীয় আয়োজন।
বান্দরবানের উপজাতিয় চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরা স¤প্রদায় বর্ষবরণকে একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎসব হিসেবে পালন করে থাকেন। ১৯৮৫ সাল থেকে পাহাড়ে বসবাসরত বিভিন্ন সংগঠনের সম্মিলিত উদ্যোগে ‘বৈসাবি’ নামে এ উৎসব পালন করে আসছে। যা সময়ের ব্যবধানে নিজ নিজ স¤প্রদায়ের লোকদের কাছে ‘বৈসাবি’ শব্দটি জনপ্রিয় হয়ে উঠে। এ উৎসবকে সামনে রেখে জেলার হাট-বাজারে কেনা-কাটা বেড়েছে। বিপনী বিতানগুলোতে পাহাড়িদের তরুন-তরুনীদের উপচে পড়া ভীড়।
বর্ষবরণ ও বিদায় উৎসবকে ত্রিপুরা স¤প্রদায় ‘বৈসুক’, মারমা স¤প্রদায় ‘সাংগ্রাই’ এবং চাকমা স¤প্রদায় ‘বিজু’ নামে এ উৎসব পালন করে থাকেন। একত্রে তিনটি আদ্যার নিয়ে বৈ-সা-বি বলে পাহাড়ে এই উৎসব পরিচিত। চৈত্রের শেষ দিনের আগের দিনকে বলা হয় ফুল বিজু। এদিনে ফুল দিয়ে ঘরবাড়ি সাজানো হয়। দ্বিতীয় দিন চৈত্র সংক্রান্ত ‘বৈসাবি’ অথবা মূল বিজু।
এদিনকে উৎসবের প্রধান দিন ধরে নেয় চাকমারা। ত্রিপুরা ও মারমারা এদিন পালন করলেও তাদের জন্য ১ বৈশাখ হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ দিন।
মূল বিজুর সবচেয়ে আকর্ষণীয় হচ্ছে ‘পাচন’ (অনেক রকমের শাক-সবজি, ফল মুলের সমন্বয়ে রান্না করা তরকারি)। এই পাচনে যে যত পদের সবজি মেশাতে পারবে তার গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি। এদিন নতুন কাপড় পরে বাড়ি বাড়ি বেড়ানো, পাজন খাওয়া চাকমাদের আনন্দ উদ্যাপনের মূল আয়োজন।
চাকমাদের মধ্যে প্রচলিত আছে যে, বিজুর দিন কমপে পাঁচ বাড়িতে বেড়াতে হবে। এসব বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে পাচন খেলে পরবর্তী তিন মাস কোন রোগ ব্যাধিতে আক্রান্ত হবেনা কেউ। পাচনের সঙ্গে ভাত থেকে তৈরি পানীয় অর্থাৎ দো-চুয়ানী (বাংলা মদ)। এই দো-চুয়ানী ছাড়া চাকমা সমাজে বিজু, বিয়ের অনুষ্ঠান কখনও সম্পন্ন হয়না। এই রীতি এখানে প্রচলিত।
আর এই দিন বাংলা মদ খেতে কোন বাধা নেই।
ত্রিপুরা সম্প্রদায় এদিন উদ্যাপন করে তাদের ঐতিহ্যবাহী বিশেষ নাচের মাধ্যমে। যার নাম ‘গড়াইয়্যা নৃত্য’। নারী পুরুষ সবাই এক সঙ্গে নাচে। এ নাচের বিশেষত্ব হচ্ছে, যে বাড়ি থেকে এ নাচ শুরু হবে সে বাড়িতেই এসে নাচ শেষ করতে হবে।
ত্রিপুরাদের এই উৎসবকে ‘বৈসুক’ বলে।
মারমা স¤প্রদায় ১ বৈশাখ পালন করে বর্ণিল জলকেলী বা পানি উৎসবের মধ্য দিয়ে। পুরনো বছরের সব দুঃখ হতাশাকে মুছে ফেলার জন্য জল ছিটানো উৎসব (পানি খেলা)। যা মারমা স¤প্রদায়ের ‘সাংগ্রাই’ উৎসব নামে পরিচিত। অবশ্য আধুনিকতার ছোঁয়ায় চাকমাদের সাংগ্রাই উৎসবের নাম এখন ‘ওয়াটার ফেষ্টিভ্যাল’ রাখা হয়েছে।
নারী-পুরুষ মারমা গানের তালে তালে একে অপরকে পানি ছিটিয়ে একে অপরকে জলে টইটুম্বুর করে ভেজানোর প্রতিযোগিতা করেন। এই জলকেলির মাধ্যমে মারমা তরুন-তরুনী একে অপরের মাঝে ভালোবাসার বিনিময় করেন।
একইভাবে ত্রিপুরা, বম, পাংখোয়া স¤প্রদায়গুলোও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও নিজস্ব খাবারের আয়োজন করেছে। বৈসাবি উৎসবকে ঘিরে পাড়ায় পাড়ায় নানা খেলাধুলার আয়োজন করা হয়েছে। এসব খেলার মধ্যে রয়েছে ঘিলাখেলা, নাদেরখেলা, বলিখেলা, ফোরখেলা, পুত্তিখেলা ও তুমুরো খেলা এবং তৈলাক্ত বাঁশ বেয়ে উপরে উঠা।
১লা বৈশাখের দিন স্থানীয় এনজিও লুপি স্টারের উদ্যোগে বৌদ্ধ মন্দিরগুলোতে বৌদ্ধ স্নান করা হবে। ১৪ এপ্রিল থেকে চার দিনের বর্ণাঢ্য কর্মসূচী গ্রহণ করা হয়েছে। শান্তিপূর্ণ বৈসাবি উৎসর পালনের মধ্য দিয়ে পাহাড়ী-বাঙ্গালীর মধ্যে শান্তি-সম্প্রীতি ও ঐক্য আরো সুদৃঢ় হোক এই প্রত্যাশা এখন সকলের। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।