জার্মানির বন শহর থেকে ক্যোয়িনিগ্সভিন্টার প্রায় বার কিলোমিটার দূরে অবস্থিত৷ সাত পাহাড়ে ঘেরা অপরূপ সুন্দর এই গ্রাম৷ গ্রামের পাশেই রাইন নদী বয়ে চলেছে৷ রাইনের জলে মিশে আছে হাজার বছরের ইতিহাস
ক্যোয়িনিগ্সভিন্টার গ্রামের একপাশে সাতপাহাড়ের উপর একটা ভাঙ্গা প্রাসাদ কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে৷ সাতপাহাড়ের একটি পাহাড়ের নাম ‘দ্রাখেনফেল্স' বা ড্রাগন পাহাড়ে'৷ সাত পাহাড় নাম হলেও এখানে পাহাড় আছে ৪০টিরও বেশি৷‘দ্রাখেনফেল্স' বা ড্রাগনের পাহাড় নামটি কেন? এই উত্তর খুঁজতে গিয়ে জানতে পারলাম, ‘দ্রাখেনফেল্স'-এর গুহায় একটি ড্রাগন বাস করতো৷ চারিদিকে অসাধারণ সবুজ৷ সিগফ্রিড নামে একজন লোককাহিনীর নায়ক সেই ড্রাগনটিকে মেরে ফেলে৷ তখন থেকে এই পাহাড়টির নাম ‘দ্রাখেনফেল্স'৷ ক্যোয়িনিগ্সভিন্টার গ্রামের দাদুরা এখনো খুব মজা করে এই গল্পটি বলেন তার নাতি-পুতিদের।
শুরু হলো আমার অভিযান
আমার ঘর থেকে এই পাহাড়ের চূড়াটি দেখা যায়৷ কি যে সবুজ সুন্দর পাহাড়, মন জুড়িয়ে যায়৷ আমি ভাবি কবে যাবো ঐ মেঘপাহাড়ের কোলে! কিভাবে দেখবো এই সাত পাহাড়, সারাক্ষণ শুধু এই কথাই ভাবছি৷ একদিন সাহস করে পৌঁছে যাই সাত পাহাড়ের কাছে৷
সেদিন বিকেল৷ হালকা হাওয়া৷ রোদের ঝিকিমিকি রাইন নদীতে৷ উঁচু পাহাড় আমাকে ডাকছে৷ আমি যাচ্ছি সেই পাহাড়ে৷ কিন্তু হেটে কি উঠতে পারবো? তাহলে যেতে হবে ট্রেনে৷ ড্রাগন পাহাড়ের কাছে ১২৬ বছরের পুরোনো রেল স্টেশন রয়েছে৷ এটি জার্মানির নর্থ-রাইন ওয়েষ্টফালিয়ার সবচেয়ে পুরানো ট্রেন-স্টেশন৷ পাহাড়ে ওঠার জন্য এই বিশেষ ট্রেনটি চালু করা হয় ১৮৮৩ সালে৷ ট্রেন লাইনটির দৈর্ঘ্য ১.৫ কিলোমিটার৷ বর্তমানে এটি বিদ্যুত চালিত ট্রেন৷ জানতে পারি ১৯৫৮ সালে এই ট্রেনটির ইঞ্জিনের বাষ্প শেষ হয়ে ১৭জন মানুষ মারা গিয়েছিল৷ ঐ ষ্টেশন থেকে ট্রেনে উঠে পৌঁছে গেলাম দ্রাখেনফেল্সের চূড়ায়৷ ঠিক চূড়ায় বললে ভুল হবে৷ বর্তমানে এটি বিদ্যুত চালিত ট্রেন৷চূড়া থেকে একটু নীচে, ট্রেনটির শেষ স্টেশনে৷ এরপর পাহাড়ী পথ ধরে উঠে যাই চূড়ায়৷
এ এক অন্যরকম সবুজ
কোথায় এলাম আমি! চারিদিকে অসাধারণ সবুজ৷ অপূর্ব নৈসর্গিক দৃশ্য৷ আলোর চেয়েও উজ্জ্বল আলো ছড়িয়ে পড়ছে চতুর্দিকে৷ অদ্ভুত এক শীতল বাতাস ভাসিয়ে নিয়ে গেল পাহাড়ে উঠার সমস্ত ক্লান্তি৷ দূরের রাইন নদীতে অসংখ্য জাহাজ ভাসছে৷ চূড়ায় একটি স্থান আছে যার চারদিকে টেলিস্কোপ বসানো৷ টেলিস্কোপে এক ইউরো ফেললে নাকি দূর-দূরান্তের দৃশ্য চোখের সামনে চলে আসে৷ শুনলাম কোলন ডোম নাকি দেখা যায় সেখান থেকে৷ লোভ সামলাতে পারলাম না৷ দূরবীনে এক ইউরো ঢেলে দিলাম৷ দূরবীনে চোখ লাগানোর সঙ্গে সঙ্গে দেখতে পেলাম কোলন ডোম৷ যেন কিছু দূর হেটে গেলেই সেখানে যাওয়া যাবে৷ দেখলাম, দূরের ছোট ছোট জাহাজগুলো আসলে কত বড়৷ শুধু রঙ, অবিরল অপার্থিব রঙয়ের ঝর্ণায় যেন বারে বারে রঙিন স্নানে স্নাত হচ্ছে ড্রাগনের পাহাড়৷ ড্রাগন পাহাড়ের উচ্চতা ৩২১ মিটার৷
পায়ে হাটা পথ...
এরপর পায়ে হেটে নামতে শুরু করি৷ নেমে আসার সময় চোখ পড়ে পাহাড়টির মৌমাছির বাগানে৷ সারি সাজানো মৌমাছির বাসা৷ সেখান থেকে বিশুদ্ধ মধু সংগ্রহ করা হয়৷ এরপর কিছুদূর চলার পর সেই বিখ্যাত প্রাসাদ৷ ২০০৩ সালে প্রাসাদটিকে পুনর্নির্মাণ করা হয়৷ প্রাসাদটি বর্তমানে একটি জাদুঘর৷ যেখানে আছে অনেক প্রাচীন ইতিহাস৷ জাদুঘরটিতে রাইন নদীকে ঘিরে যেসব কল্পকাহিনী আছে তাও সংরক্ষণ করা হয়েছে৷ সংরক্ষণ করা হয়েছে, জার্মান বীরদের লোকগাথা৷
পাহাড়ের মানুষ, মানুষের পাহাড়
পাহাড়ের ওপর কিছু সৌখিন মানুষ বাড়ি তৈরি করেছেন৷ পাহাড়ী পথে আছে অনেক রেষ্টুরেন্ট৷ যে কেউ বিশ্রাম নিতে পারে সেখানে৷ তবে শর্ত হলো, সেখান থেকে কিছু খাবার বা পানীয় গ্রহণ করতে হবে৷ তবে পাহাড়ী পথের এধার ওধারে রয়েছে অনেক বসার চেয়ার৷ যেখানে বসে পাহাড়ের অদূরের মনোরম দৃশ্য উপভোগ করা যায়৷
তাহলে বিদায়
এক সময় শেষ হয়ে যায় আমার চলার পথ৷ এবার ঘরে ফেরার পালা৷ বাড়ির পথ ধরি৷ জার্মান সাম্রাজ্য, প্রকৃতির রূপ ও রূপকথার এক নিত্য নতুন সংজ্ঞা মনের মধ্যে নিয়ে ‘দ্রাখেনফেল্স'কে বিদায় জানাই, আউফভিদারজেন, আবার দেখা হবে৷
ফারজানা কবীর খান
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।