বৃষ্টি যেরকম আসতে আসতে ফিরে যায়..তেমনি বৃষ্টির মতো আমিও ফিরেছি বহুবার...
পার্বত্য জেলা রাঙামাটির শিক্ষা ব্যবস্থায় নানা সংকট দীর্ঘদিনের। নানা সভা-সেমিনার,দাবী দাওয়ায় বারবার এইসব সমস্যা নিয়ে আলোচনা হলেও সমস্যা সমাধানে নেই কোন কার্যকর উদ্যোগ। কি প্রাথমিক শিক্ষা,কি মাধ্যমিক বা উচ্চ মাধ্যমিক সমস্যা সর্বত্র। নানা সমস্যার কারণে জেলার শিক্ষার হার ৩৬.৪৮% শতাংশ হলেও পুরুষের (৪৫.৮২%) তুলনায় বেশ পিছিয়ে আছে নারীরা (২৪.৬৮%)।
জেলার সর্বত্র জালের মতো ছড়িয়ে আছে ৫১৮টি প্রাথমিক বিদ্যালয়।
এর মধ্যে ৩৯১ টি সরকারী আর ১২৭ টি বেসরকারী। কিন্তু এইসব বিদ্যালয়ে নেই পর্যাপ্ত শিক্ষক,অবকাঠামো। রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের কাছে হস্তান্তরিত এই প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগে শিক্ষক নিয়োগ প্রায় নিয়মিতভাবে হলেও নিয়োগে অনিয়ম,দলীয়করন,অযোগ্যদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগের কারণে ভেঙ্গে পড়েছে পুরো জেলার প্রাথমিক শিক্ষা। আবার দুর্গম আদিবাসী এলাকায় শিশুদের মাতৃভাষায় পাঠদানেও নেই কোন প্রয়োজনীয় উদ্যোগ। এনিয়ে সরকারী-বেসরকারী উদ্যোগ এখনো সভাসেমিনারেই আবদ্ধ।
পাহাড়ে প্রাথমিক শিক্ষার আরেক বড় সমস্যা ‘বর্গা শিক্ষক’। এতে নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষক নিজে মাসে একবার স্কুলে গিয়ে বেতন নিয়ে আসেন আর পুরো মাস স্কুলে ক্লাস নেন তারই নিয়োগ দেয়া ওই এলাকারই অর্ধশিক্ষিত কোন যুবক। এই ‘বর্গা শিক্ষক’ সমস্যা সমাধানে বিভিন্ন সময় নানা উদ্যোগ নেয়া হলেও তা সফল হয়নি। আবার দূর্গম এলাকার স্কুলগুলোতে যোগাযোগ সমস্যার কারণে স্কুলে কেবল শিক্ষার্থীদের যাওয়াই অসাধ্য নয়,শিক্ষকদেরও সংকট পোহাতে হয়। আবার প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগে যে পরিমাণ জনবল দরকার তাও নেই।
এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে জেলার ৫১৮ টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৮২,৮৬৭ জন শিক্ষার্থীর জন্য শিক্ষক আছে মাত্র ১১০৬ জন,যা নিতান্তই অপ্রতুল।
মাধ্যমিক পর্যায়ে পুরো জেলায় সরকারী হাই স্কুল মাত্র ৬ টি,আর বেসরকারী হাই স্কুল ৪৮ টি। বেশিরভাগ উপজেলাতেই নেই সরকারী মাধ্যমিক বিদ্যালয়। আবার উপজেলা পর্যায়ে যে সরকারী হাইস্কুলগুলো আছে তাতেও নেই প্রয়োজনমতো শিক্ষক,কর্মচারী বা অবকাঠামো। ফলে দিনের দিনের পর শিক্ষক শূণ্যতা আর নানান সংকটের খবর পত্রিকার পাতায় এলেও তা নিয়ে সাড়া নেই কর্তৃপক্ষের।
জেলার লংগদু সরকারী হাই স্কুল,জুড়াছড়ির ভুবনজয় সরকারী উচ্চ বিদ্যালয় এর অবস্থা কতটা নাজুক তা না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। বেসরকারী হাই স্কুলগুলোর কথা বলাই বাহুল্য। পুরো জেলায় এমপিও ভুক্তির যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও অজ্ঞাত কারণে এমপিও হতে পারছেনা অনেকগুলো হাইস্কুল । সর্বশেষ এমপিও ভূক্তিকালেও পুরো জেলায় মাত্র ৩টি হাই স্কুল এমপিও ভূক্ত হওয়ায় ক্ষুদ্ধ হয়েছিলেন জেলার শিক্ষাবিদরাও। পাহাড়ে অন্তত: আরো বিশটি হাই স্কুল এমপিও ভূক্তির যোগ্যতা রাখে বলে জানিয়েছেন বেশ কয়েকজন শিক্ষক নেতা।
পুরো জেলায় যে ৪৫ টি জুনিয়র হাই স্কুল আছে সেগুলোর সংকট সবচে ভয়াবহ এবং অমানবিক।
কেবল প্রাথমিক বা মাধ্যমিক নয়,পুরো জেলায় উচ্চ মাধ্যমিক বা ¯œাতক-¯œাতকোত্তর শিক্ষারও বেহাল অবস্থা। রাঙামাটি জেলার একমাত্র উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রাঙামাটি সরকারী কলেজ,যাতে অনার্স-মাস্টার্স পড়ার ব্যবস্থা আছে। কিন্তু দীর্ঘ এতো বছরেও এই কলেজে মাত্র তিনটি বিষয়ে অনার্স এবং একটি বিষয়ে মাস্টার্স কোর্স চালু আছে। কলেজ ছাত্রাবাসটি বন্ধ প্রায় এক যুগ ধরে।
নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার দেড় যুগ পরও চালু করা সম্ভব হয়নি কলেজের একমাত্র ছাত্রীনিবাসটি। কলেজের নেই কোন নিজস্ব পরিবহন,যে দুটি বাস ছিলো তাও অচল প্রায় এক যুগ। শিক্ষকদের জন্য নেই প্রয়োজনীয় আবাসিক সুবিধা,ফলে তারা অনেকেই চট্টগ্রাম থেকে এসে ক্লাস নিয়ে আবার চট্টগ্রাম ফিরে যায়। জেলার অন্যসব কলেজের অবস্থা বলাই বাহুল্য। একই অবস্থা পুরো জেলার একমাত্র নারী শিক্ষার সরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রাঙামাটি সরকারী মহিলা কলেজেরও।
সেখানেতো উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেনী ছাড়া পড়ারও কোন সুযোগ নেই। প্রতিষ্ঠার এতো বছর পরও সেখানে ¯œাতক বা সম্মান শ্রেণী চালু করা সম্ভব হয়নি। ছাত্রী হোস্টেল অপ্রতুল,শিক্ষক কোর্য়াটার নেই, ছোট ক্যাম্পাস আর কলেজের নোংরা প্রবেশ পথের সংকট নিয়ে বারবার আলোচনায়ও সমাধান মেলেনি। আদৌ মিলবে কিনা সেই আশ্বাসও নেই। এমপিও ভূক্ত কলেজের অবস্থাও ভালো নয়।
পুরো জেলায় ২ টি সরকারী কলেজ আর ১০টি বেসরকারী কলেজ তাই প্রতিনিয়ত যে সংকটে ভুগছে তার কোন পরিবর্তন ঘটেনি বর্তমান সরকারের গত ২ বছর মেয়াদেও।
পাহাড়ে প্রাক প্রাথমিক শিক্ষা নিয়ে বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থাসমূহ জাতিসংঘ উন্নয়ন সহায়তা কর্মসূচী-পার্বত্য চট্টগ্রাম (ইউএনডিপি-সিএইচটিডিএফ) এর সহায়তায় নানা প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। এইসব প্রকল্পগুলো নিয়েও আছে নানা মুনির নানা মত। তবে প্রাক প্রাথমিক শিক্ষা নিয়ে সবচে বড় যে প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হচ্ছে তা হলো পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের সমন্বিত সমাজ উন্নয়ন প্রকল্প। ইউনিসেফ এবং বাংলাদেশ সরকারের যৌথ অর্থায়নে পরিচালিত এই প্রকল্পটি বেশ সফলও।
তবে অতিদীর্ঘ মেয়াদের কারণে এই প্রকল্পটিও ঝুলে পড়ছে বলে অভিযোগ উন্নয়ন বিশেষজ্ঞদের।
এদিকে সাম্প্রতিক সময়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগে রাঙামাটিতে একটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করা হলে এনিয়েও শুরু হয় নানা ঝামেলা। একটি পক্ষ এর বিপক্ষে আন্দোলন গড়ে তোলে আবার আরেকটি পক্ষ এর পক্ষে আন্দোলন শুরু করে। পরে নানা সংকট বিবেচনায় নিয়ে শেষাবধি থমকেই আছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার যাবতীয় কাজ। ধারণা করা হচ্ছে,১৯৯৬-২০০১ এর আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলের মতোই আবারও ঝুলে গেলো এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রকল্পটি।
সবমিলিয়ে বেশ সংকটই আছে পাহাড়ের বিভিন্ন স্তরের শিক্ষা ব্যবস্থা। শিক্ষা ব্যবস্থার এই সংকট নিরসনে খুব দ্রুত কার্যকর উদ্যোগের প্রত্যাশা করেন পাহাড়ের মানুষ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।