আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

অস্বাভাবিক যৌনাচার- বিবর্তনবাদের আলোকে!

সমকামিতাকে প্রায় সব সমাজেই একসময় ‘ট্যাবু’ বা নিষিদ্ধ হিসেবে ধরা হতো এখন যেরকম অজাচারকে (incest বা অতি নিকট আত্নীয়দের মধ্যে যৌনসম্পর্ক) এখনও ধরা হয়। তবে কতদিন কে জানে? বিবর্তনবাদকে ভর করে সমকামিতা এখন তার সেই ট্যাবু থেকে বেরিয়ে আসার অপেক্ষায়। ডারউইনের প্রাকৃতিক নির্বাচনের সাথে সরাসরি সাংঘর্ষিক হওয়া সত্ত্বে সমকামিতা বিবর্তনবাদের মধ্যে জায়গা করে নিয়েছে। তাই সমকামিতার পর অজাচার বিবর্তনবাদে জায়গা করে নিবে- সেটাই স্বাভাবিক। বিবর্তনবাদ অনুযায়ী মানুষ জৈববস্তু দিয়ে তৈরী উন্নতমানের পশু ছাড়া আর কিছু না।

তাই পাশবিকতার চর্চাকে মানবিক আচ্ছাদনে ঢাকলেও সেতো সেই উন্নত পশুই! ফলে পূর্বপুরুষদের বৈশিষ্ট্যকে নিজের মধ্যে ধারণ করাটাও স্বাভাবিকতার পর্যায়েই পড়ে। মানুষের খুব নিকট পূর্বপুরুষ প্রাইমেটদের মধ্যকার সমকামীতাকে লক্ষ্য করে লিভারপুল বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবর্তনবাদী মনস্তত্ত্ববিদ রবিন ডানবার [১] বলেছেনঃ “শেষ কথা হলো, অন্যান্য প্রাইমেট বিশেষ করে বানরের মধ্যে যা ঘটেছে মানুষের মধ্যেও সেই বিবর্তনীয় ধারাবাহিকতা বিদ্যমান থাকার সম্ভবনা খুব বেশী। ” আনুমানিক ৩০০ এর মত প্রজাতিতে [২] বিজ্ঞানীরা সমকামী আচরণ লক্ষ্য করেছেন, তাদের অনেকের মধ্যে আবার একাধিক যৌনাঙ্গ থাকায় একাধিক যৌনাচারও বিদ্যমান। যেমন, জাপানিজ মাকাকুয়েস এর মধ্যে স্বাভাবিক যৌনাচারের সাথে সাথে সমকামীতার প্রচলন বিরাজমান। বনোবস নামক প্রাণীদের মধ্যে ‘মেয়ে-মেয়ে’ সমকামীতা বিরাজমান।

পশুদের মধ্যে বিরাজমান সমকামিতার উপর ভর করে তাকে যদি বিবর্তনবাদের মধ্যে জায়গা দেয়া যায় তাহলে অজাচার নয় কেন! কারণ পশুপাখির মধ্যেতো অজাচারও বিদ্যমান। প্রাণীরা সহজেই অজাচারে জড়িয়ে পড়ে। তবে বংশগত ত্রুটির কারণে বয়স বাড়ার সাথে সাথে অজাচারকে উপেক্ষা করে চলার প্রবণতা থাকে। প্রজাপতির ন্যায় একধরণের পতঙ্গদের (মথ) মধ্যে [৩] ভাই-বোনের ‘যৌনসম্পর্ক’ বিদ্যমান। তাছাড়া প্রাণীদের যৌন সম্পর্কের [৪] কোনো উপায় না থাকালে তারা সহজেই অজাচারে জড়িয়ে পড়ে।

আর পোকামাকড়ের ক্ষেত্রে [৫] অজাচারতো খুবই উপকারী! অজাচার এর কারণে পুরুষ বিটলস এর আয়ুষ্কাল সাধারণ সংকরায়নের চেয়ে বেশি। উইস্টে ইনস্টিটিউট এর ডঃ হেলেন কিং ইনব্রিডিং (আন্তঃপ্রজনন বা নিকট আত্নীয়দের মধ্যে যৌনসম্পর্ক দ্বারা সন্তান উৎপাদন) এর মাধ্যমে পাওয়া ইঁদুরের ওজন পাওয়া যায় অনেক বেশী [৬]। অবশ্য প্রাণীদের মধ্যে ‘সঙ্গী’কে শেয়ার করার প্রবণতাও লক্ষ্যণীয়। যেমন ‘মেয়েবাঁদুর’ [৭] তার মায়ের যৌনসঙ্গীর সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। অজাচার এর প্রতি একধরণের সহানুভূতির ক্ষেত্র পাশ্চাত্যে দেখা যায়।

জার্মানীতে প্যাট্রিক ও সুসান [৮] এর অজাচার এর কাহিনী বেশ আলোড়ন তুলেছিল। প্যাট্রিক ২৩ ও সুসান ১৬ এবং সম্পর্কে ভাই-বোন। ছোটকালে তাদের মধ্যে একটা বিচ্ছেদ ঘটে ও বয়ো:প্রাপ্ত হবার পরই কেবল আবার মিলিত হয়। অবশেষে আবদ্ধ হয় বিবাহ বন্ধনে। অবশ্য এর জন্য তাকে ১৭ মাসের জেলও ভোগ করতে হয়।

জার্মানীর গ্রীন পার্টির আইন বিশেষজ্ঞ জেরজি মনটাগ এই সম্পর্ক নিষিদ্ধ করাকে মান্ধাতা আমলের বলে মনে করেন। আবার প্রফেসর লিটলউড মনে করেন এই সম্পর্কটা ক্ষতিকর নয় যতক্ষণ না তারা বাচ্চা না নেয়, আর মত দেন এই যুগে এ সম্পর্ককে অন্যভাবে দেখার। তবে তিনি স্মরণ করিয়ে দিতে ভুলেননি যে তিনি একজন বিজ্ঞানী, নৈতিকতার কাণ্ডারী নন। ড: উইহেলম এর কন্ঠেও ধ্বনিত হয় একই সুর, আর তার কারণ প্রাণীদের মধ্যেও এই ধরণের অজাচার দেখা যায়, যদিও বয়স বাড়ার সাথে সাথে তাদের মধ্যে যৌন সম্পর্ককে এড়িয়ে চলার লক্ষণ দেখা যায়। জার্মানীর মত ইউরোপের অনেক দেশ যেমন, বেলজিয়াম, হল্যান্ড, ফ্রান্সে 'ইনসেস্ট'কে গুরুতর অপরাধ হিসাবে বিবেচনা করা হয় না।

ফ্রান্সে 'অজাচার' বিবাহ [৯] অবৈধ হলেও তাদের দৈহিক সম্পর্কতে নিষেধ নেই। পাশ্চাত্যবিশ্বে অজাচারের পরিমাণ আনুমানিক প্রতি ১০০ জনে ১ জন [১০]। সমকামীতার পক্ষে প্রচারণার আরেকটি উপায় হল নামীদামী ও প্রতিথযশা মানুষের সমকামী আচরণকে উদাহরণ হিসেবে আনা। যেমন প্লেটো, মাইকেলেন্জো, লিওনার্দো দ্যা ভিঞ্চির মত প্রতিথযশা মানুষেরা সমকামী। অজাচার এর বেলায়ও সেভাবে দেখানো যায়।

কারণ ইতিহাসে অনেক [১১] স্মরণীয় লোকেরা অজাচার এর চর্চা করেছেন। যেমন ইউরোপের হ্যাপসবার্গ পরিবার [১২] যারা ৫০০ বছর যাবৎ অষ্ট্রিয়া, হাঙ্গেরী, বেলজিয়াম, জার্মানী ও হল্যান্ডে রাজত্ব করেছে শেষপর্যন্ত তাদের স্প্যানিশ বংশধরেরা হঠাৎ করে বিলুপ্ত হয়ে যায়। পরে গবেষণা করে দেখা গেছে শেষ রাজা চার্লস-২ একটি ইনসেস্ট সম্পর্কের ফসল। বিখ্যাত ইংরেজ কবি বায়রণের যৌনসম্পর্ক ছিল তার সৎবোন অগাস্টা লেইগ এর সাথে, কাম্বারল্যান্ডের ডিউক এর যৌনসম্পর্ক ছিল তার বোন সোফিয়ার সাথে, নেপোলিয়নের যৌনসম্পর্ক ছিল তার সৎমেয়ে, বোন ও ভাতিজির সাথে। জার্নাল অব দ্যা আমেরিকান মেডিক্যাল এসোসিয়েশন [১৩] এর প্রকাশিত লেখা থেকে অতিসম্প্রতি জানা গেছে প্রাচীন মিসরীয় ফারাওদের মধ্যে অন্যতম প্রভাবশালী 'তুতেনখানেম' ছিলেন অজাচার এর ফসল, আর তিনি নিজেও অজাচার-এ জড়িত ছিলেন।

তার পিতা-মাতা ছিলেন ভাই-বোন, আর তিনিও বিয়ে করেছিলেন তার আসল অথবা সৎ বোনকে। সমকামিতা প্রাণীর অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার প্রধান উপায় বংশবৃদ্ধির পথ আটকে দেয়। তেমনি অজাচারও প্রাণীর মধ্যে বিভিন্ন জীনগত সমস্যা দিয়ে তার অস্তিত্বকে সংকটাপন্ন করে তোলে। যেমনঃ অজাচার এর ফলে চীনে সাউথ চায়না টাইগার [১৪] নিজের অস্তিত্বকে বিপদাপন্ন করেছে। একই কথা খাটে অষ্ট্রেলিয়ান কোয়ালাদের [১৫] বেলায়ও।

এই কোয়ালাদের মধ্যে অজাচার এর প্রাদূর্ভাব খুব বেশী হওয়ায় ১৮০০ সালের দিকে তারা দক্ষিণ অষ্ট্রেলিয়া ও ভিক্টোরিয়া থেকে বিলুপ্ত হয়ে যায়। অজাচার নর্দান রকি নেকড়েদেরও [১৬] বিপদাপন্ন করেছে। তাদের মধ্যে শিরঃদাড়াতে জিনগত বিকৃতির লক্ষণ খুজে পাওয়া যায়। ভারতের হিমালয়ের লায়ন সাফারিতে ৫৯টি সিংহের মৃত্যুর জন্য অজাচারকে দায়ী করা হয়। নানা অসুখ বিশুখ ও অস্বাভাবিকতার জন্য এরা অনেক বছর ধরে ভুগে।

অজাচার এর ফলে প্রতি পাঁচ জেনেরেশনে হেট্রোজাইগোসিটি কমে শতকরা ৫০ ভাগ [১৭], আর ১০ প্রজন্মে হেট্রোজাইগোসিটি একেবারে শেষ হয়ে যায়। উপসংহারে, বিবর্তনবাদ অনুসারে মানুষ প্রাণীর বিবর্তনের ধারাবাহিকতায় একটি প্রাণী বৈ কিছু নয়। যদিও অন্যান্য পশুপাখীর মধ্যে একটা সময় অজাচারকে বর্জনের একটা লক্ষণ দেখা যায়, কিন্তু যৌনাচারের কোন উপায় না থাকলে অজাচার তাদের জন্য কোন বাধা হয়ে আসে না। পশুপাখির মধ্যে যৌনাচারের মাধ্যমে বংশবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণের কার্যকর কোন পদ্ধতিও নেই। তাইতো ‘সাউথ চায়না টাইগার’, অষ্ট্রেলিয়ার ‘কোয়ালা’ কিংবা ভারতের লায়ন সাফারির ‘সিংহ’দের অস্তিত্ব অজাচার এর কারণে হুমকির সন্মুখীন! কিন্তু মানুষের ক্ষেত্রে জন্মনিয়ন্ত্রণের পদ্ধতি আয়ত্বে থাকায় অজাচার এর এই ক্ষতিকে সহজেই উপেক্ষা করতে পারে।

আর এজন্যই ইউরোপের অনেক দেশেই ইনসেস্টকে গুরুতর অপরাধ হিসেবে বিবেচিত করা হয় না, যদিও সন্তান উৎপাদনকে নিরুৎসাহিত করা হয়। তাছাড়া যেসব কারণ দেখিয়ে সমকামিতাকে বিবর্তনবাদের আলোকে ব্যাখ্যা করে একে সমর্থন জানানো হয়, সেভাবে ‘অজাচার’ এর প্রতি সমর্থনও হয়তো কেবল সময়ের ব্যাপার! [[[এখানে বলা রাখা ভাল, অজাচারের এই সম্পর্ককে ইচ্ছে করেই বেশী খোলাসা করা হয়নি, আশা করি পাঠক বুঝতে পারবেন (কাজিনরা এর অন্তঃর্ভূক্ত নয়)। অজাচারের সম্পর্ক মানুষের জন্য খুব ক্ষতিকর। অজাচারের ফলে পরবর্তী বংশধরদের মধ্যে জন্মগত অনেক রোগ পাওয়া যায় যা থেকে নিস্তার পাওয়া খুব কঠিন। তবে অনেক সমাজে ধারণা করা হতো কাজিন বিয়ে করলে জন্মগত সমস্যা হয়।

হ্যা সামান্য কিছু হয় কিন্তু গণনায় নেবার মত নয়। ম্যাসাচুসেটস বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ডেইন পল ডুনেডিন এর ওটাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসের হামিশ স্পেনসার তাদের করা গবেষণার উপর ভিত্তি করে দাবী করেছেন, কাজিনদের মধ্যে বিয়েতে জন্মগত সমস্যা স্বাভাবিক গড়ের চেয়ে মাত্র ২ ভাগ এবং বাচ্চার মারা যাবার সম্ভবনা মাত্র ৪.৪ ভাগ বেশী। তবে মজার ব্যাপার হল চল্লিশার্ধো মহিলাদের বাচ্চাদের ক্ষেত্রে একই রকম কিছু সমস্যা হয়। এখানে লিঙ্ক পাবেনঃ বিজ্ঞানীদের দাবী অনুসারে কাজিন বিয়ে করাতে কোন সমস্যা নেই প্রফেসর হামিশের জার্নাল পেপারের সুত্র]] সূত্রঃ ১. Click This Link ২. Click This Link ৩. Click This Link ৪. Click This Link ৫. Click This Link ৬. Click This Link ৭. Click This Link ৮. Click This Link ৯. Click This Link ১০. Incest: An Evolutionary Model, Clive V.J. Welham ১১. Click This Link ১২. Click This Link ১৩. Click This Link ১৪. Click This Link ১৫. Click This Link ১৬. Click This Link ১৭. Click This Link নোট: লেখাটি ইতিপূর্বে সদালাপে প্রকাশিত হয়েছিল। আমি সেখানে শামস নামে লিখে থাকি।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১১ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।