মেঘমুক্ত নীলাভ দিঘীর কবোষ্ণতা খুঁজছে মন!
রাজার ছেলে বিলু, বসেছিল প্রাসাদের দাওয়ায়। তাই দেখে রাজা রেগে মেগে দিলেন হুঙ্কার।
পাইক পেয়াদা, বরকন্দাজ কে আছিস? বাঁদরটাকে ধরে নিয়ে আয়!
তাই শুনে, পাইক পেয়াদার লাঠি সোঠা, তীর ধনুক,বর্শা আর হাতের কাছে যা ছিল তাই নিয়ে ছুটলো।
রাজপ্রাসাদে বাঁদর, দেখো দেখি!
কিন্তু কোথায় বাঁদরটাকে দেখতে না পেয়ে শেষমেষ একদল বনের দিকে রওনা দিল বাঁদর ধরতে, আর একদল গেল চিড়িয়াখানার কর্তাকে ধরে আনতে।
রাজা কোমড়ে হাত দিয়ে নিজের মস্ত গোফটা টানতে টানতে এসব কান্ড দেখছিলেন।
শেষমেষ বিরক্ত হয়ে নিজেই এসে রাজপুত্রকে কানে ধরে তুললেন।
এই হচ্ছে না! রাজার ছেলে হয়ে পা বিছিয়ে বসা হচ্ছে মাটিতে, কত বড় সাহস দেখেছো তুমি মন্ত্রী?
রাজ্য মন্ত্রী রাজার সাথেই ছিলেন। তিনিও এতক্ষনে ব্যাপারটা ঠাহর করতে পারলেন।
বিচ্ছিরি আর বেজায় সাহস! তিনি গলা মেলালেন।
মাটিতে যদি বসবে তবে কাবলুষ পাহাড়ের তুলো আর শঙ্খপুরের রেশমে তৈরি গদিগুলো দিয়ে হবেটা কি শুনি, মিউজিক পিলো খেলবো? রাজার রাগ পড়ে না।
মাটিতে বসতে আমার ভাল লাগে! রাজকুমার জবাব দেয়, মাটির দিকে তাকিয়ে। ওই রেশমের গদিতে বসতে আমার ভাল লাগে না।
শুনে রাজা আর মন্ত্রী দুজনারই বাকরুদ্ধ হয়ে যায়। তাদের মুখ থেকে যেন কথা সরে না।
তাছাড়া...বিনু বলে চলে, এই ভারী জামাটাও আমার পড়তে ভাল লাগে না।
কালুর মত জামা চাই আমার, মোটেও ভারী না।
কালুটা কে মন্ত্রী?
সহীসের ছেলে হুজুর, খুব সাহসী ছেলে।
সহীসের ছেলে তো সাহসীই হবে, রাজা বিরক্ত হন, কিন্তু ওর জামাটা কি?
ছোটলোকের জামা আর কী হবে হুজুর, সুতির পিরান। কারুকার্যের বালাই নেই।
তাই কিনা পড়তে চাইছে, তুমি সাহসটা দেখেছো মন্ত্রী, রাজার ছেলে কিনা পড়তে চায় সুতির পিরান?
বেজায় আর বিচ্ছিরি সাহস! মন্ত্রী যোগ করে।
তা তোমার আর কী কী করতে ইচ্ছে করে না, রাজা রাজপুত্রকে প্রশ্ন করে।
অনেক কিছুই, রাজপ্রাসাদে বসে থাকতে ভাল লাগে না, কালুর মত ইশকুলে গেলে মজা হত খুব, আর আর..রাজপুত্র ইতস্তত করে, সকালবেলা উঠে যুদ্ধবিদ্যা শিখতে ভাল লাগে না। কালুর মত ছড়ার বই পড়লে মজা হত খুব। আর আর.. গল্প শুনতে ভাল লাগে, আর আর..
রাজা আর সহ্য করতে পারেন না। মন্ত্রী ওকে থামাও!
শুনতে পেলে ওইটুকুন গলা দিয়ে কি বেরুলো? আজ বলছে ছড়ার বই পড়বে, কাল বলবে পড়ালেখা করবে, আর তারপরের দিন রাজকোষ প্রজাদের মধ্যে বিলিয়ে দেবে।
আমি এবার সর্বসান্ত হলাম, একে বারে পথে বসালো আমায় !
রাজা হায় হায় করতে থাকেন।
বাবা, পথে তো তুমি বসছো না। আমি বসছি, পথে বসতে আমার ভালো লাগে খুব। রাজপুত্র রাজাকে অভয় দেয়।
সেই অভয়ে কাজ হয় না।
রাজার আহাজারি থামে না।
সবে মাত্র দশ বছর বয়স, এখনই এই দশা! এগারোতে উঠে সবাইকে গেরো দেবে, আর বারোতে আমার বারোটা বাজাবে! রাজা বলে যান।
আর বিশে উঠে সবাইকে বিষ খাওয়াবে! মন্ত্রী যোগ করে,সেও তক্কে তক্কে ছিল রাজার মত মিলিয়ে বলতে।
কী করা যায় একে বলোতো? রাজা মন্ত্রীর দিকে চিন্তিত মুখে তাকান।
কেটে কুটে জলে ভাসিয়ে দেন!
আর সেই সুযোগে আমি গত হবার পর তুমি রাজা হও আর কী, সে মতলবেই তো আছো চর মারফত যদ্দুর জানি।
ওসব বাদ দাও। অন্যকিছু ভাব। এটাকেই তো রাজা বানাতে হবে।
মন্ত্রী অপ্রস্তুত হয়ে পড়েন ভারী, তাহলে আর কী, বেকসুর খালাস দেন। তার গলায় অভিমানের সুর।
হুম, সেটা খারাপ বলোনি। তবে তার আগে তো কারাদন্ড প্রয়োজন।
পেয়াদা! রাজা এক পেয়াদাকে ডাকলেন।
এটাকে ধরে নিয়ে যাও। দুঘন্টার কারাদন্ড।
পেয়াদার সাথে রাজপুত্র লাফাতে লাফাতে চলে গেল।
তাই দেখে মন্ত্রী দীর্ঘশ্বাস ফেললো।
গুরু পাপে দন্ড বড় লঘু হয়ে গেল, তিনি বিড়বিড় করলেন।
****
দুঘন্টা পর রাজার কাছে খবর আসলো, কারাদন্ডের সময় শেষ হওয়া সত্বেও রাজপুত্র কারাগার ছাড়তে রাজী নয়। পেয়াদাদের সে জানিয়েছে আজ সারাদিন সে ওখানে থাকতে চায়।
রাজা ভেবে পেলেন না কি করা উচিত।
মন্ত্রী বললেন, ঘাড় ধরে নিয়ে আসো! বিচ্ছিরি আর বেজায় সাহস।
পেয়াদা মুখ কাচুমাচু করে বলল, মাফ করবেন মন্ত্রীমশাই, কনকপুরের সংবিধান অনুযায়ী রাজপুত্রের ঘাড় ধরে নিয়ে আসার অধিকার আমাদের নেই।
তবে ভুলিয়ে ভালিয়ে নিয়ে আসো, মন্ত্রী বিরক্ত হয়ে বলল। বলো এক পঙ্খীরাজ ঘোড়া প্রাসাদে এসে ঝিমাচ্ছে!
মাফ করবেন মন্ত্রীমশাই, কনকপুরের সংবিধান অনুযায়ী রাজপুত্রকে মিথ্যা কোন তথ্য দেয়ার অধিকার আমাদের নেই।
পঙ্খীরাজ ঘোড়া বলতে আমাদের জানামতে কিছু নেই।
তবে..তবে..মন্ত্রী রেগেমেগে তোতলাতে থাকেন। কিছু একটা করো, ওই বিচ্ছিরি সংবিধানের দোহাই, হাতে পায়ে ধরে, কান্নাকাটি করে নিয়ে আসো।
মাফ করবেন মন্ত্রীমশাই, কনকপুরের সংবিধান অনুযায়ী... পেয়াদা আবার বলতে থাকে। কিন্তু তার কথা শেষ হওয়ার আগেই দেখা যায়, রাজপুত্র আরেক পেয়াদার সাথে লাফাতে লাফাতে রাজপ্রাসাদে ঢুকছে।
বাবা,বাবা-এসেই রাজপুত্রের গালভরা ডাক।
আজকে প্রথম পর্ব শুনলাম। কালকে আবার আমাকে কারাগারে পাঠিও, দ্বিতীয় পর্ব বলবে।
রাজা যেন থই পান না।
কীসের পর্ব পেয়াদা?
জ্বী হুজুর, এটা সোলেমান ভাই’র গল্প।
আমরা আগেই শুনছি। আজকে রাজকুমারের জন্য সোলেমান ভাই নতুন করে শুরু করছে।
সোলেমানটা কে? রাজা আর সইতে পারেন না, হাইমাউ করে উঠেন।
কারাগারের জল্লাদ হুজুর।
কারাগারের জল্লাদ তোমাদের গল্প শুনিয়ে বেড়ায়।
জ্বী হুজুর। প্রতি রাতেই সে কারাগারের সব কয়েদী আর পাইক-পেয়াদা নিয়ে গল্পের আসর জমায়। তার গল্প শুনলে খালি হাসি পায়।
অ্যা, এ কী বলছে শুনছো মন্ত্রী। রাজা যেন নিজ কানকে বিশ্বাস করতে পারেন না।
রাজ কারাগারের সবাই ফুর্তি করে দিন কাটাচ্ছে। জল্লাদ কিনা কয়েদীদের গল্প শুনিয়ে বেড়াচ্ছে।
জ্বী হুজুর, পেয়াদা আবার বলে। সেদিন লোকনাথ চোরের খালাস ছিল। কিন্তু সে সেইদিন কিছুতেই যাবে না।
কারন সোলেমানের আট পর্বের ধারাবাহিক গল্পের সেদিন ছিল ছয় নম্বরটা। আরো দুইদিন থাকার জন্য সে খুব কান্নাকাটি করলো, আমরা ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিয়েছি।
বেশ করেছো। রাজা মনে হল সন্তুষ্ট হলেন।
পরক্ষণেই আবার তাকে চিন্তিত মনে হল।
কী করা যায় বলোতো মন্ত্রী।
কেটে কুটে জলে ভাসিয়ে দিন!
কাকে? রাজপুত্রকে আবার?
না হুজুর, বলছিলাম জল্লাদের গর্দান নিয়ে জলে ভাসিয়ে দেন।
হুম,ঠিক বলেছো। জল্লাদের গর্দান নাও, এক্ষুনি! কত সাহস দেখো দেখি।
বেজায় আর বিচ্ছিরি সাহস।
মন্ত্রী যোগ করে।
হুজুর একটা সমস্যা। পেয়াদা আবার গলা তোলে।
কী?
গর্দান নেয়ার মত সোলেমান ছাড়া আর কেউ নেই কারাগারে, জল্লাদ আমাদের একজনাই।
ও নিজেই নিজের গর্দান নেবে! রাজা হুঙ্কার ছাড়ে।
কিন্তু মাফ করবেন রাজামশাই, কনকপুরের সংবিধান অনুযায়ী...
এরও গর্দান নাও। রাজা লাফিয়ে উঠলেন, কত বড় সাহস দেখেছো মন্ত্রী, আমাকে সংবিধান শেখায়।
হুম,বিচ্ছিরি আর বেজায় সাহস। মন্ত্রীও মুখ ভার করে বলে।
বাবা! এতক্ষণে রাজপুত্রের কলকলে গলা শোনা যায়।
সোলেমান চাচাকে দুদিন পরে মারো। মাত্র তিন পর্বের গল্প। তুমিও আমার সাথে শুনবে। ভারী মজার গল্প।
না না, ওসব হবে না, পরে ওই তিন পর্বকে একহাজার পর্ব বানাক আরকী, কী ভেবেছো, আরব্য রজনীর গল্প আমার জানা নেই।
গল্পের লোভে পড়ে ওর গর্দান নেয়া থেমে থাকুক আর কী! নাহ, আমি কোন গল্প শুনতে চাই না। আজকে রাতেই ওর গর্দান নেবে,ও নিজেই নেবে।
রাজামশাই, পেয়াদা আবার বলে উঠে মুখ কাচুমাচু করে, কনকপুরের সংবিধান অনুযায়ী গর্দান শুধুমাত্র সকালেই নেয়া যায়।
ঠিকাছে, কাল সকালেই হবে। মন্ত্রী!
জ্বী রাজামশাই।
আমি আর কিচ্ছু শুনবো না, না কোন সংবিধান, না কোন ধারাবাহিক গল্প। কালকেই যেন এদের গর্দান নেয়া হয়। প্রথমে নেবে এই সংবিধানওয়ালার গলা, তারপরে সোলেমানের। কত বড় সাহস দেখো দেখি।
হুম,বিচ্ছিরি আর বেজায় সাহস! মন্ত্রী যোগ করে।
( চলবে)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।