আমি জানি আমি জানি না বাঙালী মনীষীদের ধর্মচিন্তা ।
ধর্ম বিষয়ে সবাই ভাবে, কিন্তু সবাই একরকম ভাবে না । এমন কি একই ধর্মে বিশ্বাসী মানুষদেরও ধর্ম চিন্তা এক রকম না । এখানে বাংলার বিখ্যাত কিছু মানুষদের চিন্তাধারার, মতামত এর উদ্ধৃতি তাদেরই ভাষায় তুলে ধরা হলো । এদের মধ্যে –বিশ্বাসীও আছেন এবং অবিশ্বাসীও- তবে উভয়েরই এক জায়গায় মিল, সবাই সাংগঠনিক ধর্ম সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা পোষণ করেন।
অনেকেই এক ঈশ্বর মানেন-যদিও কোন ধর্মমতে বিশ্বাসী নন। ইংরেজিতে দিইস্ট (deist) বলে ,এদের ধর্মবিহীন-ঈশ্বরবিশ্বাসী বলা যায় । কেউ ঘোষিত নাস্তিক,কেউ বা তারিক আলীর মত নন্-মুসলিম মুসলিম,অর্থাৎ বিশ্বাসের দিক থেকে অমুসলিম যদিও মুসলিম সমাজে বাস করছেন বিধায় মুসলিম , অনেকেই উদার নন-প্রাকটিসিং মুসলিম,কেউ সংস্কারবাদী হিন্দু, কেউ একেশ্বরবাদী , সংশয়বাদীও আছেন অনেকে।
বলাই বাহুল্য এই উদ্ধৃতি সংকলন অসম্পূর্ণ। এই ধারার উদ্ধৃতি অনেকের কাছেই আছে হয়তো।
ব্লগের অন্যান্যদের কাছে যদি সে সব পাই তবে সবটা মিলে এটি মুল্যবান একটি সংকলন হতে পারে ।
'শুন হে মানুষ ভাই, সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই। '
- চতুর্দশ শতকের বৈষ্ণব কবি চন্ডীদাস
ভ্রান্ততা (falsehood) ,কোন ব্যতিক্রম ছাড়াই সব ধর্মের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য । -ঐ
‘যৌক্তিক বিচারে পরস্পরবিরোধী ধর্মমত গুলোর প্রতিটাই সত্য হওয়া সম্ভবপর নয়। এ গুলোর কোন একটাকে সত্য বলে দাবী করাটা সেই মতটার উপর অযৌক্তিক গুরুত্ব দেয়া ছাড়া আর কিছুই নয় ।
কাজেই এ ক্ষেত্রে স্বাভাবিক সিদ্ধান্তটা হচ্ছে – সমস্ত ধর্মের সঙ্গেই মিথ্যাচার ওতপ্রোত ভাবে জড়িত । -ঐ
‘ধর্ম ব্যাপারে আমি গোঁড়া নাস্তিক। এ নিয়ে মনে কখনও সন্দেহের ছায়া পড়েনি । নির্গুণ ব্রম্মা আছেন কিনা আছেন ,জানিনা । কিন্তু শত যন্ত্রনাময় ,মৃত্যুভয়পীড়িত জীব-জীবনের দেখভাল করছেন নভস্থিত কোনও পিতা- এই বিশ্বাসকে গল্প কথা ছাড়া আর কিছু কখনও ভাবতে পারিনি ।
’
-বাঙালনামা । তপন রায় চৌধুরী ।
‘কোন বিশেষ ধর্ম সর্বকালের, সর্বদেশ ও সমস্ত মানবজাতির জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে , -এই ধারণা যে জাতির আছে , সে জাতি নিতান্ত হতভাগ্য । ’-
‘আদেশের নিগ্রহ’, শিখা । আবুল হোসেন ।
বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন
‘ভেঙ্গে ফেল মঠ মন্দির চূড়া,
দারুশিলা কর বিসর্জন ;
বলি,উপাচার,দীপ, ধূপরাশি,
রসাতলে কর নিমজ্জন । ’
-মোহিতলাল মজুমদার
‘এক ধর্মের বিশ্বাস অন্য ধর্মাবলম্বীদের কাছে কুসংস্কার, অলীক কল্পনা । হযরত মুহাম্মদ বোররাখ্ ,অর্থাৎ এক নারীমুখ সম্পন্ন পক্ষিরাজ ঘোড়ায় চড়ে সাত আসমান পেরিয়ে আল্লাহর দরবারে হাযির হয়েছিলেন, এ কাহিনী হিন্দুরা বিশ্বাস করতে পারে না। সব মুসলমানই কি পারে ? একেবারে আক্ষরিক অর্থে ? তেমনি মহাভারতে ভীস্মের শরসয্যা, ইচ্ছামৃত্যু একজন মুসলমানের কাছে গল্পকথা মাত্র ।
-ঔপন্যাসিক আবুল বাশার ।
‘আস্তিক মানুষেরা কেবল স্বধর্মকেই সত্য বলে মানে ।
পরধর্মে আস্থার অভাবহেতু ধার্মিক মাত্রই পর ধর্মের প্রতি অবজ্ঞাপ্রবণ । ' -আহমদ শরীফ
‘যাহা শাস্ত্র তাহাই বিশ্বাস্য নহে , যাহা বিশ্বাস্য তাহাই শাস্ত্র । ' -বঙ্কিম
ধর্মের নিত্য আদর্শকে শ্রদ্ধা করি বলেই ধর্মমত’কেও নিত্য বলে স্বীকার করতে হবে এমন কথা বলা চলেনা । -রবীন্দ্রনাথ
'ভক্তির যেখানে শেষ, জ্ঞানের সেখানে শুরু।
'
-সিরাজুল ইসলাম চৌধুরি
'হতাশা কাউকে করে উদাসীন,কিন্তু অধিকাংশকেই করে ভক্তিবাদি'- ঐ
'ইহলোকে বা পরলোকে পুরস্কারের প্রতিদানে ঈশ্বরকে ভালোবাসা ভালো,কিন্তু ভালোবাসার জন্যই তাকে ভালোবাসা আরও ভালো। ' -বিবেকানন্দ
'বহুরুপে সম্মুখে তোমার
ছাড়ি কোথা খুঁজিছ ঈশ্বর ?
জীবে প্রেম করে যেই জন
সেই জন সেবিছে ঈশ্বর। ' -(ঐ)
'কোথায় স্বর্গ ,কোথায় নরক কে বলে তা বহুদুর ,
মানুষেরই মাঝে স্বর্গ- নরক মানুষেতে সুরাসুর । '
- কবি শেখ ফজলুল করিম
দেবতা দুরে নাই ,গীর্জায় নাই,তিনি আমাদের মাঝেই আছেন । তিনি জন্মমৃত্যু ,সুখদু:খ পাপপূণ্য, মিলন বিছ্ছেদের মাঝে স্তব্ধভাবে বিরাজমান ।
-রবীন্দ্রনাথ
‘ধর্মের বেশে মোহ যারে এসে ধরে,
অন্ধ সে জন ,মারে আর শুধু মরে।
নাস্তিক সেও পায় বিধাতার বর
ধার্মিকতার করে না আড়ম্বর ,
শ্রদ্ধা করিয়া জ্বালে বুদ্ধির আলো
শাস্ত্র মানে না ,মানে মানুষের ভালো । '
- রবীন্দ্রনাথ
‘আমাদিগকে অন্ধকারে রাখিবার জন্য পুরুষগন ঐ ধর্ম গ্রন্থগুলিকে ঈশ্বরের আদেশপত্র বলিয়া প্রকাশ করিয়াছেন ।
এই ধর্মগ্রন্থগুলি পুরুষ-রচিত বিধিব্যবস্থা ভিন্ন আর কিছুই নহে। মুনিদের বিধানে যে কথা শুনিতে পান ,কোন স্ত্রী-মুনির বিধানে হয়তো তাহার বিপরীত নিয়ম দেখিতে পাইতেন ।
যাহা হউক-ধর্মগ্রন্থ সমূহ ঈশ্বর প্রেরিত কিনা তাহা কেহই নিশ্চিত করিয়া বলিতে পারেনা । যদি ঈশ্বর কোন দূত রমনী শাসনের নিমিত্ত প্রেরণ করিতেন,তবে সে দূত বোধহয় কেবল এশিয়ায় সীমাবদ্ধ থাকিতেন না ।
এখন আমাদের আর ধর্মের নামে নত মস্তকে নরের অযথা প্রভুত্ব সহ্য করা উচিৎ নহে । আরও দেখ,যেখানে ধর্মের বন্ধন অতিশয় দৃঢ়, সেইখানে নারীর প্রতি অত্যাচার অধিক ।
ধর্ম শেষে আমাদের দাসত্বের বন্ধন দৃঢ় হইতে দৃঢ়তর করিয়াছে,ধর্মের দোহাই দিয়া পুরুষ এখন রমনীর উপর প্রভূত্ব করিতেছেন ।
'
- বেগম রোকেয়া
‘ঈশ্বর কি কেবল এশিয়ারই ঈশ্বর ? আমেরিকায় কি তাহার রাজ্য ছিল না ? ঈশ্বরদত্ত জলবায়ু তো সকল দেশেই আছে ,কিন্ত তাহার দূতগন সকল দেশে ব্যপ্ত হন নাই কেন ?
ঈশ্বর প্রেরিত পুরুষ আছে ,প্রেরিত নারী নাই কেন ?'
- বেগম রোকেয়া
‘মনুষ্য জাতির দেব কল্পনার ইতিহাস প্রকৃতপক্ষে তার আপণ পূ্র্ণতার আদর্শকে গড়ে তুলবারই ইতিহাস ;আপন পরিপূর্ণ বিকাশের চরম আদর্শকেই মানুষ ভগবান বলে এসেছে চিরকাল’
-দার্শনিক আবু সয়ীদ আয়ুব
‘মানুষেরে ঘৃনা করি-
ও’কারা কোরান ,বেদ, বাইবেল চুম্বিছে মরি মরি,
ও মুখ হইতে কেতাব গ্রন্থ নাও জোর করে কেড়ে
যাহারা আনিল গ্রন্থ-কেতাব সেই মানুষেরে মেরে
পুজিছে গ্রন্থ ভন্ডের দল! মূর্খরা সব শোন-
মানুষ এনেছে গ্রন্থ - গ্রন্থ আনেনি মানুষ কোন।
কাজী নজরুল ইসলাম
(মানুষ / সাম্যের গান)
‘ইসলাম সত্য , কুফর মিথ্যা ’- এই বাক্য যিনি লিখেছেন তার মত নিশ্চয়ই এ রকম যে ইসলাম কে শুধু সত্য বলাই যথেষ্ট নয় , অন্য ধর্ম যে অসত্য তা না বললে ধর্মীয় দৃষ্টিতে সত্য বলা হয় না । কিন্তু এর বিপদটা হলো এখানে যে এই বাক্য যে মুখস্থ করবে, সে অন্য ধর্মাবলম্বীদের অনায়াসেইবলতে পারবে যে তার ধর্ম মিথ্যা । - অধ্যাপক আনিসুজ্জামান/ কাল নিরবধি ।
সত্যজিৎ রায় কে গবেষক ও জীবনীকার এন্ড্রু রবিনসন জিঙ্গেস করলেন ,-
-আপনি কি বিশ্বাসী ?
-আমি একজন নাস্তিকই ।
তবে বয়স যত বাড়ছে মনে হয় তত অজ্ঞেয়বাদী হয়ে পড়ছি।
-কি রকম ?
-আমার নিজের অনুভূতি হচ্ছে মানুষই ঈশ্বর সৃষ্টি করেছে । অবশ্য প্রানের শুরুর ব্যপারটা নিয়ে রহস্য তো আছেই । কিন্ত আমার মনে হয় ঈশ্বর তেমন কিছু একটা ব্যপার নয় য়াতে আমি বিশ্বাস করতে পারি ।
-ধর্ম ?
-আমি ধর্মীয় গোঁড়ামীর বিরুদ্ধে সব সময়ই সোচ্চার তো বটেই, আমি খোদ ধর্মকেই কোন জরুরী বিষয় বলে ভাবিনা ,বিশ্বাস করিনা।
কেমন করে এবং কেনই বা করবো যা কেবলই মানুষের মধ্যে বিভেদ আনে , বিভেদ আনে বর্ণ, মেকী প্রাচীর তুলে দেয় মানুষে মানুষে।
Satyajit Ray: the inner eye . By Andrew Robinson
‘সব ধর্মগ্রন্থগুলো পড়া উচিৎ সব মানুষের। কেননা ওই সব পবিত্র ধর্মগ্রন্থ সমূহ যদি নৈর্ব্যক্তিকভাবে পড়া যায় – বোঝা যাবে ধর্ম মানুষকে কিভাবে বোকা বানায় , কি ভাবে মানুষে ২ বিভেদ গড়ে তোলে , নারী ও পুরুষে । জাতিতে জাতিতে বিভেদ গড়ে তোলে, কি ভাবে হিংস্র হয়ে সভ্যতাকেও ধ্বংস করে, লাইব্রেরি পুড়িয়ে ফেলে । এসব মানুষের জনা উচিৎ ।
দর্ম কেবল শান্তির, সাম্যের মানবতার নয় বরং অশান্তির,
অসাম্যের, মানবতার বিপক্ষের ।
- কথাশিল্পী সেলিনা হোসেন ।
‘ধর্মধ্বজীরা কখনও যুক্তির ধার ধারে না -যে যুক্তি বিচার মানুষকে জানোয়ার থেকে আলাদা করে ‘ ।
- কথা সাহিত্যিক শওকত ওসমান ।
‘ আল্লাহ মানুষের পরিবর্তন না করিয়া হেদায়েতের ঝন্ঝাট পোহান কেন?
-আরজ আলী মাতব্বর / সত্যের সন্ধান
‘ধর্মের নামে একতা প্রতিষ্ঠার প্রয়াস সম্পূর্ণ ভ্রান্ত ।
তাতে বিভেদের বীজ বপন করার অনুকূল ক্ষেত্র তৈরি করা ছাড়া আর কিছুই লাভ হয় না । ‘
-আব্দুর রউফ/ চতুরঙ্গ সম্পাদক
‘মহম্মদের জন্ম যদি হইতো এইনা দেশে,
বেহেশ্তের কোন ভাষা হইতো বলতো দেখি এসে।
মাতৃভাষা ত্যাজি সবাই,
আরবী ভাষা শিখলি রে ভাই,
তাতে ভাই ফায়দা তো নাই জানবি অবশেষে । - লালন
‘বিজ্ঞানের বেস হচ্ছে লজিক,আর ধর্মের বেস হচ্ছে ফেইথ বা বিশ্বাস । দুটো মেলান যাবেনা ।
যদি লজিকের সঙ্গে ফেইথকে জড়াতে চাই তবে বিজ্ঞান ধ্বসে পড়বে । ধর্মটা হচ্ছে বিশ্বাস ।
-জাফর ইকবাল
‘স্মৃতির পাখিরা’ গ্রন্থে লেখক গবেষক সুরজিৎ দাশগুপ্ত কবি জীবনানন্দ দাশ’কে জিজ্ঞেস করলেন-
-আপনি ব্রম্মে বিশ্বাস করেন না ?
-না,আমি মানবে বিশ্বাস করি,যেসব মানবোচিত গুনকে মনুষ্যত্ব বলে সেই মনুষ্যত্বে বিশ্বাস করি।
-কিন্তু আপনি তো ব্রাম্ম সন্তান?
-ব্রাম্ম সন্তান,কিন্তু ব্রাম্মবাদী নই, -মানবতাবাদী।
-মানব’ই কি সব ? তার পরে বা উপরে কিছুই নেই?
-আছে , মহা জিজ্ঞাসা ।
-তাকে কি আপনি ঈশ্বর বা ব্রম্ন বলবেন না ?
-তোমার ঈশ্বর বা ব্রম্ম হলো মহাউত্তর- তার মানে মহা অজানা ।
আমি বিশ্বাসের দূর্গে আঘাত করেছি , কেননা বিশ্বাস হচ্ছে যুক্তির অভাব। যেসব বিশ্বস আধুনিকতার , প্রগতির,সুষ্ঠু সমাজ গড়ে তোলার পক্ষে বাঁধা সে গুলোকে আঘাত করেছি। শাস্ত্রীয় আচরণ সবটাই কুসংস্কার। তার বিরুদ্ধে চিরকাল লিখেছি ।
-আহমেদ শরীফ
আমি পৈতে ছাড়া, গরু-খাওয়া বামন,ভগবান নিয়ে কোনদিন মাথা ঘামাইনি। যে কোন আচার-আচরণ ও বিধি নিষেধ আমার কাছে হাস্যকর মনে হয় । আমার ধর্ম আমার যুক্তি । মানুষের ধর্ম মানবতাবাদ । নিতান্ত আত্মরক্ষার কারনে ছাড়া অন্য কোন মানুষকোত করা উচিৎ নয়-এটাই আমার একমাত্র পালনীয় রীতি।
-সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় । ছবির দেশে কবিতার দেশে
‘যারা আস্তিক তাদের প্রতি আমার এই প্রশ্নটি করতে ইচ্ছ করে-তোমাদের ভগবান কি সত্যি সব মানুষকে ভালোবাসেন? এই যে একটা শহর –মনাকো-এখানে কিছু মানুষ নিছক জুয়া খেলাকে কেন্দ্রকরে দিব্যি সুখে আছে ,ভালো খাচ্ছে দাচ্ছে,সব রকম আরাম ভোগ করছেন । আর আমাদের দেশের একজন চাষা উদয়াস্ত পরিশ্রম করেও দুবেলা খেতে পায় না । তবু তোমরা বলবে সব মানুষের মধ্যে ভগবান আছেন? -ঐ ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।