আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

তথাকথিত আহলে হাদীসের আসল রূপ - পর্ব ০৪

মুফতী রফীকুল ইসলাম আল-মাদানীঃ আহলে হাদীস নাম ইংরেজের বরাদ্দকৃতঃ ১। বর্তমানে অবশ্য গাইরে মুক্বাল্লিদরা ওহ্‌হাবী বা সালাফী নামে আত্নপ্রকাশ করে সউদী রিয়াল, দিনার, দিরহাম উপার্জনের মোহে ব্যতিব্যস্ত। কিন্তু ১২৪৬ হিজরীতে, তাদের উদ্ভবের সূচনালগ্নে যখন তেল পেট্রোলের পয়সার জমজমাট ছিল না, ওহ্‌হাবীদেরই যখন দুর্দিন দুর্ভিক্ষ চলছিল, বিশেষ করে ভারতবর্ষে ইংরেজ-বিরোধী ও ইংরেজ বিতাড়নের জিহাদে যারা অংশ নিয়েছিলেন তাদেরকে ইংরেজ সরকার ওহ্হাবী বলে আখ্যায়িত করেছিল, তখন গাইরে মুক্বাল্লিদরা ওহ্হাবী নামের আখ্যা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যে মরিয়া হয়ে উঠেছিল। তাই তারা তখন নিজেদের জন্য “ মুহাম্মদী ” এবং পরবর্তীতে “ আহলে হাদীস ” নাম বরাদ্দ করার সম্ভাব্য সকল অপতৎপরতা চালিয়ে গিয়েছিল। এরই অংশ হিসেবে গাইরে মুক্বাল্লিদ্দের তৎকালীন অন্যতম মুখমাত্র মৌলভী মুহাম্মদ হুসাইন বাটালভী লাহোরী বৃটিশ সরকারের প্রধান কার্যালয় এবং পাঞ্জাব, সি-পি, ইউ-পি, বোম্বাই, মাদ্রাজ ও বাঙ্গালসহ বিভিন্ন শাখা অফিসে ইংরেজ প্রশাসনের আনুগত্যতা ও বশ্যতা স্বীকার করত: তাদের জন্য “ আহলে হাদীস ” নাম বরাদ্দ দেয়ার দরখাস্ত পেশ করেন।

এ দরখাস্তগুলোর প্রতি উত্তর সহ তারই সম্পাদনায় প্রকাশিত তৎকালীন “ এশায়াতুস সুন্নাহ ” পত্রিকায়ও প্রকাশ করা হয় যা পরে সাময়ীক নিবন্ধ আকারেও বাজারজাত করা হয়। ( এশায়াতুস সুন্নাহঃ পৃ: ২৪-২৬, সংখ্যা: ২, খ: ১১) ২। তাদের মানসিকতা ও লক্ষ্য-উদ্দেশ্য কিছুটা আঁচ করার জন্য পাঠক সমীপে তন্মধ্য হতে একটি দরখাস্তের অনুবাদ নিম্নে পেশ করছিঃ “বখেদমতে জনাব গভার্মেন্ট সেক্রেটারী, আমি আপনার খেদমতে লাইন কয়েক লেখার অনুমতি এবং এর জন্য ক্ষমাও পার্থনা করছি। আমার সম্পাদিত মাসিক “ এশায়াতুস সুন্নাহ ” পত্রিকায় ১৮৮৬ ইংরেজিতে প্রকাশ করেছিলাম যে, ওহ্হাবী শব্দটি ইংরেজ সরকারের নিমক হারাম ও রাষ্ট্রদ্রোহীর ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়। সুতরাং এ শব্দটি হিন্দুস্তানের মুসলমানদের ঐ অংশের জন্য ব্যবহার সমীচিন হবে না, যাদেরকে “ আহলে হাদীস ” বলা হয় এবং যারা সর্বদা ইংরেজ সরকারের নিমক হালালী, আনুগত্যতা ও কল্যাণই প্রত্যাশা করে, যা বার বার প্রমাণও হয়েছে এবং সরকারী চিঠি প্রত্রে এর স্বীকৃতিও রয়েছে।

অতএব, এ দলের প্রতি ওহ্হাবী শব্দ ব্যবহারের জোর প্রতিবাদ জানানো হচ্ছে এবং সাথে সাথে গভার্মেন্টের বরাবর অত্যন্ত আদব ও বিনয়ের সাথে আবেদন করা যাচ্ছে যে, সরকারীভাবে এ ওহ্হাবী শব্দ রহিত করে আমাদের উপর এর ব্যবহারের নিষেধাজ্ঞা জারি করা হোক এবং এ শব্দের পরিবর্তে “ আহলে হাদীস ” সম্বোধন করা হোক। আপনার একান্ত অনুগত খাদেম আবু সাঈদ মুহাম্মদ হুসাইন সম্পাদক, এশায়াতুস সুন্নাহ দরখাস্ত মুতাবেক ইংরেজ সরকার তাদের জন্যে “ ওহ্হাবী ” শব্দের পরিবর্তে “ আহলে হাদীস ” নাম বরাদ্দ করেছে। এবং সরকারী কাগজ-চিঠিপত্র ও সকল পর্যায়ে তদের “ আহলে হাদীস ” সম্বোধনের নোটিশ জারি করে নিয়মতান্তিকভাবে দরখাস্তকারীকেও লিখিতভাবে মঞ্জুরী নোটিশে অবহিত করা হয়। ৩। ক) সর্বপ্রথম পাঞ্জাব গভার্মেন্ট সেক্রেটারী মি: ডাব্লিউ, এম, এন (W.M.N) বাহাদুর চিঠি নং-১৭৫৮ এর মাধ্যমে ৩রা ডিসেম্বর ১৮৮৬ ইংরেজিতে অনুমোদনপত্র প্রেরণ করেন।

খ) অতপর ১৪ই জুলাই ১৮৮৮ ইং সি,পি গভার্মেন্ট চিঠি নং-৪০৭ এর মাধ্যমে গ) এবং ২০শে জুলাই ১৮৮৮ ইং ইউ,পি গভার্মেন্ট চিঠি নং-৩৮৬ এর মাধমে ঘ) এবং ১৪ই আগষ্ট ১৮৮৮ ইং বোম্বাই গভার্মেন্ট চিঠি নং-৭৩২ এর মাধ্যমে ঙ) এবং ১৫ই আগষ্ট ১৮৮৮ মাদ্রাজ গভার্মেন্ট চিঠি নং-১২৭ এর মাধ্যমে চ) এবং ৪ঠা মার্চ ১৮৯০ ইং বাঙ্গাল গভার্মেন্ট চিঠি নং-১৫৫ এর মাধ্যমে দরখাস্তকারী মৌলভী আবু সাইদ মুহাম্মদ হুসাইন বাটালভীকে অবহিত করা হয়। ( এশায়াতুস সুন্নাহঃ পৃ: ৩২-৩৯, সংখ্যা: ২, খ: ১১) ৪। কোন মুসলিম জামাতের নাম অমুসলিম, মুসলামানদের চিরশত্রু খৃষ্টান নাছারাদের মাধ্যমে বরাদ্দ করার ঘটনা ইসলামী ইতিহাসের পৃষ্ঠায় বিরল। যা কেবল হিন্দুস্তানী গাইরে মুক্বাল্লিদদেরই গৌরব ও সৌভাগ্যের বিষয় (!) তাই তারা এ ইতিহাসটা অত্যন্ত গৌরবের সহিত নিজেরদের পত্র-পত্রিকায় প্রকাশ করে তৃপ্তি লাভ করেছেন। সত্যিকার আহ্‌লে হাদীস কে? ১।

যুগযুগ ধরে হাদীস, উসূলে হাদীস, ফিক্বাহ, উসূলে ফিক্বাহ এবং হাদীসের ব্যাখ্যা ও হাদীসের বর্ণনাকারীদের ইতিহাসের কিতাব সমূহের ভাষ্য মতে, যারা হাদীসের সনদ ও মতন (বর্ণনাকারী ও মূল বিষয়) নিয়ে নিবেদিত এবং হাদীস শরীফের সংরক্ষণ, হিফাযত, সঠিক বুঝ এর অনুসরণ-অনুকরণে নিজের মূল্যবান জীবন উৎসর্গ করেছেন তাদেরকেই আহ্‌লে হাদীস বা আছহাবুল হাদীস বলা হয়। চাই সে হানাফী হোক বা শাফেয়ী, মালেকী অথবা হাম্বলী। ২। শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়্যা যাকে গাইরে মুক্বাল্লিদরাও অনুসরণ করে থাকে, তিনি বলেনঃ “ কেবল মাত্র হাদীস শ্রবণ, লিখন অথবা বর্ণনায় সীমাবদ্ধ ব্যক্তিদেরকেই “ আহলে হাদীস ” বলা হয় না বরং আমাদের নিকট “ আহলে হাদীস ” বলতে ঐ সমস্ত ব্যক্তিদের বুঝায় যারা হাদীস সংরক্ষণ, পর্যবেক্ষণ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ অর্থ অনুধাবন করার যোগ্যতা সম্পন্ন এবং প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ অর্থের অনুসারী হবে। ” ( নাক্বদুল মানতিকঃ পৃ – ১৮; কায়রো থেকে প্রকাশ ১৯৫১ ইং ) ৩।

আল্লামা হাফেয মুহাম্মাদ ইবনে ইব্রাহীম আল-অজীর (মৃঃ ৮৪০ হিজরী ) লিখেনঃ “ একটি জ্ঞাত কথা হল “ আহলে হাদীস ” বলতে ঐ ব্যক্তিকে বুঝায় যিনি এর প্রতি গুরুত্ব দিয়ে খেদমত করেছেন এবং এর অন্বেষণে জীবন বিসর্জন দিয়েছেন। ” উভয়ের বক্তব্যের দ্বারা এ কথাই পরিষ্ফুটিত হয় যে, আহ্‌লে হাদীস হতে হলে হাদীস সংরক্ষণ ও পর্যবেক্ষণে নিবেদিত প্রাণ হতে হবে। ফিক্বহে হাদীস তথা হাদীসের মর্মকথা অনুধাবন করতে হবে আর আমল করতে হবে সে অনুযায়ী। চাই সে যে মায্‌হাবেরই হোক না কেন। ৪।

কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপ ও আশ্চর্যের সাথে ব্যক্ত করতে হচ্ছে যে, গাইরে মুক্বাল্লিদরা “ আহলে হাদীস ” বলতে তাক্বলীদ অমান্যকারী একটি দল ও একটি নির্দিষ্ট মতবাদ বুঝায়। অনুরূপভাবে যেথায়ই আহলে হাদীস বা আহলুল হাদীস শব্দ দেখতে পাওয়া যায় এর দ্বারা তারা নিজেদেরকেই মনে করে, চাই সে জাহেল বা মূর্খ হোক, নামাযী হোক বা বেনামাযী হোক... হাদীস সম্বন্ধে তার কোন জ্ঞান থাক বা না থাক, কেবল আহলে হাদীস দলে ভর্তি হলেই আহলে হাদীস উপাধী পেয়ে যাবে। ( আখবারুল ইত্তেছালঃ পৃ – ৫, কলাম – ১, সংখ্যা – ২, ফেঃ ১৯৬২ আহলে হাদীসের তদানিন্তন জেনারেল সেক্রেটারী মাওলানা ইসমাইল কর্তৃক প্রকাশিত ) ৫। তাই এ দলের সবার উপাধি “ আহলে হাদীস ” যদিও তাদের অনেকেরই পেটে বোমা বিস্ফোরণ ঘটালেও একটি হাদীস নির্গত হবে না। উপরন্তু তাদের নামধারী আলেমদের অনেকেই ফিক্বহে হাদীস সম্বন্ধে কিঞ্চিত জ্ঞানও রাখে না, বুঝার চেষ্টাও করে না।

৬। এর প্রমাণ হিসেবে তাদেরই নেতা নবাব ছিদ্দিক হাসান খানের উক্তি পেশ করছিঃ “ আপনি তাদেরকে কেবল হাদীসের শব্দ নকল করতে দেখবেন, হাদীস বুঝার প্রতি তারা কোন ভ্রুক্ষেপই করে না, এতটুকু তারা নিজেদের জন্য যথেষ্ট বলে মনে করে অথচ এ ভ্রান্ত ধারণা মূল লক্ষ্য থেকে অনেক দূরে, কেননা হাদীসের কেবল শব্দের গন্ডীতে সীমাবদ্ধ না থেকে হাদীস বুঝা, এর অর্থ ও মর্ম নিয়ে গবেষণা করাই হল মূল উদ্দেশ্য। ” ( আল-হিত্তাহ ফী যিক্‌রিচ্ছিহাহ্‌ ছিত্তাহ্‌: পৃ – ৫৩ ) ৭। তিনি আরও লিখেনঃ “ আহ্‌লে হাদীস নামধারীরা লেনদেন বিষয়ক হাদীসের ফেক্বাহ তথা এর গূঢ়তত্ত্বে সামান্যতম জ্ঞান রাখে না। হাদীস ও আহ্‌লে সুন্নাতের নীতিমালা অনুসারে হাদীস থেকে একটি মাসায়ালা বা একটি শরয়ী বিধান নির্গত করতে তারা সক্ষম নয়।

তাদের মৌখিক দাবি অনুযায়ী আমল ও সুন্নতের অনুসরণের পরিবর্তে কেবল শয়তানী চক্রের অনুকরণই যথেষ্ট মনে করে। ” ( আল-হিত্তাহঃ পৃ – ৫১ ) ৮। তিনি আরও লিখেনঃ “ তাদের মধ্যে যদি নিষ্ঠা থাকত তাহলে কেবল প্রথাগত আহলে হাদীস আর নামে মাত্র কুরআন-কিতাবের অনুসারী হওয়াই যথেষ্ট মনে করতো না। ” ( আল-হিত্তাহঃ পৃ – ১৫৬ ) ৯। উপরোল্লেখিত আলোচনা থেকে বুঝা গেল যে, আহলে হাদীস দলে ভর্তি হলেই বা এ মতবাদ গ্রহণ করলেই অথবা আহ্‌লে হাদীস নামকরণেই প্রকৃত অর্থে “ আহলে হাদীস ” হওয়া যায় না।

বরং এর জন্য চাই অসীম ত্যাগ ও পরিপূর্ণ যোগ্যতা। আরও বুঝা গেল যে, বর্তমানে যাদের নাম “ আহলে হাদীস ” তারা কাজে ও বাস্তবে আহলে হাদীস নয়, তাদের নামে আর কাজে কোন মিল নেই। কেবল সরলমনা সাধারণ মুসলমানগণকে প্রতারণার জন্য ষড়যন্ত্রের ফাঁদ হিসেবে এ নামটি গ্রহণ করেছে। যেমন-জামের ন্যায় কালো মানুষের নামও অনেক সময় লাল মিয়া বা সুন্দর আলী রেখে থাকে। সত্যিকারার্থে “ আহলে হাদীস ” নামটি তারা তৎকালীন বৃটিশ সরকারের মাধ্যমে এর প্রকৃত অর্থ থেকে আত্নসাৎ করে নিয়েছে নিজেদের জন্য, যাতে করে সাধারণ মানুষ তাদেরকে পূর্বের যুগের প্রকৃত “ আহলে হাদীস ” মনে করে প্রতারিত হয়।

কিছু কথাঃ আমাদের বর্তমান প্রজন্ম যারা আহলে হাদীস নামধারী তারা অনেকেই তাদের নিজেদের প্রকৃত ইতিহাস জানে না। আমার এই পোস্টের মাধ্যমে যদি অন্তত একজন মানুষও যদি সত্য ইতিহাস জানতে পারে ও বুঝতে পারে, তাতে আমি এই পোস্টটিকে স্বার্থক মনে করব। এখানে আহলে হাদীসদের নিজেদের আলেমদেরও বিভিন্ন মতামত ও দলীল উল্লেখ করা হয়েছে, যা দ্বারা স্পষ্ট যে আহলে হাদীস নামটি ইংরেজদের দ্বারাই সৃষ্ট এবং ইতিহাস বলে তারা ইংরেজদের দালালী করে এসেছে, ইংরেজদের অধীনে মুসলমানদের থাকাকে যে কোন ইসলামী রাষ্ট্রের অধীনে থাকার চেয়েও উত্তম মনে করে, ইংরেজদের বিরুদ্ধে মুসলমানদের জিহাদ রোধ করার জন্য গ্রন্থ রচনা করে সেখানে জিহাদ মানছুখ বা রহিত প্রমাণ করার ব্যর্থ চেষ্টা চালায়। এই যাদের ইতিহাস তারা কিভাবে কোরআন ও সুন্নাহর সঠিক অনুসরণের দাবী করে, তা আমার কেন অনেক সত্যানুরাগী মুসলমানদেরই বুঝে আসে না ‍‍!! (চলবে ইনশাল্লাহ) ৩য় পর্বঃ ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.