একজন কবিতা শিল্পী ও সমাজ কর্মী ঈদের শাড়ী
মৌ মধুবন্তী
আমি ঈদে পাবনার শাড়ী চাই। হবে না। কেনো? কি এমন বেশী চাইলাম? বেশী তো চাও-ই-নি,বরং এতো কম কিছু চেয়েছ, তবু---এই বলে লহমা কান্না সামলে নেয়। মুহর্ত কিছুতেই বুঝতে পারছে না, লহমা কেন কাঁদছে।
সে বিষয়টা বদলে দেয়।
আজ কার কার গান শুনলে? কার কার না, বল কোন কোন রাগ শুনেছি। সারাদিন ধরে কেবল মধুবন্তী। তাই বুঝি? আচ্ছা শোনো ঈদে কিন্তু আমাকে তুমি কথা বলার জন্যও পাবেনা। কোথায় যাবে তুমি? অভিমানি কন্ঠে যেন উপছে ঢেলে দেয় কেউ কাপ্তাই লেক। অসভ্য।
হ্যাঁ আমি অসভ্য। যেদিন সভ্য হতে পারবো সেদিন তোমার পায়ের আঙ্গুল দিয়ে আমার কপালে লিখে নেব তোমার নাম, স্বজাতির উদ্দ্যেশ্যে জাতীয় ভাষণের অংশ স্বরূপ। তুমি আবার রাজনীতিতে ঢুকলে কবে? অসভ্যরা যা ইচ্ছে তাই করতে পারে। মুহুর্ত কিন্তু একবারো বুঝতে পারেনি লহমায় সে কতদূর চলে গ্যাছে।
মনে মনে লহমা তার যাবতীয় লঙ্গর গুছিয়ে নিয়েছে।
চুকিয়ে দিয়েছে ঢাকার পাট। ঢাকায় থেকে কত রকম করে জীবনকে ঢাকতে হয় সে শিখে নিয়েছে থিসিস পেপারের চেয়েও বেশী গভীর মনযোগ নিয়ে।
জানো দিদি, এই শাড়িটা না নান্নিতা দিয়েছে আমাকে বিক্রি করতে। দ্যাখো তো তোমার পছন্দ হয় কিনা। শাড়ির প্যাকেট দেখেই মধ্যকলি চমকে উঠে।
শাড়ির দিকে তাকিয়ে মধ্যকলি বলে, তুমি রেখে দাও শাড়িটা, সুন্দর তো। তপসা আবার মধ্যকলির পছন্দের অনেক দাম দেয়। তপসা বলে, না গো দিদি এতো দাম দিয়ে শাড়ি কিনে একদিন পরে লাভ হয় না। আর এটা তো নর্থ আমেরিকান কালচার। একদিনের বেশী এক শাড়ি কেউ পরে না।
ধ্যাৎ! আমিতো পরি, বলে মধ্যকলি। এই কথা শুনে তপসা আকাশ থেকে পড়ে। দিদি, তুমি এত ফ্যাশানেবল মানুষ, এক শাড়ি কি দুইবার পরো? বারে পছন্দের জিনিষ ১০ বার পরলেই বা কি? আমিতো শাড়ীর স্ট্যাটাস বিক্রি করিনা। আমি আমার রুচিমত চলি।
মধ্যকলি -শাড়ির দাম কত?
তপসা – ১০০ ডলার
মধ্যকলি – কমাবে না?
তপসা – না, একদাম
মধ্যকলি – দেখি কেউ নিলে বলব
তপসা – দেখো তো, আমি কি বিপদে পড়লাম।
আমি কাউকে জানিনা শুনিনা কোথায় কার কাছে বিক্রি করি? যে কয়জনকে চিনি দেখাইছি সবাই বলে ৪০ ডলার।
মধ্যকলি – দেখো তুমি যা ভালো বুঝো করো, হাজার হলেও তো তোমার বন্ধু। তোমাকে সে অনেক সাহায্য করে ।
তপসা – না গো ১০০ ডলারে এই শাড়ী কেউ নিবে না।
মধ্যকলি বিদায় নিয়ে চলে আসে ড্রাইভ ওয়েতে।
প্রাণ খুলে সে হাসলো। একজন পথিক জানতে চাইলো, কেনো এমন করে একা একা হাসছ? মধ্যকলি হাসির গমক থামিয়ে বলে, হাসির একটা দারুণ কারণ আছে। যে পথিক, তারো আগ্রহ তিন কাঠি উপরে। সে ভিন দেশী। তাকে এই শাড়ির গল্প নিশ্চিন্তে করা যায়, কারণ, সে কথা শোনা শেষ করে এক্ষুনি ফোন উঠিয়ে আসর পাতাবে না।
এই যে দেখছ, না, থাক। আমার হাসি আমারই থাকুক। তুমি যাও তোমার কাজে, আমি বাড়ি যাই।
কালো পীচের ড্রাইভ ওয়েতে একটা ইঁদুর কি সাবলীল দৌঁড়ে গেল। ইঁদুরটার স্বাধীন রকমের এই দৌঁড় দেখে মধ্যকলি ভাবছে, মানুষের জীবন যদি একবার এই ইঁদুর পেত? আর ঐ ইঁদুরের মত মানুষ যদি স্বাধীনভাবে দৌঁড়ে বেড়াতে পারত! হাসি চলে গেছে আকাশের কোনপ্রান্তে।
একটা গানের কলি বারে বারে মাথায় এসেই মিলিয়ে যাচ্ছে। আবার শাড়িটার রঙ এসে বলে, এই মধ্যকলি তুই কেনো আমার গায়ের রঙ পছন্দ করিসনি? দ্যাখ তুই যদি সেদিন আমাকে ৫০ ডলার দিয়ে কিনে নিতি তা হলে আমি কি আর এতগুলো হাতের ময়লার অত্যাচারে পড়তাম। তুই না মানবতাবাদি কথা বলিস? তা হলে এই যে আমি কয়েক গোছা সুতা তাকে কেন এমন অবলীলায় তুই হেলা করলি? গায়ের রঙ্গে কি আসে যায়? তুই ত আমাকে একটু আদর দিতে পারতিস। তুই জানিস না আমার জন্মের ইতিহাস। কত কষ্টে আমি সেই মেসিনের থেকে এই টরন্টো পর্যন্ত হাত বদল হলাম।
ভেবে দেখ এক জীবনে একটা মেয়ে কতবার হাত বদল হয়। জন্মের পর বাবা তার মালিক থাকে। আমার ছিল কারখানার মালিক বাবা। তারপর দোকানদার। মেয়েরা বিয়ের পরে স্বামীর অধীনে থাকে।
দোকানে এসে আমি সারা দিন দোকানদারের অধীনে খোলা আর ভাঁজ করার সেবা দিয়ে গ্যাছি। একটা মিনিট নিজের মত করে ঘুমাতে পারিনি। মধ্যকলি, রাস্তা পার হবে, সাবধান হতে হবে। কিন্তু শাড়ি তার গল্প বন্ধ করেনা। ইস কি ভয়ংকর এই সব আত্মকথা।
ইস্ট-ওয়েস্টের বাসের মধ্যে লেগে গ্যাছে প্যাছ। কোনটায় সে উঠবে? তাই শাড়িকে বলে, এই কথা থামা বাসে উঠে কথা শুনব। যেন শাড়ি সত্যি তাকে শুনতে পেয়েছে। সে বাস ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করে, আমি ইয়র্কমিল যাব। কোন দিকের বাসে উঠব? বাস ড্রাইভার হেসে উত্তর দিল, এইটাই তোমার বাস।
আই উইল লেট ইউ নো, হোয়েন স্টেশান কামস। মধ্যকলি একটা উঁচু সীট দেখে বসে পড়ে। চারিদিকে চোখ বুলিয়ে দেখলো, না তেমন কোন লোক নেই বাসে। লাল রঙের উঁচু সীট। পেছনের দরজার ঠিক বাঁ দিকেই দু’জনের সীটের মধে জানালার পাশটাই মধ্যকলি বেছে নিয়েছে।
অমনি শাড়ি এসে বলে, এবার বলি? মধ্যকলি নড়ে চড়ে বসে। মাথাটা একটু হেলিয়ে দেয় পেছনের হেড রেস্টের উপর। ইয়র্কমিল আসতে এখনো অনেক দেরী। চোখটা হালকা ভাঁজ করে রাখা। শাড়ির গল্পে সে ডুবে যায়।
সে দোকানদারের কাছ থেকে কোনক্রমে আমি নান্নিতার মালিকানায় আসি। কিন্তু ও কেনার পর থেকেই দোনোমোনো। আমাকে সে বিদেশে নিয়ে বিক্রি করে দেবে। আমিও মহা খুশী। বিদেশের লোকেদের এত শাড়ি পরার সময় নাই।
আর তারা বড় বড় পার্টিতে আমাকে রঙ ঢং করে পরবে। কত রকম গল্প করবে। কিন্তু আমি আজো বিক্রি হলাম না। এই দুঃখ ঠিক একটা মেয়ের বয়েস ছাব্বিশ বা আঠাশ হলেও যখন বিয়ে হয় না তখন তার যেমন লাগে আমারো তাই লাগছে গো। মধ্যকলি মন দিয়ে শুনে যায় শাড়ির গল্প।
তার কোন রকম প্রতিক্রিয়া নেই।
রুইয়ালী এলো, মধ্যকলির বাড়িতে বেড়াতে। এসেই বলে নান্নিতা আমাকে ঐ সেই শাড়িটা গিফট করতে চায়। আবার মধ্যকলি হাসিতে গড়িয়ে পড়ে। কিরে তুই এমন করে হাসিস কেনো রে।
আরে রুইয়ালী শোন, এই শাড়ির গল্প কাহিনী শুনতে শুনতে আমার এখন রাত যায়, দিন যায়, ভাটি যায় জোয়ার আসে, হাসি আসে। আমি শাড়িটা নান্নিতাকে ফেরৎ দেবার পরে, সে, একদিন খুব খুশি হয়ে বলে, এই তুমি আমার ভাগ্য ফিরিয়ে দিয়েছ। শাড়িটা আজ একজন খুব পছন্দ করে একশ ডলারে কিনে নিয়েছে। মধ্যকলি বলে, তা হলে চলো, একদিন দোসা খাওয়া যাক লাভের ডলারে। সেদিন নান্নিতা কথাটা এখানেই থামিয়ে দেয়।
মধ্যকলি লক্ষ্য করলেও নোটিশ করবার মত করে মনে রাখেনি। নান্নিতার কপালের ভাঁজ সে সেদিন দেখেও পড়তে পারেনি। মধ্যকলি শুধু ভেবেছে, এর জন্য ডলারগুলো এত দৌঁড়ে দৌঁড়ে ঘরে আসে কেনো? আমরা এত হাড় ভাংগা পরিশ্রম করি আর এ কেবল ফাও ডলার এখান থেকে পায়, ওখান থেকে পায়।
সেই শাড়ি এলো রুইয়ালীর বাড়ি ঈদের গিফট হয়ে। রুইয়ালী সব গল্প শুনবার আগেই শাড়ী নেবেনা এই তার পণ।
কারণ এই শাড়িটাকে সে প্রথম দিনই পছন্দ করেনি। যা অপছন্দের তা বিনা পয়সায় পেলেও রুইয়ালী সেটা পরে স্বাচ্ছন্দ বোধ করবে না। সেটা সে জানে। সে আবার অদ্ভুত রকমের। কাঁটায় কাঁটায় পছন্দ না হলে কোন জিনিষকে পাত্তা দেয় না।
এই রকম হাজারো জিনিষ পড়ে আছে তার ঘরে। কত জিনিষ সে পা দিয়েই সরিয়ে রাখে। এই কথা শুনেই মধ্যকলির মনের ভেতর হু হু করে উঠে। ঘুমরে ঘুমরে কান্নার ঢেউ ছলাৎ ছলাৎ ভেঙ্গে পড়ে মনসমুদ্রের সৈকতে। রুইয়ালী বলে, চল মধ্যকলি, কোথাও হেঁটে আসি।
তুমি না। আমি একা একটু কোথাও যাব। আমার ভেতরে একজন আমাকে খাবলে খাবলে খাচ্ছে। মধ্যকলি একা হতে চাইলো শাড়ির কারণে। জানতে চাইলো শাড়ির এখনকার মনের অবস্থা।
গ্রে ষ্টোন পার্কের একটা খালি বেঞ্চিতে এসে, সে নিরিবিলি বসে পড়ে। শাড়ি আবার গল্প শুরু করে। এই মধ্যকলি, আমি এখন কোথায় যাব? আমার কি একটু ঠাঁই হবেনা? মধ্যকলি বলে, দ্যাখ শাড়ি, আমার জীবন তোর চেয়েও বেশী গন্তব্য হারা। তোর সাথে আমার পার্থক্য হলো আমার মুখ আছে, ভাষা আছে। কিন্তু তোর নেই।
তুই শুধুই আমার সাথে কথা বলতে পারিস। মধ্যকলি এখানেও বসতে পারলোনা । অস্থিরতা তাকে একদম উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে। সে উঠে গাড়ি নিয়ে চলে গ্যালো লরেন্স ইস্টের বিচে। লোকজন খুব কম।
বিচের উলটো দিকে আছে একটা ব্যাক সোয়াম্প। তার উপর দিয়ে চলে গ্যাছে গো ট্রেনের লাইন সেই মিসিসাগা থেকে এসে সোজা ওশোয়া পর্যন্ত। ওশোয়া শুনেই শাড়ি বলে উঠে, সেও তো আমারই মত দেখি। শোবার বুঝি একটুও জায়গা নেই। এই মধ্যকলি, তুই এত নীরব কেনো? বলনা এই ঈদে আমার একটা গতি হবে কিনা?
কি করে জানব? শাড়ির দারুণ অভিমান।
সেও মধ্যকলিকে বলে না যে, তুই কেনো আমাকে তোর অঙ্গে অঙ্গে জড়িয়ে নিচ্ছিস না? এই কথা বলতে গেলেই শাড়ির বুক ফেটে কান্না আসে। সে যেদিন মধ্যকলির বাড়ি এসেছিল তার শাড়ির শেল্ভ দ্যাখে কি যে খুশী হয়েছিল। মনে মনে বলেছিল, ইস এমন অভিজাত পরিবেশে আমার আগামী দিন অনন্যরকম এক সম্ভ্রান্ত পৃথিবীর মুখ দেখবে। আর মধ্যকলি শাড়ির যা যত্ন করে। তার বাচ্চাদের মত।
আজ শাড়িকে ন্যাপথালিন দিচ্ছে, কাল ক্লজেটে সে হীট দিচ্ছে। পরশু সে শাড়ির ভাঁজ উলটে
দিচ্ছে, আবার সেভার ব্যাগে রাখছে। এমন যত্ন থেকে সে বিদায় নিয়ে আজ সারা টরন্টোয় এমন অবহেলায় হাত বদল হচ্ছে। এই অভিমান সে রাখে কোথায়? মধ্যকলি এর মাঝে বাউলের দর্শন নিয়ে ভাবছে। কাল যোলার সাথে কথা হলো বাউল দর্শন নিয়ে।
মধ্যকলি অবাক হলো। আসলে বাউলরা কেমন জীবন যাপন করে এই কথা যোলার মুখ থেকে শুনে। মদ আর নারী নাকি তাদের বাউল সঙ্গীতের এক বিরাট অংশ। কিযে অদ্ভুত দর্শন লেখে মানুষ আর যখন পালন করবার সময় আসে তখন সবাই খোলস পরে নেয়। শাড়ি তখই বলে উঠে, তো তুমি কি করছ? আমার জন্য এত মায়া লাগছে কিন্তু নিজের করে নিতে পেরেছ কি আমাকে? সেখানে তো একবারো দেখলাম না মায়া, দয়া, মানবিকতা।
সব ভন্ডামী। তুমিও সব টুকু টুকু ভাই না। মাঝে মাঝে হযবরল ভাই তুমি। মধ্যকলি মনে মনে হিসেব করে, অভিনয় করে, কি করে সে রুইয়ালীকে বলবে শাড়িটা সে চায়। শাড়ি যেই এই কথা টের পেলো, মধ্যকলির পায়ে মাথা ঠেকিয়ে পড়ে থাকে।
প্লীজ আমাকে তোমার কাছে নিয়ে আসো।
মধ্যকলি বিচের বালির উপর খালি পায়ে পায়চারী করছে। কখনো জলে পা ভিজিয়ে নিচ্ছে। একজন কালো লোক এসেই বলে, হানি ইউ আর সো ন্যাচার লাভার। ম্যান হোয়াট ডু ইউ গেট ফ্রম ন্যাচার? মধ্যকলি জিজ্ঞাস করে, হোয়াটস ইউর নেম? কালো লোকটা উত্তর দেয়, ব্ল্যাক ডিক।
মধ্যকলির দম বন্ধ হয়ে আসে। এমন নাম কোন বাবা-মা রাখতে পারে? সে পাত্তা না দিয়ে একটু ঘুর প্যাঁচ পথ নিয়ে বিচের উল্টোদিকে যেদিক থেকে সি এন টাওয়ার দেখা যায় সেদিকে চলে যায়। দূর থেকে সি এন টাওয়ার দেখতে কেমন লাগে? পৃথিবীর টলেস্ট একটা টাওয়ার এমন হাতের কাছে অথচ কয়বার সেখানে যাওয়া হয়? মানুষ দুরের জিনিষের প্রতি বেশী আকর্ষন অনুভব করে। সব স্বামীদের বউগুলো যদি এমন দুরের বিশেষ বিশেষ আকর্ষণ হতে পারত? তা হলে কতই না বিস্ময় জমা থাকত তাদের জন্য। আদর জমা থাকত।
আলোচনা জমা থাকত। জমা থাকত অনেক অনেক ডলার। তাদের জন্য বিশেষভাবে খরচ করবার জন্য।
শাড়ি বলে এই মধ্যকলি, তুই এখন সি এন টাওয়ার নিয়ে এতো ভাবছিস কেনো? টাওয়ারের তো অনেক খাতিরের লোক আছে। আমার দিকে দ্যাখ না।
লেকের জলের দিকে তাকাতে তাকাতে সুর্যটা টুপ করে জলে মধ্যে ডুবে গেলো। মধ্যকলির মন ছুটে গেল তার ঘরে। সে এখন আর কিছুতেই কোথাও স্বস্তি পাবে না। ছুটছে তো ছুটছে। বাড়ি এসেই, দেখে মেসেজ ঝুলছে দরজায়।
পোস্ট অফিসে তার জন্য একটা প্যাকেজ আছে। নোটিস কার্ড টা হাতে নিয়ে আবার ফিরে যায় গ্যারাজে। গাড়ি নিয়ে দ্রুত চলে যায় পোস্ট অফিসে। যেন এক্ষুনি পোস্ট অফিস বন্ধ হয়ে যাবে এমন ভাব। আসলে পোস্ট অফিস বন্ধ হতে এখনো আরো ২ ঘন্টা বাকী।
তবু তর সইছেনা। কি এলো? কে পাঠালো? কেনো পাঠালো? তার তো এমন কেউ নেই যে তাকে ঈদের গিফট পাঠাবে। এই সব কথা ভাবাবার মত দুরত্ব নয় পোস্ট অফিস আর বাড়ির মাঝে। লাইন নাই। সোজা গিয়ে কাউন্টারে দাঁড়ালো।
আই ডি হিসাবে সে ড্রাইভিং লাইসেন্স টা বের করেই রেখেছে আগে। কাউন্টারের ভেতর থেকে সেই বহুদিনের চেনা লিন্ডা হাত বাড়িয়ে নোটিশটা নিয়ে ভেতরে চলে গেলো। শাড়ি এসে বলে, মধ্যকলি, এটা তোর শাড়ি, তুই আমাকে ফেলে দিস না। প্লিজ় আমাকে একটু তোর গায়ে ঠাঁই দে। সত্যি বলছি আমি দেখতে একটুও মন্দ না।
আমার কম্বিনেশানটা একটু ভিন্ন রকমের । আর তুইতো বিশেষ কিছুই পরতে পছন্দ করিস।
লিন্ডা একটা বাদামী রঙের প্যাকেট নিয়ে এসে, ড্রাইভিং লাইসেন্স নিরীক্ষা করে তাকে ডিজিটাল সাইন প্যাডে সাইন করতে বলে প্যাকেট টা এগিয়ে দেয়। মধ্যকলি পারলে একটানে সেই প্যাকেট খুলে ফেলে। কিন্তু গালা সীল করা।
লিন্ডাকে বলে, মে আই হ্যাভ আ সিজার? লিন্ডা মধ্যকলিকে চেনে অনেক দিন থেকে। সিজার দিয়ে নিজেই প্যাকেটের একপাশ কেটে দিয়ে প্যাকেট টা ফেরৎ দেয় মধ্যকলিকে। মধ্যকলি খোলা প্যাকেটের ভেতর থেকে মুখ বাড়িয়ে থাকা পাবনার শাড়ির দিকে তাকিয়ে আছে। শাড়ির কথা ভেবে পাবনাকে ধরতে সাহস পাচ্ছেনা। কিন্তু লহমা এমন করে সারপ্রাইজ দিতে পারে সে কল্পনাও করতে পারেনি।
প্যাকেটা টা একটু খুলে সে শাড়ির রং দেখে মুগ্ধ। তার প্রিয় পেঁয়াজ রঙের শাড়ি। সাথে কাঁঠালী চাঁপা রঙের ব্লাউজ। কাস্টম মেড বানানো।
সেই প্যাকেট নিয়ে মধ্যকলি সোজা যায় রুইয়ালীর বাড়ি।
ব্যাগ থেকে কড় কড়ে একটা গাঢ় গোলাপী রঙের পঞ্চাশ ডলারের নোট বের করে রুইয়ালীর টেবিলে রেখে বলে শাড়ি টা দাও আমাকে। রুইয়ালীর চোখ চক চক করছে কাঁচা পঞ্চাশ ডলার দেখে। সে হাসতে হাসতে শাড়িটা তুলে দেয় মধ্যকলির হাতে। দুইটা শাড়ি মধ্যকলি বুকে জড়িয়ে ফিরে আসে তার একান্ত ঘরে। বিছানায় দুটো শাড়িকে খুলে মেলে দেয় পাশা পাশি।
মাঝে ব্লাউজটাকে। দুটো শাড়িকে চুমুতে চুমুতে ভরিয়ে দিয়ে সে মধ্যকলি হু হু করে কাঁদতে গিয়েই খিল খিল করে হেসে উঠে হাতে তুলে নেয় টেলিফোন। ব্যালান্স কত আছে কে জানে। নাম্বার ডায়াল করতেই অপর প্রান্ত থেকে ভারী গলায় একটাই প্রশ্ন, পছন্দ হয়েছ তো? আই লাভ ইউ। আই মিস ইউ।
সাথে সাথে কান্নার আওয়াজ আর গমকে গমকে ভেসে আসে সুদুরের তিয়াসা মাখা সেই সব শব্দ। যা লহমা আর মুহুর্ত রাতের পর রাত বলত দিনে পর দিন বলত। মুহুর্ত দু’টো শাড়িকে দুইদিক থেকে কাঁধের উপর ফেলে দিয়ে ওয়েভ ক্যামের সামনে দাঁড়ায়। দু’টো শাড়ির মাঝে মুহুর্তকে দেখে লহমা মুহুর্তেই হারিয়ে যায় তার সেই ট্রেনের কামরায়। কি কষ্ট করেই না সে সেদিন পাবনার ট্রেন ধরেছিল।
না, না এইভাবে আমার ভালোবাসা হারিয়ে যেতে পারেনা। এ আমার । একটা শাড়ি চাই। পৃথিবীর সব চেয়ে কম দামের শাড়ি, তবু সে হবে আমার কাছ থেকে মুহুর্তের জন্য পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ উপহার। লহমা আর মুহুর্ত একাত্মা হয়ে যায়, লীন হয়ে যায় দুই শাড়ির মাঝে।
মাঝে ওয়েভ ক্যাম স্থির তাকিয়ে থাকে। এমন ঈদ একবারই আসে একজীবনে। মুহুর্তের ঠোঁট ডুবে যায় লহমার ঠোঁটের হৃদে।
মঙ্গলবার, ৭ সেপ্ট, বিশদশ(২০১০)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।