D:\Picnic-2010\503.jpg মা-বাবা আদর করে নাম রেখেছিলেন শাওন। কিন্তু তার অতি আদরের ছোট বোন তাকে ছোটবেলা থেকে শান বলেই ডাকে। শান ভাইয়া। যখন থেকে সে কথা বলা শিখেছে তখন থেকেই তার নামের মধ্যাক্ষর 'ও' বাদ দিয়ে শান ভাইয়া বলে ডাকে। মা-বাবাও তাকে এখন এ নামেই ডাকেন।
শান সেটা মানিয়েও নিয়েছে। তার প্রিয় সংগীত শিল্পির নামও একই হওয়ায় 'শান' নামটি তার নিজের কাছেও ভালো লাগে। যদিও সনদপত্র অনুযায়ী এখনও তার নাম শাওন মাহমুদ। অন্যান্যদের মতো বন্ধুরাও তাকে শান বলেই ডাকে। বন্ধুরা প্রায়ই ব্যঙ্গ করে বলে- "ভদ্র ছেলে শান, তুমি করোনা এতো অভিমান, আরও কতকিচ্ছু..................!"
বন্ধুদের সাথে শান সবসময়ই ভালো সম্পর্ক বজায় রাখে।
ছোট বোনের সাথে সবসময় ঝগড়া-বিবাদে লেগে থাকলেও বন্ধুদের সাথে কখনোই ঝগড়া-বিবাদে যেতে সে মোটেই পছন্দ করেনা। ছোট বোন তো সুযোগ পেলেই ছড়া কাটে- "আমার লক্ষী ভাইয়া শান, তোমাকে নিয়ে সবাই করে ফান....................!"
বন্ধুদের সাথে ঘোরাঘুরি করা, আড্ডা দেওয়াই তার কাছে বেশী পছন্দের। সুযোগ পেলেই বন্ধুদেরকে নিয়ে সে কাছে কিংবা দূরে ভ্রমণের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যায়। ভ্রমণ তার কাছে নেশার মতো।
ক'দিন ধরে সে পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার যাওয়ার কথা ভাবছে।
বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ করে কক্সবাজার যাওয়ার জন্য শান কাউকে রাজী করাতে পারলোনা। ঠিক কি কারণে বন্ধুরা যাবেনা সেটি সে বুঝতে পারলোনা। ছোটবেলা থেকেই জেদী শান বন্ধুদের রাজী করাতে না পারলেও একাকী কক্সবাজার যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। সে ভালো করেই জানে- একাকী ভ্রমণ খুব বেশী আনন্দদায়ক হয়না। তবুও সমুদ্র ভ্রমণে সে যাবেই- আনন্দ না হোক, অন্তত সমুদ্র তো দেখা যাবে।
সিলেট থেকে কক্সবাজরের দূরত্ব কয়েকশ মাইলেরও বেশী। ট্রেন এবং বাস উভয় মাধ্যমেই যাওয়া যায়। শান একবার তার বন্ধু মিঠুন এর বাড়ীতে ট্রেনে করে গিয়েছিলো। ট্রেনের ভ্রমণটা তার বেশ ভালো লেগেছিলো। বিশেষ করে ঝাকুনির তালে তালে ঝনঝনাঝন শব্দ করে ট্রেনের এগিয়ে চলা বেশ উপভোগ্য ছিল।
সরাসরি কক্সবাজার পর্যন্ত যেতে না পারলেও চট্রগ্রাম পর্যন্ত তো ট্রেনে যাওয়া যাবে। তাই এবার সে ট্রেনে করে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল।
নানান ঝক্কি-ঝামেলা করে শান একটি টিকেট সংগ্রহ করেছে। টিকেট কালোবাজারীদের দৌঁড়ঝাপ এবং দাপট দেখে সে খুবই অবাক হলো। টিকেট কাউন্টার থেকে সহজেই ন্যায্য মূল্যে টিকেট পাওয়ার কথা থাকলেও যাত্রীদেরকে চড়া দামে কালোবাজারীদের কাছ থেকে টিকেট সংগ্রহ করতে হচ্ছে।
শান বাসায় ফিরে গরম স্বরে মাকে বলল- "টিকেট পাওয়াটাও যেন আজকাল সোনার হরিণ পাওয়ার মতো হয়ে গেছে। সব জায়গায় দু'নম্বরি!" কেউ দেশপ্রেম নিয়ে কাজ করে না। সততার সাথে কি কেউ কোথাও কাজ করবে না? মা ভাত দাও। তাড়াতাড়ি যেতে হবে, না হলে ট্রেন মিস করব। আমি একটু আগে-বাগেই ষ্টেশনে যাবার জন্যে বেরুতে চাই, যাতে সময়মত ষ্টেশনে পৌঁছতে পারি।
রাস্তায় যদি ট্রাফিক জ্যামে আটকা পড়ে যাই!
মা বললেন- "দিচ্ছি বাবা, তুই তৈরী হয়ে নে। "
অন্যান্য দিনের চেয়ে শান রাতের খাবার একটু তাড়াতাড়ি খেয়ে ফেলল। ষ্টেশনের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেওয়ার পূর্বে যথারীতি মা ও ছোটবোন কুসুমের কাছ থেকে সে বিদায় নিল।
"মা দোয়া কর, কুসুমের দিকে খেয়াল রেখো। "
কুসুমকে ডেকে সে বলল- "এই কুসুম দুষ্টুমি করিস না, মায়ের কথা শুনিস।
তোর কোন আবদার থাকলে বলতে পারিস। "
"আমার জন্যে একটি পুতুল নিয়ে এসো, ভাইয়া। আর তুমি ঠিকঠাকমতো ফিরে এসো। আমার আর কিচ্ছু লাগবেনা। "
কুসুম তার প্রিয় শান ভাইয়ার সাথে কয়েকদিন দুষ্টুমি করতে পারবেনা, ঝগড়া করতে পারবে না ভেবে ভেবে কষ্ট পাচ্ছে আর লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদছে।
সৌভাগ্যক্রমে ঐদিন রাস্তায় কোন ট্রাফিক জ্যাম ছিল না। তাই তাকে রাস্তায় দীর্ঘক্ষণ আটকে থাকতে হয়নি। ট্রেন ছোড়ার অনেক আগেই সে ষ্টেশনে পৌঁছে গেল। ট্রেন ছাড়ার সময় ছিল ন'টায়। ষ্টেশন মাস্টারকে গিয়ে সে জিজ্ঞেস করল- "অনুগ্রহপূর্বক আমাকে কি একটি তথ্য জানাবেন?"
"কি তথ্য?"
"উদয়ন এক্সপ্রেস ট্রেনটি কখন ছাড়বে?"
"ন'টায় ছাড়ার কথা, কিন্তু আজ এক ঘন্টা বিলস্বে দশটায় ছাড়বে।
আপনি দয়া করে বিশ্রামাগারে গিয়ে বিশ্রাম নিতে পারেন। "
পার্শ্ববর্তী স্টল থেকে দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকাটি সংগ্রহ করে সে বিশ্রামাগারের কর্ণারের একটি চেয়ারে বসল। বিশ্রামাগারের আশপাশের পরিবশে খুব একটা ভালো নয়। প্রশাব করার প্রয়োজনে ষ্টেশনের পুরুষদের বাথরুমে গিয়ে দেখে সেখানকার অবস্থাও ভালো নয়। বাথরুমে পানি থাকে না, বৈদ্যুতিক বাতি থাকে না, সবসময় নোংরা থাকে- এসব গল্প সে এর আগে অনেক শুনেছে।
বাথরুম পরিবেশ সম্মত না হওয়া সত্ত্বেও চোখ বন্ধ করে তার কাজটা সেরে ফেলল।
ফেরিওয়ালাকে ডেকে এক প্যাকেট চিপস্ কিনে খেয়ে খেয়ে সে যথারীতি পত্রিকা পড়তে থাকে।
পত্রিকা পড়ার পাশাপাশি ষ্টেশনের বিচিত্র সব দৃশ্য দেখতে থাকে। হরেক রকমের মানুষের হরেক রকম কার্যক্রম। একেকজন একেক ধান্দা করছে।
কেউ যাত্রীদের পকেট মারার, টিকেট কালো বাজারীরা চড়া দামে টিকেট বিক্রি করার, কেউ বিভিন্ন উপায়ে যাত্রীদের ঠকানোর আবার কেউবা যাত্রীদের মালমাল বহন করার বিনিময়ে কিছু রুজি-রোজগার করার। এদিকে যাত্রীরা তাঁদের গন্তব্যে পৌঁছার ধান্দায় ব্যস্ত। ষ্টেশন থেকে কিছু লোক যাচ্ছে আবার নতুন করে কিছু লোক ষ্টেশনে আসছে। সবসময় ব্যস্ততা লেগেই আছে।
শান যে ট্রেনে করে যাবে সেই ট্রেন ছাড়ার আগেই সুরমা মেইল ট্রেন ছাড়বে।
এখন সুরমা মেইল ট্রেনটি ছাড়ার সময় হয়ে যাচ্ছে। যাত্রীরা ট্রেনের বিভিন্ন কামরায় উঠার জন্যে হুড়োহুড়ি শুরু করে দিয়েছেন। ট্রেনটি যেহেতু রাতে ছাড়বে তাই ট্রেনের যাত্রীদের নিরাপত্তার জন্যে ট্রেনে পর্যাপ্ত পরিমাণে পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। দিনের বেলায়ও পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা রাখা হয়, বলা তো যায়না- কখন কি হয়!
ট্রেনে যাত্রীদের হুড়োহুড়ি করে উঠার দৃশ্য দেখে কয়েক বছর আগে এই ষ্টেশনে ঘটে যাওয়া একটা ঘটনার কথা শানের মনে পড়ে যায়- 'ষ্টেশনে অপেক্ষমান সুরমা মেইলের একজন যাত্রীকে পুলিশ মারধর করছিল। কৌতুহলী লোকজন মূহূর্তের মধ্যেই ঐ যাত্রীকে দেখতে ভিড় জমিয়ে ফেলল।
উপস্থিত লোকজনদের জিজ্ঞেস করেও কারণটি পরিষ্কারভাবে বুঝা গেল না। আসলে মারধরের কারণ হয়তো সবাই জানে। কিন্তু অদৃশ্য কারণে কেউ বলল না। '
যাক, শান যে ট্রেনে যাবে সে ট্রেনটি ছাড়তে এখনোও অনেক দেরী। তাই সে যথারীতি পত্রিকা পড়তে থাকল।
পত্রিকাটি পড়তে পড়তে ততক্ষণে সে ষ্টেশনের চেয়ারে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল। ঘুম থেকে উঠে সে জানতে পারলো- কিছুক্ষণ আগে 'উদয়ন এক্সপ্রেস' ট্রেনটি চট্রগ্রামের উদ্দেশ্যে ছেড়ে চলে গেছে। এ যাত্রায় তাঁর আর কক্সবাজার যাওয়া হলো না। সে বাসায় ফিরে এলো।
মা জিজ্ঞেস করলেন- "তোর তো কক্সবাজার যাওয়ার কথা।
তুই কি ট্রেন মিস করেছিস? না-কি আজও ট্রেন চট্রগ্রামের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়নি?" (বিভিন্ন অজুহাতে ট্রেন প্রায়ই গন্তব্যের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়না। এটা শানের মায়ের আগে থেকেই জানা ছিল। )
শান মাকে জানাল- "মা, ট্রেন ঠিকই ছেড়ে গেছে, কিন্তু আমি যেতে পারিনি। পত্রিকা পড়তে পড়তে আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ঘুম থেকে উঠে দেখি...................!"
পাশ থেকে কুসুম বলল- "আমি জানতাম, ভাইয়া এরকম একটা কান্ড ঘটাবে।
ভাইয়া তো প্রায়ই পড়ার টেবিলে বসেও ঘুমিয়ে পড়ে। "
শান মাকে বলে- "মা, আজ ষ্টেশনের বিশ্রামাগারে যখন ঘুমিয়েছিলাম তখন আমি একটা স্বপ্ন দেখেছি। "
মা বললেন- "কি স্বপ্ন?"
শান মাকে স্বপ্নটি বলে- "ষ্টেশনের প্ল্যাটফর্ম থেকে শুরু করে বিশ্রামাগার, বাথরুম সবকিছুই খুবই ঝকঝকে পরিষ্কার। টিকেট কাউন্টার থেকে সবাই নিজ নিজ টিকেট সংগ্রহ করছে। কোন টিকেট কালোবাজারী নেই।
এরপর নির্দিষ্ট সময়ে সিলেট থেকে ছেড়ে ট্রেনটি চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে যাচ্ছে। ট্রেনের শব্দ আর ঝাকুনিটাকে সবাই বেশ উপভোগ করছে। সবকিছু পিছনে ফেলে ট্রেনটি অবিরাম গতিতে গন্তব্যের দিকে ছুটছে। তার সামনে কোন বাধা বিপত্তি নেই। চলার সময় ট্রেনকে একটা দানবের মত মনে হচ্ছে।
মনে হচ্ছে যেন- সে কত শক্তিশালী, সবকিছু চুরমার করে শুধুই এগিয়ে চলছে। ট্রেনটি কখনও বিস্তির্ণ মাঠ আবার কখনও পাহাড়-জঙ্গল পেরিয়ে গন্তব্যের দিকে ছুটে চলছে। শুধু ষ্টেশনে ষ্টেশনে তাকে মাঝে মধ্যে বিরতি নিতে হচ্ছে। যাত্রীরা সে সুযোগে খুব দ্রুততার সাথে উঠানামা করছে। যারা নামছে তারা নিজ নিজ গন্তব্যে যাচ্ছে আবার যারা উঠছে তারাও পরবর্তী গন্তব্যে যাবার জন্যে নিজ আসনে বসছে।
ট্রেনে কেউ গান করছে, কেউ গান শুনছে আবার কেউবা জানালা দিয়ে অপরূপ বিচিত্র সব প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখছে। যে জানালা দিয়ে অপরূপ সৌন্দর্য দেখছে সে কল্পনায় এক অজানার স্বপ্নের রাজ্যে চলে গেছে, আর ভাবছে- এখন যদি প্রিয়জন তার পাশে থাকত। ট্রেন তার গন্তব্যের দিকে ঠিকই এগিয়ে যাচ্ছে। ট্রেন চালকের একটাই চিন্তা, যাত্রীদের ঠিক-ঠাক মত তাঁদের নিজ নিজ গন্তব্যে পৌঁছানো। যাত্রীদের সেবায় নিয়োজিত ব্যক্তিরা তাঁদের দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে পালন করছেন।
যাত্রীরা যাতে কোন ধরণের অসুবিধা কিংবা দূর্ভোগের সম্মুখীন না হন ট্রেন কর্মীরা সেদিকে সার্বক্ষণিক খেয়াল রাখছেন। ট্রেনের ভেতরেই যাত্রী সাধারণের জন্য চা-নাস্তার ব্যবস্থা আছে। আছে সুপেয় পানির ব্যবস্থাও। ট্রেনের প্রতিটি কামরায় বাথরুমের ব্যবস্থা আছে। কর্মীরা বাথরুমগুলো প্রতিনিয়ত পরিষ্কার রাখছেন।
বাথরুমে সবসময় পানি থাকছে কিনা সেটাও কর্মীরা নজরে রাখছেন। যাত্রীরা যার যার আসনে ঠিক-ঠাক মতো বসতে পেরেছেন কি-না সতর্কতার সাথে কর্মীরা সেটাও নজরে রাখছেন। কোন কামরাতেই যাত্রী দাঁড়িয়ে নেই। মাঝখান দিয়ে হাটার রাস্তাটা একবারেই ফাঁকা। যাত্রীরা মনের আনন্দে এক কামরা থেকে অন্য কামরায় যেতে পারছে।
সবার কাছে টিকেট আছে কি-না সেটা কর্মীরা এক এক করে চেক করছেন এবং দেখতে পাচ্ছেন সবার সংগ্রহেই টিকেট আছে। ট্রেনে কোন দুষ্টু লোকের উপদ্রব নেই বা সোজা কথায় বললে চোর-ডাকাতের কোন উপদ্রব নেই। আর থাকবেই বা কি করে নিরাপত্তারক্ষীরা সার্বক্ষণিক দৃষ্টি রাখছেন- যাতে কোনভাবেই চোর-ডাকাত ট্রেনের ভেতরে ঢুকে যাত্রীদের ক্ষতি করতে না পারে। এদিকে ট্রেন তার গন্তব্যের দিকে আপন গতিতে ছুটে চলেছে। গহীন পাহাড়-জঙ্গলের ভেতর দিয়ে বয়ে চলা রেললাইন দিয়ে অন্ধকারের মধ্যে ট্রেন ঝনঝনাঝন শব্দ করে ছুটে চলেছে।
কোথাও কোন সমস্যা নেই। সবাই অতি অনন্দের সাথে ট্রেন ভ্রমণ করছে। নির্দিষ্ট সময়ে ট্রেন গন্তব্যে পৌঁছে গেল। যাত্রীর যার যার গন্তব্যে চলে গেলেন। কোথাও কোন সমস্যা হলোনা।
"
শানের স্বপ্ন শুনে মা বললেন- "বাস্তবে কি এরকমটি হয়? তোর স্বপ্নটা যদি সত্যি হতো? "
"মা- স্বপ্নটা কি সত্যি হতে পারেনা? " ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।