প্রায় বছর খানেক আগে ২০১১ সালের ২১ এপ্রিল ভৈরব-সাচনা-সুনামগঞ্জ রুটে চলাচলরত এমভি বিপাশা নামক একটি লঞ্চ ভৈরব হতে যাত্রী ও মালামাল নিয়ে সাচনা যাবার পথে মেঘনা নদীতে অন্য একটি নিমজ্জিত কার্গো জাহাজের সাথে ধাক্কা লেগে ডুবে যায়, প্রাণ যায় ৩৩ জন যাত্রীর। এই ঘটনার পর যথারীতি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয় এবং তদন্ত রিপোর্টে দুর্ঘটনার সম্ভাব্য কারণ ও তার প্রতিকারের জন্য অনেকগুলো সুপারিশও করা হয়। গত তিরিশ বছরে এরকম ৬শ’রও বেশি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে যেগুলো আলোর মুখ দেখেনি বা দেখলেও সুপারিশগুলো বাস্তবায়িত হয়নি।
গত সোমবার রাতে মেঘনা নদীতে মুন্সীগঞ্জের গজারিয়ায় শরীয়তপুর থেকে ঢাকাগামী এমভি শরীয়তপুর-১ নামক লঞ্চটি যদিও নিমজ্জিত কার্গো জাহাজের সাথে ধাক্কার বদলে চলমান একটি কার্গোর জাহাজের ধাক্কায় ৭০ফুট পানির নীচে ডুবে যায়, আমরা মনে করি, এমভি বিপাশা’র তদন্ত রিপোর্টটিতে ধাক্কা লেগে লঞ্চ ডুবে যাওয়া বিষয়ে যে কারিগরী ও ব্যাবস্থাপনাগত ত্রুটির কথা এসেছে, তার বেশির ভাগই এবারের ’দুর্ঘটনা’র ক্ষেত্রেও প্রাসঙ্গিক। সমস্যা চিহ্নিত করার পরও যদি সেই সমস্যার সমাধান না করা হয় এবং তার ফলে যদি কোন দুর্ঘটনা ঘটে, মানুষের মৃত্যু হয় তখন সেটাকে আর দুর্ঘটনা বলা যায়না, তখন সে ঘটনা হয়ে যায় হত্যাকান্ড।
এই আলোচনার মাধ্যমে প্রশ্ন তুলতে চাই, আর কিছু না হোক, অন্তত: এক বছর আগের এমভি বিপাশার ডুবে যাওয়া বিষয়ক তদন্ত রিপোর্ট যদি বাস্তবায়িত হতো তাহলে কি এমভি শরীয়তপুর-১ লঞ্চটির সাথে রাত্রীকালে কোন কার্গো জাহাজের সাথে সংঘর্ষ হতো? সংঘর্ষ হলেও কি লঞ্চটি ডুবতো? কোন কারণে লঞ্চটি ডুবলেও কি এত যাত্রী খুন হতো?
সংঘর্ষের সম্ভাব্য কারণ: নৌ-রুটে রাতে নৌ-চলাচলের সহায়ক যন্ত্রপাতি না থাকা
সড়ক বা রেলপথের চেয়ে অপেক্ষাকৃত প্রসস্ত নেভিগেশন চ্যানেলের নদী পথে নৌযানগুলোর পরস্পরের সাথে সংঘর্ষের বিষয়টি এমনিতে খুব অস্বাভাবিক। কিন্তু রাত্রিকালীন নৌ চলাচলের জন্য যদি নৌ-রুটে রাত্রিকালীন নৌ-চলাচল সহায়ক যন্ত্রপাতি না থাকে তাহলে নৌযানগুলোর রাত্রিকালে সংঘর্ষের মধ্যে পড়ার ঝুকি বেড়ে যায়। এ বিষয়ে ভৈরব-সাচনা-সুনামগঞ্জ রুটে চলাচলকারী এমভি বিপাশার দুর্ঘটনার কারণ সম্পর্কে বলতে গিয়ে তদন্ত রিপোর্টটিতে বলা হয়:
”...ভৈরব-সাচনা-সুনামগঞ্জ নৌ-রুটে রাত্রিকালীন নৌ-চলাচল সহায়ক যন্ত্রপাতি নেই। বিআইডব্লিউটিএ হতে প্রাপ্ত তথ্য হতে দেখা যায় যে, বিগত ৩০ বৎসরেরও অধিককাল যাবৎ ভৈরব-সাচনা-সুনামগঞ্জ রুটসহ বিপুলসংখ্যক রুটে রাত্রিকালীন নৌ-সহায়ক যন্ত্রপাতি না থাকলেও রুট পারমিট প্রদান অব্যাহত আছে। রাত্রিকালীন নৌ-যোগাযোগ ব্যবস্থা নিরাপদ রাখার স্বার্থে নৌ-সহায়ক যন্ত্রপাতির আবশ্যকতা রয়েছে।
তাছাড়াও বিআইডব্লিউটিএ’র নৌ-নিরাপত্তা ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা বিভাগ সূদীর্ঘকাল যাবৎ রুট পারমিট জারী করছে এবং অন্যদিকে বিআইডব্লিউটিএ’র নৌ-সংরক্ষণ ও পরিচালন বিভাগ নদী বিজ্ঞপ্তি দ্বারা রাত্রিকালীন চলাচল বারিত করছে। প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায় বর্তমানে বিপুল সংখ্যক রুটে রাতে চলাচল উপযোগী নৌ-সহায়ক যন্ত্রপাতি না থাকলেও সূদীর্ঘকাল যাবৎ রুট পারমিট নিয়ে লঞ্চ চলাচল অব্যাহত আছে এবং এ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টিকে কখনও কেউ আমলে আনে নি। এতে সুষ্পষ্টই প্রতীয়মাণ হচ্ছে যে, বিআইডব্লিউটিএ’র নৌ-সংরক্ষণ ও পরিচালন বিভাগ এবং নৌ-নিরাপত্তা ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা বিভাগ-এর কাজের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব রয়েছে। তাছাড়া প্রদত্ত রুট পারমিট বিবেচনায় জারীকৃত নৌ-বিজ্ঞপ্তির অসম্পূর্ণতা রয়েছে। ”
এই যে তদন্ত রিপোর্টে ”বিপুল সংখ্যক রুটে” রাত্রিকালীন নৌ-চলাচল সহায়ক যন্ত্রপাতি না থাকার সমস্যার কথা বলা হয়েছিল, শরীয়তপুর-ঢাকা রুটে কি তার ব্যাবস্থা করা হয়েছিল ? শুধু ঢাকা- শরীয়তপুর রুটই না কোন রুটেই কি রাত্রিকালীন নৌ-চলাচল সহায়ক যন্ত্রপাতির ব্যাবস্থা করা হয়েছে? ব্যাবস্থা হয়ে থাকলে তো একটা কার্গো জাহাজ একটা লঞ্চকে ধাক্কা দেয়ার কথা না।
ব্যাবস্থা যদি না হয়ে থাকে তাহলে কেন হয় নি? এর দায় কার? তদন্ত রিপোর্টের সুপারিশ ১০.০৮ এ সুস্পষ্ট করে যে ”নৌ-পথে প্রয়োজনীয় সংখ্যক নৌ-সহায়ক যন্ত্রপাতি স্থাপনের মাধ্যমে দিবা ও রাত্রিকালীন নৌ-চলাচল নিরাপদ করার ব্যবস্থা গ্রহণ” করার কথা বলা হয়েছিল তা কেন বাস্তবায়ন করা হলো না?
আবার বিআইডব্লিউটিএ’র নৌ-সংরক্ষণ ও পরিচালন বিভাগ নদী বিজ্ঞপ্তি দ্বারা রাত্রিকালীন চলাচল নিষিদ্ধ করার পরও এমভি শরীয়তপুর-১ রাতে চলাচলের অনুমতি পেল কি ভাবে? রুট পারমিট দেয়া হয়েছিল কোন বিবেচনায়? তদন্ত রিপোর্টেও সুপারিশ ১০.১৪ তে তো রাত্রিকালীন নৌ-চলাচল সহায়ক যন্ত্রপাতি না থাকা অবস্থায় কোন লঞ্চ কে রাত্রেচলাচলের রুটপারমিট দিতে নিষেধ করা হয়েছিল:”যে সকল রুটে রাত্রিকালীন চলাচলের নৌ-সহায়ক ব্যবস্থা নেই অথচ রুট পারমিট বিদ্যমান রয়েছে সে সকল রুটের রুট পারমিট অবিলম্বে বাতিল করা। জনস্বার্থে পর্যায়ক্রমে জরুরী ভিত্তিতে রাত্রিকালীন চলাচল উপযোগী নৌ-সহায়ক সামগ্রী স্থাপন করা;”
চালকের অদক্ষতা: সংঘর্ষ ঘটার পেছনে রাত্রিকালীন নৌ-চলাচল সহায়ক যন্ত্রপাতি না থাকার পাশাপাশি চালকের অদক্ষতা ও অসাবধানতাও দায়ী থাকতে পারে। কিন্তু সেক্ষেত্রে প্রশ্ন হলো ফিটনেস প্রদানের সময় কি চালকের ফিটনেস ও দক্ষতা পরীক্ষা করা হয়েছিলো? চালকদের জন্য কি মালিক ও বিআইডব্লিউটিও কর্তৃক নিয়মিত প্রশিক্ষণ দেয়ার কোন ব্যাবস্থা আছে? চালকের দক্ষতা ও যোগ্যতার প্রাতিষ্ঠানিক আয়োজন না করে কেবল ব্যাক্তি চালককে দায়ী করলে এ সমস্যার কোন সমাধান হবে না যেকারণে তদন্ত রিপোর্টে ৩টি সুপারিশ করা হয়েছিলো:
১০.০৩.নৌযানে দক্ষ মাষ্টার-ড্রাইভার নিয়োগ দেয়া। মাষ্টার-ড্রাইভারদের নিয়মিত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেয়া। অভ্যন্তরীণ নৌ-রুটে চলাচলকারী মাষ্টার-ড্রাইভারদের প্রতি ০৩ (তিন) বৎসর অন্তর প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক করা;
১০.০৪.নৌ-পথে নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট কাজে নিয়োজিত কর্মকর্তা/কর্মচারীদের দক্ষতা বাড়ানোর জন্য প্রশিক্ষণের বিকল্প নেই বলে কমিটির নিকট প্রতীয়মাণ হয়েছে।
সংশ্লিষ্টদের নিয়মিত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে;
১০.০৫.মাষ্টার-ড্রাইভারের Competency-এর বিষয়টি বিবেচনায় রেখে নৌযানের সার্ভে সনদ দেয়া;
এই সুপারিশগুলো বাস্তবায়িত হওয়ার কোন খবর আমাদের জানা নেই। ফলে এক্ষেত্রেও বিআইডব্লিউটিএ সহ মন্ত্রী-আমলাদের দায় অস্বীকার করার সুযোগ নেই।
সংঘর্ষের পর লঞ্চ নিমজ্জিত যাওয়ার কারণ:
তদন্ত রিপোর্টে বলা হয়েছিল: "...Ship Building Technology তে নৌযানের Design এবং Construction এমনভাবে করা হয় যেন তা ছিদ্র না হলে অথবা তাতে অনুমোদিত যাত্রী ও মালামালের বেশী পরিমাণ পরিবহন না করা হলে নৌযান কোনক্রমেই ডুবে যাওয়ার কথা নয়। ”
তাহলে দেখা যাচ্ছে কোন কারণে কোন লঞ্চের সাথে অপর কোন লঞ্চের/জাহাজের সংঘর্ষ হলেই তা ডুবে যাওয়ার কথা না। দুর্ঘটনাগ্রস্থ লঞ্চটির ডুবে যাওয়ার জন্য হয় তলা ছিদ্র হয়ে যেতে হবে অথবা যাত্রী ও মালামালের ওভারলোডের কারণে ভারসাম্যের হারিয়ে একদিকে কাত হয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটতে হবে।
তলা ছিদ্র হয়ে যাওয়া প্রসঙ্গে: নৌযানের Hull বা কাঠামো উপযুক্ত উপাদান (Steel/Wood/GRP) দ্বারা সুষমভাবে তৈরী করা হলে এবং নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ করা হলে কোন নৌযানের সাথে অপর নৌযানের সংঘর্ষ হলেই তলা ছিদ্র হয়ে যাওয়ার কথা না। আবার তলা ছিদ্র হলেও লঞ্চের ডেক যদি পানি রোধী হয় এবং হাল যদি ওযাটারটাইট কম্পার্টমেন্ট এ বিভক্ত থাকে তাহলে কোন একটি অংশে তীব্র আঘাত বা দুর্বলতার কারণে ছিদ্র তৈরী হলেও শুধু তার উপরের অংশের কম্পার্টমেন্টেই পানি ঢোকবে এবং ডেক পানি রোধী হওয়ার কারণে ডেকের উপরে পানি উঠে ভর্তি হয়ে লঞ্চ ডুবে যাওয়ার কথা না। এ বিষয়ে তদন্ত রিপোর্টে বলা হয়েছিলো:
”দূর্ঘটনা কবলিত লঞ্চটি Sunken deck বিশিষ্ট হওয়ায় তলা (Bottom) ফেটে যাওয়ার সাথে সাথে লঞ্চটির খোলে পানি প্রবেশ করায় লঞ্চটি তার Buoyant force হারায় এবং ধীরে ধীরে ডুবতে থাকে। এক পর্যায়ে সম্পূর্ণ খোল (Hold) পানিতে ভর্তি হয়ে গেলে লঞ্চটি খাড়াভাবেই পানিতে নিমজ্জিত হয়। কিন্তু Sunken deck যদি পানি রোধী (Water tight) থাকে তাহলে নৌযানের নীচে ছিদ্র হলে অথবা ফেটে গেলে Sunken deck-এর নীচে পানি ভর্তি থাকার কথা, ডেকের উপরে পানি উঠা সম্ভব নয়।
.... এখানে উল্লেখ্য যে, নৌযানের হাল যদি ওয়াটার টাইট কম্পার্টমেন্ট বেশী থাকে তাহলে নৌযানটি ডুবতে বেশী সময় নিবে। Water tight Compartment এর Volume Optimum রাখা হলে হয়তো নৌযান ডুববে না অথবা ইঞ্জিন চালু রেখেই নৌযানটিকে নিরাপদ স্থানে নেয়া সম্ভব পর হয়। ”
এখন প্রশ্ন হলো, বিশেষ করে যেসব লঞ্চ যাত্রী পরিবহণ করে সেসব লঞ্চের রুট পার্মিট প্রদান ও ফিটনেস প্রদানের ক্ষেত্রে কি ওয়াটার টাইট ডেক ও পর্যাপ্ত সংখ্যক ওয়াটারটাইট কম্পার্টমেন্ট যুক্ত হালের বিষয়গুলো বিবেচনা করা হয়? এমভি শরীয়তপুর-১ এর ডেক এবং হালের গঠন এবং রক্ষণাবেক্ষণের ব্যাবস্থা কি সঠিক ছিলো? নাকি এমভি বিপাশার দুর্ঘটনার তদন্ত রিপোর্টের মতো এমভি শরীয়তপুর-১ এর তদন্ত কমিটির রিপোর্টেও বলা হবে: ”নৌযানটি দীর্ঘদিনের পুরানো হয়ে যাওয়াতে ও যথাযথভাবে সংরক্ষণ না করার ফলে বহিঃ কাঠামোগত দূর্বলতা/ত্র“টি রয়েছে বলে কমিটি মনে করে। ”
যাত্রী ও মালামাল ওভারলোড প্রসঙ্গে: সংঘর্ষে যদি তলা ছিদ্র নাও হয় তাহলেও কোন লঞ্চের যাত্রী ও মালামাল ওভারলোডেড হয়ে যাওয়ার কারণে লঞ্চটি ভারসাম্য হারিয়ে একদিকে কাত হয়ে ডুবে যেতে পারে। কাজেই যে কোন নৌযানের ভারসাম্য নিশ্চিত করার জন্য এর সঠিক দৈর্ঘ, প্রস্থ, উচ্চতা, তলার গভীরতা ইত্যাদি বিবেচনার পাশাপাশি লঞ্চটি দিনে এবং রাতে কতজন যাত্রী ও কতটুকু মালামাল পরিবহণ করতে পারবে তার একটা হিসেব বেধে দেয়া হয় যার ব্যাতিক্রম ঘটলে সামান্য ধাক্কাতেই লঞ্চটি ভারসাম্য হারিয়ে ডুবে যেতে পারে।
এমভি শরীয়তপুরের দিনের বেলায় ৩৩২ জন এবং রাত্রিকালীন ২২৫ জন যাত্রী পরিবহনের অনুমতি ছিল। কিন্তু দুর্ঘটনা ঘটার পর দেখা গেল কর্তৃপক্ষের কাছে সঠিক তথ্য নেই লঞ্চটিতে কতজন যাত্রী ছিল। পত্রিকায় প্রকাশিত খবর অনুযায়ী লঞ্চটি শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার সুরেশ্বর ঘাট থেকে যাত্রা শুরু করার সময় মোটের উপর ৩শ জন যাত্রী পরিবহন করছিল(যা অনুমোদিত সংখ্যার চেয়ে ৭৫ জন বেশি) এবং পরবর্তিতে রাত ১০টার দিকে কাচিকাটা লঞ্চঘাট থেকে আরো ১শ জন যাত্রী যুক্ত হয় অর্থাৎ অনুমোদিত সংখ্যার চেয়ে আনুমানিক ১৭৫ জন বেশি যাত্রী নিয়ে রাত্রি বেলা এই লঞ্চটি চলছিল যার কোন সঠিক হিসেব কারো কাছেই নাই!
এক বছর আগের এমভি বিপাশার দুর্ঘটনার কারণ তদন্ত করতে গিয়েও তদন্ত কমিটি একই অবস্থা দেখতে পেয়েছিলেন: ”দূর্ঘটনা কবলিত লঞ্চের যাত্রী সংখ্যা বিষয়ে অনুমান নির্ভর বিভিন্ন সংখ্যা পাওয়া গিয়েছে এবং যা ৭০/৮০ হতে আনুমানিক ১৫০-এর মধ্যে সীমাবদ্ধ। সার্ভে সনদে রাত্রকালীন চলাচলের জন্য নির্ধারিত যাত্রী সংখ্যা-৮০। ”
এ বিষয়ে তদন্ত রিপোর্টের ১০.০৬ নং সুপারিশে বলা হয়েছিলো: ”নৌযান বন্দর ত্যাগের পূর্বে কতজন যাত্রী ও কি পরিমাণ মালামাল নিয়ে বন্দর ত্যাগ করা হচ্ছে সে মর্মে মালিকের ঘোষণা বাধ্যতামূলক করা;” এমভি শরীয়তপুর দুর্ঘটনার পর যাত্রী ও মালামাল বিষয়ে সুস্পষ্ট তথ্য না থাকা এবং বাড়তি যাত্রী ও মালামাল পরিবহনের খবর পাওয়াতে এটা পরিস্কার যে আগের তদন্ত রিপোর্টের সুপারিশ বাস্তবায়িত হয় নি।
জীবন রক্ষাকারী সরঞ্জাম ও ব্যাবস্থাপনা প্রসঙ্গে: এমভি বিপাসার দুর্ঘটনার পর তদন্ত কমিটির রিপোর্ট অনুসারে ”লঞ্চটির নিমজ্জিত লঞ্চ এম. ভি. বিপাশার জানালায় নাইলনের দড়ি বাঁধা ছিল। দড়ির ওপরে জড়ানো অবস্থায় ত্রিপল ছিল। যার ফলে ডুবে যাওয়া মালবাহী জাহাজ এম. ভি. আনোয়ার ইসলাম-১ এর সাথে ধাক্কা খেয়ে নিমজ্জিত হওয়ার কালে যাত্রী সাধারণ লঞ্চের জানালা দিয়ে বের হতে গিয়ে চরম বিপদের মুহুর্তেও বাঁধাগ্রস্থ হয়েছে বলে প্রতীয়মাণ হয়। জানালা সম্পূর্ণরূপে উম্মুক্ত থাকলে প্রানহানী কম হতো বলে তদন্তকমিটি মনে করে। ”
এমভি শরীয়পুর-১ এর দুর্ঘটনা থেকে বেচে যাওয়া যাত্রী ও উদ্ধারকার্যে নিয়োজিত ডুবুরিদের ভাষ্য অনুসারে কয়েকশো মরিচের বস্তা লঞ্চের জানালায় স্তুপ করে রাখার কারণে যাত্রীদের বের হতে সমস্যা হয়েছে।
ডুবে যাওয়া লঞ্চ থেকে প্রথম লাশ উদ্ধারকারী ডুবুরি আলাউদ্দিন সাংবাদিকদের বলেন, লঞ্চের জানালায় মরিচের বস্তা স্তূপ করে রাখার কারণে দুর্ঘটনার সময় অনেকেই চেষ্টা করেও বের হতে পারেনি। এমনকি দুর্ঘটনার পর লাশ উদ্ধারকাজও ব্যাহত হচ্ছে ওই মরিচের বস্তার কারণে। আবার কেউ কেউ লঞ্চ ডুবে যাওয়ার পর মরিচের বস্তা ধরে ভাসতে ভাসতে পাশ দিয়ে যাওয়া লঞ্চ এমভি মিতালি-৩ থেকে ছুড়ে দেয়া বয়া’র সাহায্যে বেচে গেছেন। এভাবে প্রায় ৩০ জন যাত্রীর প্রাণ রক্ষা হয়। প্রশ্ন হলো, যাত্রীদেরকে কেন অন্য লঞ্চের বয়া ব্যাবহার করে ভেসে থাকতে হলো? এমভি শরীয়তপুর-১ এ কি তাহলে ভেসে থাকার জন্য পর্যাপ্ত বয়া বা অন্য কোন সরঞ্জাম ছিলো না? অথচ তদন্ত কমিটির রিপোর্টে সুপারিশ করা হয়েছিলো :”যাত্রীবাহী লঞ্চে উপযুক্ত পরিমাণ জীবন রক্ষাকারী সরঞ্জাম নিশ্চিত করন;”।
(অবশ্য তদন্ত রিপোর্টে উপযুক্ত জীবন রক্ষা কারী সরঞ্জাম কে সুনির্দিষ্ট করে দেয়া হয়নি। আমরা মনে করি যাত্রিবাহী লঞ্চে বিভিন্ন জীবনরক্ষা কারী অন্যান্য সরঞ্জামের সাথে প্রত্যেক যাত্রীর জন্য লঞ্চে উঠার সময়ই লাইফ জ্যাকেট বরাদ্দ করা বাধ্যতামূলক করতে হবে। লাইফ জ্যাকেটের দাম লাইফের চেয়ে বেশি না। ) লঞ্চে পর্যাপ্ত জীবন রক্ষাকারী সামগ্রী থাকলে এবং ৪শ মরিচের বস্তা যাত্রী চলাচলে বাধা সৃষ্টি না করলে, যেহেতু দুর্ঘটনার পরপরই সৌভাগ্যক্রমে ঘটনা স্থলে আরেকটি লঞ্চ হাজির ছিল, ফলে আরো বেশি সংখ্যক যাত্রীর জীবন রক্ষা করা সম্ভব হতো। কিন্তু মালিকের মুনাফালোভ ও কর্তৃপক্ষের নজরদারি ও ব্যাবস্থাপনার সমস্যার কারণে সামান্য এই আয়োজনটুকুও করা হয়নি লঞ্চটিতে।
উদ্ধারকারী জাহাজ ও উদ্ধার তৎপরতা প্রসঙ্গে:
এমভি শরীয়তপুর-১ দুর্ঘটনায় পড়েছে রাত আড়াইটার দিকে অথচ খবর পেয়ে উদ্ধারকারী জাহাজ রুস্তমের ঘটনাস্থলে আসতে আসতে সকাল ৭টা। তারপর দেখা গেল প্রায় দুইশ টন ওজনের এমভি শরীয়তপুর-১ কে উত্তোলণের ক্ষমতা এমভি রুস্তমের নেই কারণ এর সর্বোচ্চ উত্তোলণ ক্ষমতা ৬০টন। এরপর ডাক পড়ল এমভি হামজা’র। তো হামজা’র বরিশাল থেকে ঘটনাস্থলে আসতে লাগলো ২৩ ঘন্টা এবং তারও উদ্ধারক্ষমতা ৬০টন। ফলে দুই উদ্ধারকারী জাহাজ মিলিত ভাবে নানান কসরত করে নিমজ্জিত লঞ্চটিতে তীরে আনতে সক্ষম হয় যদিও নিহতদের সকলের লাশ এখনও উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি।
প্রশ্ন হলো, নদী পথে চলাচলকারী লঞ্চ দুর্ঘটনায় পতিত হলে যেন দ্রুত তার খবর পাওয়া যায় সেজন্য উপযুক্ত ট্র্যাকিং সিস্টেমের কোন ব্যাবস্থা নাই কেন? আবার কেন উদ্ধারকারী জাহাজের ক্ষমতা নদীপথে চলাচলকারী একটি লঞ্চের ওজনের এক তৃতীয়াংশেরও কম। কেন পর্যাপ্ত সংখ্যক শক্তিশালী উদ্ধারকারী জাহাজের ব্যাবস্থা করা হচ্ছে না? এমভি বিপাশার তদন্ত রিপোর্টে তো সুপারিশ করা হয়েছিলো:
"১০.১৬. বিআইডব্লিউটিএ’র উদ্ধার কাজের সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য সত্ত্বর আধুনিক প্রযুক্তি সম্পন্ন উচ্চ ক্ষমতার উদ্ধারকারী জাহাজ সংগ্রহের ব্যবস্থা করা;"
যে কারগরি ও ব্যাবস্থাপনাগত সমস্যাগুলো এমভি বিপাশার ডুবে যাওয়ার পিছনে দায়ী বলে চিহ্নিত করা হয়েছিলো, সেই সমস্যাগুলো নতুন নয়। দীর্ঘ দিন ধরেই এ বিষয়ে নানান সময় নানান কথাবার্তা হয়েছে। তারপরও এই সমস্যাগুলোর কোন সমাধান করেনি শাসক গোষ্ঠী যার ফলে একটার পর একটা ’দুর্ঘটনা’ ঘটেই চলেছে। পাঠক, আপনারাই সিদ্ধান্ত নিন যে সাম্প্রতিক এই লঞ্চডুবি’র ঘটনাটিকে আমরা ”দুর্ঘটনা” বলবো না হত্যাকান্ড বলবো? লোক দেখানো তদন্ত কমিটি, শাসক গোষ্ঠীর মায়া কান্না আর লাশ প্রতি তিরিশ/পয়তাল্লিশ হাজার টাকার ক্ষতিপূরণে সন্তুষ্ট থাকব নাকি এই ঘটনাটিকে হত্যাকান্ড বলে চিহ্নিত করে এর পেছনে দায়ী ব্যাক্তি/গোষ্ঠীর বিচারের দাবী তুলবো এবং সেই সাথে এই ধরণের হত্যাকান্ড যেন আর না ঘটতে পারে তার জন্য কারগরী ও ব্যাবস্থাপনাগত যতধরনের সমস্যা ইতোমধ্যে বিভিন্ন সময় চিহ্নিত হয়েছে সেগুলো সমাধানের জন্য শাসক গোষ্ঠীকে বাধ্য করবো।
এম.ভি.বিপাশা'র দুর্ঘটনার তদন্ত রিপোর্ট ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।