স্বপ্নবাজ। একটা রাতের রংধনুর স্বপ্ন দেখি...। -কিঙ্কর আহ্সান
সোনার হরিন
কিঙ্কর আহ্সান
স্কুল থেকে ফিরেই আর পাওয়া যেত না আমাকে। পড়িমরি করে ছুটতাম খেলার মাঠে। বুনো ফুল-ঘাস মাড়িয়ে,লজ্জাবতীর ঘুম ভাঙিয়ে শুধু ছোটাছুটি।
মাটিতে চিৎ হয়ে শুয়ে আকাশ দেখতাম। মাঝদুপুরে মেঘগুলো রোদের অলংকার গায়ে জড়িয়ে চেয়ে থাকত আমার দিকে। লজ্জায় চোখ বুজতাম। এই এতটুকুন আমি তাই বলে কি আমার লজ্জা থাকতে নেই। মা বোঝেন না।
রাতে বিছানা ভেজানোর দুর্ঘটনাটা না-হয় হয়েই গেছে। তাই বলে কি অমন করে হাসতে হয়! মুখপোড়া বোনটাও তাল মেলায়। রাগে পিত্তি জ্বলে যায়! আর যদি কখনো ওর জন্য কাঁচা তেঁতুল,চালতার আচার এনেছি তো আমি একটা হনুমান। একদম যাচ্ছেতাই মেয়েটা। মায়ের শাড়ির আঁচলের খুট থেকে পয়সা চুরি করে স্যাকারিন দেওয়া আইসক্রিম কিনে খাই।
এটা জানতে পারলেই বাড়িতে বলে দেয়। আমার মায়ের পয়সা দিয়ে স্যাকারিন না কেরোসিন খাই,তাতে তোর কিরে ডাইনি বুড়ি! বুড়িটা বলে,‘বড় বোনের সঙ্গে এমন করতে নেই। বিয়ে হলে পরের ঘরে চলে যাব। তখন তোর অনেক খারাপ লাগবে। ’ বিয়ের জন্যে অপেক্ষা করি।
ও চলে গেলে মা বাবার সব আদর আমার। ভাবতেই ভালো লাগে। কথার পিঠে খেপে গিয়ে বলি,‘যা,দূর হয়ে যা,তোর বিয়েতে আনন্দে ধেই ধেই করে নাচব। কাঁদব না একটুও। ’ বিকেলের দিকে বোমবাস্টিং খেলাটা জমত।
পিঠে ব্যাথা নিয়ে কোঁকাতে কোঁকাতে ফিরতাম বাড়ি। মাকে বুঝতে দিতাম না। ব্যাথার কথা জানতে পারলে রক্ষে নেই। পড়তে ভালো লাগে না। নতুন বইয়ের গন্ধে নাক ডুবিয়ে রাখতাম।
মা শুধু বলেন,‘পড় সোনা। অনেক পড়লে তুই রাজা হবি। সোনার হরিন পাবি। ’ আমি রাজা হবার জন্যে পড়ি। ঘুমে ঢুলুঢুলু হয়ে বোনের সঙ্গে মায়ের কোলে মাথা রাখি।
মা গল্প বলে যান। তিন জোনাকি,মুকুট মাথায় দেওয়া রাজা আর সোনার হরিনের গল্প। আমার রাজা হতে ইচ্ছে করে। সোনার হরিনের পিঠে চড়ে ঘুরে বেড়াতে চাই। মা হঠ্যাৎ গান ধরেন,‘তোরা যে যা বলিস ভাই,আমার সোনার হরিন চাই।
’ কী দারুন গলা। বাবা মানুষটা গোমড়ামুখো। মায়ের ওষুধের শিশিটা ভাঙার জন্য কি মারটাই না মারল আমায়। বরইতলায় গিয়ে অনেক কাঁদলাম। মা ও বোন খাওয়ার জন্য ডাকতে এসে ফিরে যান।
আমার সেকি জেদ,খাব না বলে পণ করেছি! একসময় বাবা এসে বললেন,‘আর রাগ কোরো না,খেতে চলো। ’ সব ভুলে বাবার কোলে মুখ লুকিয়ে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলাম তখন। মুঠোভর্তি নকুলদানা কিনে দিলেন বাবা সেদিন। এমন সুখে-ভেজা দিনগুলোতে ধাইধাই করে বড় হই। বেয়াড়া মেঘ,টুনটুনি,মস্ত খেলার মাঠ,চিনি গোলানো জলে ডুবো ডুবো চালতা সব ফিকে হয়ে যায়।
মায়ের শরীরের মমতাভরা ঘ্রান নিয়ে ঘুমুতে চাই। হয় না। বোনটাও বিরক্ত করে না আর। পরের ঘরে গিয়ে করবেই বা কী করে,বিয়ে হয়েছে অনেকদিন। কসম বলছি,বুড়ির বিয়েতে গোপনে পাগলের মতো কেঁদেছি।
প্রকৃতি আমাকে বড় করে দেয়। মাঝরাতে বোবাভুতে ধরলে এখন আর পাশফিরে মাকে দেখতে পাই না। অভিমান হলে হাত পাতি। নকুলদানার নাগালও পাই না। দিনভর কাজ।
মায়ের কথামতো আমাকে যে রাজা হতে হবে। বুকের ভেতর বহুদিন ধরে পুষে রাখা কথাটা তাই গোপনই থাকে। নিজের ঘরের নিঃসাড় দেয়ালে সেটা ধাক্কা খেয়ে একাকী আনমনে বারেবার বলে যায়,‘মা-মাগো,আমি তো রাজা হতে চাইনা। মানুষ হতে চাই...। ’
।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।