আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গার্মেন্টসে আর না

নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন প্রত্যেকে। যে যার জায়গা থেকে। মিডিয়াগুলো ব্যস্ত সর্বশেষ তথ্য পৌঁছে দিতে, দমকলবাহিনী আর সেনাবাহিনী ব্যস্ত ভারী যন্ত্র দিয়ে ধ্বংসস্তূপ সরাতে। সরকার আর বেসরকারি দাতা সংস্থাগুলো ব্যস্ত ত্রাণ ও পুনর্বাসনের জন্য বৈদেশিক তহবিল সংগ্রহের কাজে। আর দুঃখজনক হলেও সত্য, এই সকল পোশাকশ্রমিক, যারা নতুন জীবন ফিরে পেয়েছে তারা ব্যস্ত গ্রামে ফিরে যেতে।


৩০ এপ্রিল সাভার সিএমএইচে চিকিৎসাধীন নারী এবং পুরুষ পোশাকশ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তাদের জন্য সাহায্য হিসেবে ফল, ওষুধ, কাপড়, টাকা, হুইল চেয়ার, স্ক্রাচ আসছে প্রচুর। স্বপ্রণোদিত হয়ে এই যে মানুষের পাশে এসে দাঁড়ানো এই দেখে মন ভরে ওঠে।
তবে হায়, যাদের জন্য এত এত আয়োজন তাদের চোখমুখের অভিব্যাক্তি খুবই নির্লিপ্ত। উদাসীনভাবে সেই সকল সাহায্যসামগ্রী তারা বালিশের পাশে নইলে খাটের পাশে রেখে দিচ্ছেন।
হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে থাকা নারী শ্রমিকদের প্রশ্ন করি, “আসলে আপনাদের সাহায্য হিসেবে কী প্রয়োজন?”
উত্তর পাইনা।

আমি উত্তর দিতে সাহায্য করি। “টাকা, খাবার, ক্ষতিপূরণ, বিচার?”
প্রতীমা নামের ১৮ বছরের মেয়েটি কিছুক্ষণ আমার দিকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। তারপর খুব আসতে করে উত্তর দেয়, “আপা, কবে ভালো হব জানি না। কিসু কইরা তো চলতে হইব। ভাবছি এখান থেকে ছাড়লে আগে গ্রামে যামু।

তয় আমি আর গার্মেন্টসে কাজ করমু না। ”
প্রথমবারের মতো ধাক্কা খাই। এটা কীভাবে সম্ভব! কোনোই চাহিদা নেই, শুধু গ্রামে ফিরতে চায়। মনে মনে ভাবি ভয় থেকে হয়তো এ রকম বলছে।
এরপর যাই নাসরীনের সঙ্গে কথা বলতে।

বিছানায় শুয়ে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছিল সে। পাশে বসা ওর মাকে প্রশ্ন করতেই উত্তর দেয়, “মাগো, দুই দিন পর পাইসি মাইয়াটারে। পুরা শরীরে চ্যাচা খাইসে। ব্যথায় কাতরায় খালি। ”
একই প্রশ্ন নাসরীনের মাকেও করি, “আসলে আপনাদের এখন কী ধরনের সাহায্য দরকার?”
তার উত্তর “মাগো আমাগো অভাবের সংসার।

৬ জনের পরিবার, গ্রামেই থাকি। মাইটার আয়েই চলত সংসার। তয় ওরে আর বিদেশে রাইখা যামু না। না খায়া থাকুম, তাও মেয়েরে বাড়িত নিয়া যামু। মেয়ে আর গার্মেন্টসে ফিরবার চায় না।


ভয়ে এদের কি বোধশক্তি লোপ পেল। নাহলে একই উত্তর পরপর দুইজন!
৩০ বছরের মোমেনা ছিল সুইং অপারেটর। জানতে চাই, “আপনি কত তালায় কাজ করতেন। ”
সে উত্তর দেয়, “৪ তলায়। ”
“আপনারতো পা ভেঙে গিয়েছে।

কাজে ফিরতেও সময় লাগবে। আপনার এখন কী ধরনের সাহায্য দরকার?”
প্রশ্নবোধক দৃষ্টি নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে ভাবে কিছুক্ষণ; তারপর বলে, “আপা আমি বেতন পাইতাম ৮ হাজার টাকা। তাই দিয়া দুই মেয়ের পড়া আর সংসার চলত। এই নিয়া চিন্তায় আছি। এই দুই-তিনমাস কেমনে চলব।

সেলাই জানি। ভাবসি একটা মেশিন কিনা ঘরে কাপড়ের ব্যবসা শুরু করব। ”
কী আশ্চর্য! এরা কি আর কেউই গার্মেন্টসে ফিরবে না বলে ঠিক করেছে। এরপর কথা হয় আহত অনেক নারী পোশাক শ্রমিকের সঙ্গেই। কেউ দোকান দিতে চায়, কেউ মেশিন কিনে ব্যবসা করবে আর অনেকেই ফিরে যেতে চায় গ্রামে।


সকালে যখন সিএমএইচে ঢুকি তখন রুগীর সংখা ছিল ১১৬। বিকাল অবধি ৬৪ জনকে হাসাপাতাল থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। ডাক্তার নার্সদের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারি অধিকাংশই ফিরে যাচ্ছেন গ্রামে।
২০ বছরের সুমিকে যখন জিজ্ঞেস করলাম, “গ্রামে গিয়ে কী করবা?”
তখন তার আতঙ্কমিশ্রিত উত্তর, “আপা, জান নিয়া বাইচা ফিরছি, গার্মেন্টসে আর না। ”
প্রায় সবার মুখেই একই রব ‘গার্মেন্টসে আর না’।

তবে কি সকালবেলার অতি পরিচিত দৃশ্য- কলকল ছলছল করতে করতে কিশোরী মেয়েদের মিছিল দেখি, সেটা কি আস্তে আস্তে হারিয়ে যাবে। টিফিন বাক্স হাতে বলিষ্ঠভাবে এগিয়ে যায় যারা, তারা কি নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছে। সমাজের বেড়াজাল ভেঙে যে কিশোরী আর নারী বের হয়ে এসেছিল সে কি আবার সেই বেড়াজালে আবদ্ধ হতে চলেছে!
বিকেলশেষে সন্ধ্যা গড়িয়ে আসছে। চারদিকে ভয়ঙ্কর বিবর্ণ লাগছে। ওদের ভয় আমাদেরই তাড়াতে হবে।

যার যার জায়গা থেকে কাজ করে যেতে হবে। সেইসঙ্গে নিশ্চিত করতে হবে নিরাপদ কাজের পরিবেশ।

সোর্স: http://bangla.bdnews24.com

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.