প্রকীর্ণ করি অর্ণে আলোক বিসর্গী বীথিকায় প্রিয় যাহ্রা।
তুমি বলেছ, গত ক’দিন ধরে লেখায় শুধু বিষাদ ছড়াচ্ছি। কি করব বল ? বয়েসটাই এমন। শুধু দুঃখ বিলাসিতায় ভাসতে ইচ্ছে হয়। চারপাশে আনন্দের এত উপকরণ, তবুও।
বন্ধুরা সবাই কোন না কোন কাজে জড়িয়ে পড়েছে। আমি একাই অথর্ব হয়ে পড়ে রয়েছি । একা থেকে একা হয়ে পড়ছি ক্রমে। তুমি আছ পাশে, এই শুধু ভরসা। আর আছে বিষণ্ণ বাবা মা।
তাঁদের ভাঁজ পড়া মলিন মুখ দুটো দেখে, খুব কেঁদে ওঠে মন। বাবা রিটায়ার্ড করেছেন। পেনশনের টাকার সিংহভাগ বাড়ির কিস্তির সুদ দিতে চলে গেছে। একা স্কুলশিক্ষক মায়ের টাকায় সংসার চলছে। তাঁর চোখের নিচে কালশিটে পড়েছে।
মুখ থেকে হাসি অন্তর্হিত হয়েছে। ভরসা দেবার মত কণ্ঠস্বর আমার নেই। একটা কাজ এ মুহূর্তে খুব দরকার আমার। এত খরচ করে প্রকৌশলে পড়াশোনা শেষ করেছি, রেজাল্টটাও খামখেয়ালীপনা করে ভাল করতে পারিনি। আমার জন্যে কাজ পাওয়াটা এতো সহজ নয়।
নিজেকে অনেক গুটিয়ে নিয়েছি নিজের ভেতর। বন্ধুদের আড্ডা এড়িয়ে চলি, খরচের ভয়ে। তোমার সঙ্গে দেখা করতে পারি না, তোমার খরচের লজ্জায়। বলতে বাধা নেই, টাকা পয়সার কাছে বড্ড ছোট হয়ে গেছি আজকাল। কোন টিউশনিও করাচ্ছি না।
কতকটা ইচ্ছে করেই। ছেলেমেয়েগুলো, আমার কাছে রেজাল্ট খারাপ করে। অথচ, আমি যখন কথা বলি, তখন সব হাঁ করে গেলে। তোমাকে বলেছিলাম এক ছাত্রের কথা? দশম শ্রেণিতে ফেল করেছিলো। আমি আর পড়াবনা বলতেই, এত বড় ছেলের সেকি কান্না।
বড় কোথায়, ছোটই তো। আমি নিজে যখন দশম শ্রেণিতে ছিলাম, মনে হত, কত বড়ই না হয়েছি। এখন মনে হয়, ওটা হয়ত শৈশবের শেষ চৌকাঠ ছিল। শৈশব তো বটেই।
কবিতা লেখা ছেড়ে দিয়েছি।
তুমি আমার কবিতা পড়ে কাছে এসেছিলে, ভাবতেও পুলক জাগে। ভাগ্যিস, কবিতা লিখতাম তখন। তা না হলে, জীবনের এ অবলম্বনটুকু, জীবনে আসবার পথ খোলা ছিল কি? এ লেখা পড়ে তুমি হয়ত হাসবে। হাসলেও, কথা মিথ্যে নয়। তুমি তো জীবনে এসেই গেছ।
এখন তাই, কবিতা লিখবার প্রয়োজন ফুরিয়েছে। হাহ। বেশ একটা যুক্তি দাঁড় করানো গেল, কি বল।
আসলে, কবিতার জন্যে চাই কাব্যিক শব্দ ভাণ্ডার। সে শব্দ ভাণ্ডার জোগাতে হলে, অনেক অনেক কবিতা পড়া চাই।
কবিতা পড়াই ছেড়ে দিয়েছি। কবিতাগুলো সব, আজকাল কেমন যেন কৌতুকের মত ঠেকে। দোষ কবিতার কিংবা কবিদের নয়। দোষ আমার নিজের। কবিতার নৌকো তরতর করে এগোবার জন্যে একটি নদী চাই।
সে নদীর জল শুকিয়েছে। তুমি যদি প্রশ্ন করে বস, কেন, তো ভারি বিপদে পড়ে যাব। উত্তর যে জানা নেই।
-যে ভালবাসা দিয়ে, প্রেম দিয়ে আমি তোমাকে ঘিরে রেখেছি, তার মাঝে কি সে নদীর জল নেই?
-আছে !
তবে জলগুলো বড্ড খরতাপে বাষ্প হয়ে উড়ে চলে যাচ্ছে যে !
আমি কৃতকার্য, সে তো শুধু তোমার কাছে। সারা পৃথিবীতো বলছে ভিন্ন কথা।
এই চিত্রনাট্যের পরিবর্তন ঘটুক। তবেই খরতাপ নেবে আসবে। নদীতে জল ফের তরঙ্গিত হবে। কবিতার নৌকোবাইচ উৎসব হবে দেখে নিও। হা হা হা।
বহুদিন হল ছবি আঁকছি না। ইস। তোমাকে আর কত হতাশার কথা শোনাবো। এগুলোকে একধরনের জবাদিহিতা হিসেবে নাও। হ্যাঁ।
ছবি আঁকছি না। খুব সহজ ব্যাখ্যাটি হচ্ছে, নতুন কোন দৃশ্য চোখে দেখছি না। ঘরে বন্দি হয়ে বসে আছি। আমি তো আর ভিনসেন্ট নই। হলে, ঘরে বিষণ্ণ বসে থেকে, বিষণ্ণতার কালজয়ী কোন এক ছবি এঁকে ফেলতাম !
তবে, আমি তো তোমার কাছে ভিনসেন্ট থেকেও অনেক বেশী।
কারণ, তুমি আমাকে ভালবাস। ভালবাসার চেয়ে মোক্ষম রঙিন চশমা, দ্বিতীয়টি আর নেই। তোমার অভ্রছোঁয়া প্রত্যাশাও আমাকে বিব্রত করে বারবার। মাঝে মাঝে পুরনো স্কেচ খাতাটি নাড়াচাড়া করি। মানুষের শরীরের মাপজোখ গুলো মনে রাখি।
লুকিয়ে দেখি, তোমার জলরঙের পোট্রেটটা। তুমি আর তোমার কল্পনা মিলে, হয়ত সেটাকে অসাধারণ শিল্পোত্তীর্ণ কোন ছবি হিসেবে দেখবে। তবুও, পাছে তোমার প্রত্যাশার কাছে নগন্য হয়ে যাই, এই ভেবে শেষ পর্যন্ত তোমাকে আর তা দেয়া হয়নি।
নেবে ওটা ?
যাহ্রা। আমার বাসার কাছে আমার প্রিয় এক আলো ঝলমলে রাস্তা আছে।
রাস্তার শেষ মাথার চায়ের দোকানটিতে এসে থামে আমার সান্ধ্যবিহার। আজও গিয়েছিলাম। আশেপাশে, কোন এক গলির ছন্নছাড়া এক বাড়ির সামনে আছে এক হাস্নাহেনা গাছ। কোন গলিটি আমি বারবার ভুলে যাই। আমার মস্তিষ্ক তা ভুলে গিয়ে আনন্দ পায়।
চা পান শেষে একবার ভাবলাম, যাই, ঘ্রাণটুকু নিয়ে আসি। আজকের রাতের খোরাক !
অন্ধকারে হাঁটতে হাঁটতে, প্রতিবারের মতই, হঠাৎ পেয়ে গেলাম গাছটি। মুহূর্তে মাতাল করা সুঘ্রাণে, পাগল হবার দশা ! বহু বছর আগে, আমাদের বাড়ির সামনে, বাবা এমনই একটা হাস্নাহেনা গাছ লাগিয়েছিলেন। ইংরেজি মাই রিডিং রুম প্যারাগ্রাফের মতন, আমার ঘরটা ছিল তার ঠিক পাশেই। সন্ধ্যে বেলা আমি জানালা বাঁধতে চাইতাম না, সৌরভ আসবে বলে।
মা বকতেন। বলতেন,
-বন্ধ কর ! মশা আসবে হু হু করে!
আমি জানালা অল্প ভিজিয়ে রাখতাম। মা চোখের আড়াল হলে, খুলে দিতাম আবার। তারপর, পর্দা টানিয়ে একপাশ একটুখানি সরিয়ে রাখতাম। তাতেই আমার ঘর মৌ মৌ করত !
এমন সময়, আমার বাল্যসখা তৈয়বের মিষ্টি মুখটা উঁকি দিত জানালায়।
ওকে আমি বলতাম দৈনিক জানালা। সে অনেক রকম গল্প করত। ঘুড়ির গল্প, ফুটবলের গল্প, বড় ভাইদের মারপিটের গল্প। আর বলত,
-হাস্নাহেনা লাগিয়েছিস, দেখিস একদিন সাপ আসবে। হাস্নাহেনার গন্ধে খুব সাপ আসে।
আমি বলতাম, সাপ আসলে তো আর আমাকে কামড়ানোর জন্যে পাবে না। পাবে তোকে।
শুনে তৈয়ব বিব্রত বোধ করত। আরও বলতাম,
-ওই যে, হিস হিস শব্দ। শুনতে পাচ্ছিস ? হা হা হা !
একদিন দৈনিক জনালা জানাল, ন হাজার বার সুবহানাল্লাহ পড়লে যা চাওয়া যায়, আল্লা তাই দেন।
সে রাত থেকে সাবধানে হিসেব রাখতে শুরু করলাম । এক সপ্তাহ পর ন’হাজার পূর্ণ হল। তখন রাত বাজে দুটো। খুব যত্ন করে, আল্লার কাছে একটা ঘোড়া চাইলাম। ধবধবে শাদা একটা ঘোড়া।
উত্তেজনায় ঘেমে যাচ্ছিলাম। চারদিক সুনসান। হঠাৎ মনে হল হাস্নাহেনার কাছে কিছু একটা খুর ঠুকছে। খুব আস্তে করে একটা হ্রেষা ধ্বনিও শোনা গেল বলে মনে হল। আমার বুক ঢিপ ঢিপ করতে লাগল।
ভাবলাম, ভারি বিপদে পড়া গেল। এতরাতে, ঘোড়াটাকে এখন কোথায় নিয়ে লুকোব ? সাবধানে মশারি তুলে, আস্তে করে খাট থেকে নামলাম। তারপর চেয়ারটা টেনে, দরজার ছিটকিনি খুলে বাহিরে বেরিয়ে এলাম। বাহিরে আমার প্রিয় হাসনাহেনাটি, অন্ধকারে একাকী সৌরভ ছড়িয়ে যাচ্ছিলো।
আমার চোখে জল এসে গিয়েছিল, হুমায়ুন আহমেদের উপন্যাসের কোন চরিত্রের মতন।
আসলে, বিশ্বাস করতে খুব কষ্ট হচ্ছিল যে, এতো নিষ্ঠার সঙ্গে পড়ার পরও তিনি আমাকে দিলেন না। সেই শৈশবে, এক অন্যরকম স্বপ্নভঙ্গ হল আমার। পরে, তৈয়ব আমায় ভুলটুকু ধরিয়ে দিয়েছিল।
-বোকার মত এত বড় জিনিস চাইতে গেলি কেন ? শুধু শুধু ন হাজার তাসবিহ পানিতে ফেলেছিস। এক প্যাকেট ক্যাটবেরি চাইলে, ঠিক ঠিক পেয়ে যেতি !
তিনি তো আসলে বড় কিছুর প্রভু নন।
তিনি হলেন, গড অফ স্মল থিংস। হা হা হা ।
অরুন্ধতীর কাছে ক্ষমা প্রার্থী। তার দেয়া নামটির এমন অজধারা ব্যবহারের জন্যে !
যাহ্রা। আমার ঘুম আসেনা।
রাত আরও বাড়লে, এক কাপ গরম চা নিয়ে আর্মচেয়ারটাতে বসি। জানালাটি খুলে দিয়ে, একটা সিগারেট ধরাই। সেই হাস্নাহেনা গাছটা এখন আর নেই। কবে মরে গেছে !
অন্ধকার গলে রাত্রির বিষণ্ণ বাতাস আসতে থাকে ঘরে। হঠাৎ মনে হয়, কাজ নিয়ে অনেক দূরে কোথাও যদি চলে যেতে পারতাম! ঢাকা শহর থেকে অনেক অনেক দূরে।
যেখানে হাঁটাপথের দূরত্বে বন থাকবে। নদী থাকবে। সমুদ্র থাকবে, পাহাড় থাকবে। বাবা মা, তুমি; তোমরা থাকবে অনেক দূরের তৃষ্ণা হয়ে ! বিকেলে ঘরে ফিরে তোমাদের জন্যে গাঢ় বিষাদে আমার মন ছেয়ে থাকবে। সন্ধ্যেবেলায়, বিভূতিভূষণের মতন, কুপি বাতি জ্বালিয়ে লিখতে বসব আমি।
ভয় পেলে? মিছে কথা। তোমাকে ছেড়ে, তোমাদের ছেড়ে, এক মুহূর্তের জন্যেও কোথাও আমি যেতে পারব না। আমি তুচ্ছ দুঃখবিলাসী কবি। আমার দুঃখবোধ, ওই বিলাসিতা পর্যন্তই।
তার অসুরিক রূপের কাছে নিজেকে সমর্পণ করব, অত সাহস আমার নেই !
-ইতি
হামিম।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।