প্রায়শই ভাবি, মধ্যবিত্তের নিজেদের সংখ্যার দ্বিগুন চোখ থাকার কথা, যা বিচিত্র দৃশ্যেও সমৃদ্ধ হওয়ার কথা।
বিপরীতে, যেকোন বিষয়ের স্মল, মিডিয়াম, এবং লার্জের এই তিন খাপে সবাই কেমন মানিয়ে নিচ্ছে নিজেকে। ফলে যতোসংখ্যক মধ্যবিত্তই থাকুক না কেন, আসলে তিন জন মধ্যবিত্তই রয়েছে। আর তাদের মাঝে কোন গুণের পার্থক্য নেই, রয়েছে শুধু পরিমাপের ভিন্নতা। তাই মধ্যবিত্তের দর্শনেন্দ্রিয় তাদের মাথার সংখ্যার দ্বিগুন হওয়ার শর্তে অন্তত ছয়টি চোখ তো থাকারই কথা! আসলে তাদের সংখ্যার দ্বিগুন চোখ তো নয়ই, এমনকি তিন খাপের তিনটিও নয়।
একটি, মাত্র একটি।
এবং একটি চোখেরই কপি বাকি সব।
ফলে চোখের সংখ্যা বাড়েনি। বেড়েছে কপির সংখ্যা, বা নকলের।
আর দৃশ্য সব চোখেই এক।
আর যেহেতু একই দৃশ্য সবাই দেখে তাই মস্তিষ্কে তার প্রতিক্রিয়াও এক।
ফলে সবদিক থেকে একই আনন্দ ধ্বনি বা একই চিৎকার শোনা যায়।
আর আমাদের চিৎকার কেন পাল্টে পাল্টে যায়, অদৃশ্য কর্তার ইচ্চায়, সমাধানহীনভাবে, আমরা জানি না বা এ প্রশ্ন আসে না মাথা জুড়ে।
এর জন্য বিনোদন ধ্বনি তো আছেই-- এ পশ্নের উপর দিয়ে চিরদিন যা দমকা হাওয়ার মতো বয়ে যায়-- এই দৃশ্য-দুনিয়ায়, এই ধ্বনি-ধরিত্রিতে।
যেহেতু কর্তার ইচ্চায় মধ্যবিত্তের আনন্দ বা চিৎকারই এই মধ্যবিত্তের জগতে শ্রুত হয় বা প্রচারিত হয়।
এই দিক থেকে ভাবলে সবচেয়ে ভয়ানক ব্যাপারটি চোখে পড়বে। এরাই বিশ্বের সবচেয়ে বৈচিত্রহারা প্রাণী। এবং জ্ঞানহীনও। কেননা, দায়হীন হলেই তো সেরা জ্ঞানহীন হওয়া যায়। তখন জ্ঞানী ও অজ্ঞানী একাকার হয় সংকটে, আর সমাধানহীনতায়।
তখন তুখোর প্রশ্ন আছড়ে পড়বে আপনার মাথায় তাদের জিভ কেন ছোবল দেবে না আপনার প্রশ্নবিরল মাথায়-- সমাধান বলে আদৌ কি কিছু আছে? এ তো বোকার কল্পনা। যে সমাজের ভেতর তারা বিচরণ করে, তাকে তারা ধ্বসিয়ে চলে, এভাবে, এ পক্রিয়ায়।
আর সমস্ত বিষয়েই তারা তিনটি উত্তরের একটা বেছে নেই: সরল, একটুকঠিন, বা জটিল।
আবার অন্য রকমও হতে পারে: হাঁ, নীরব, বা না।
এভাবেও চলে জ্ঞানের চর্চা তাদের: দলভুক্ত, নিরীহ, বা দল বিরোধী।
মানুষ, অমানুষ, জানোয়ার-এমনও হতে পারে।
বা , এর সমান্তরালে: প্রতিভাবান/বতি, সম্ভাবনাময়, বা মেধাহীন।
আর এভাবে তৈরি হয়ে যাবে আপনি গ্রহণযোগ্য, কি বিবেচনাধীন, কি বিবেচনার বাইরে।
বা এর সমান্তরালে: আপনি লালনযোগ্য, উপেক্ষাযোগ্য, কি উৎসর্গযোগ্য।
এভাবে চলছে আমাদের চিন্তা প্রকরণ।
আপনি যদি দলের হন, তাহলে আপনি গ্রহনযোগ্য, সরল, জ্ঞানী ও লালনযোগ্য, হ্যাঁ মানুষ।
আর যদি গোত্রশত্রু বা গোত্রছুট হন, আপনি বিবেচনার বাইরে, উপেক্ষাযোগ্য, জটিল, উৎসর্গের, না মানুষ, বা বলির যোগ্য জানোয়ার।
এভাবে আমরা দিনদিন জ্ঞানী হয়ে ওঠি। আর জ্ঞান অর্জনে জান কোরবান করি।
জ্ঞান অর্জনে আমাদের কান ও চোখ সাহায্য করে থাকে বলে প্রচারিত আছে নাকি, আর তাই সবচেয়ে শক্তিশালী এই সংবাদসমাজ এই দৃশ্যসমাজ এই ধ্বনিসমাজ।
আর আমাদের চোখ ও কান দৃশ্য ও শব্দ, চিন্তার রসদ হিসেবে, পায় টেলিভিশন থেকে, পত্রিকা থেকে।
আর তাতে জ্ঞান বিতরণ, সংবাদ বিতরণ, আর দৃশ্য আর শব্দ বিকিরণ করে মধ্যবিত্তরা, যারা আবার বণিকদের টাকার থলির ভেতর মাথা জমা দিয়ে এসব করতে পারে বলে প্রচারিত রব আছে।
আর পুজিপতিরা তার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের লাভলোকসানের সমানুপাতে নির্ধারণ করে, নির্মাণ করে, সৃজন করে, উদ্ভাবন করে, কৃত্রিম করে আমাদের শ্রুতিআকাক্সক্ষা, আমাদের দৃশ্যআকাঙ্খা।
আর আমরা সারাদিন খেয়ে ভাবি-না হজম হয়েছে কিনা।
রাতে তৃণভোজি প্রাণীর মতো তা ফের উদর থেকে টেনে ফের জাবর কাটি।
আর ভাবি এসব ঘিরে কী-ভাবা যেতে পারে। আর সমস্ত জ্ঞান ঝনঝন করে বাজে, ফাঁকা টিনের বাক্সে দুএকটা মার্বেলের মতো, সামান্য দোলায়, ফাঁকা মাথা হাহাকার করে ওঠে।
সমস্ত জ্ঞানের ফল: তারা আমাকে বলেছে, দুই আর পাঁচ । এবং বলেছে, এদের মাঝে যোগের সম্পর্ক, এবং বলেছে, দ্বিতীয় সংখ্যা থেকে প্রথম সংখ্যা বিয়োগও করতে পারো, এবং বিয়োগ ফলকে প্রথম সংখ্যার সাথে যোগ করলে পাবে শেষ সংখ্যা, মানে তৃতীয় সংখ্যা এবং শেষ সংখ্যা থেকে দ্বিতীয় সংখ্যা বিয়োগ করলে পাবে প্রথম সংখ্যা। আর আলাদাভাবে দুটি সংখ্যাই আছে।
আর তারা আলাদাভাবেও সঠিক। এবং যোগফল, বিয়োগফল সবই ঠিক, যে যেটা নেয়। তারা জানায়: আমাদের অনুরোধ শুধু বিয়োগ ফলের বেলা যেনো সে প্রথমসংখ্যাটি যোগ করে নেয়, কারণ আমরা চাই না কেউ আসলে সর্বনিন্মটা পছন্দ করুক, সর্বোচ্চটা জিতে নেবে না কেউ?
দেখুন সাতই সর্বোচাচ তাদের ধারণায়। কারণ তারা আপনার জন্য নির্ধারণ করেছে রেখেছে নেহায়েত দুই বা পাঁচ। আর আপনার স্বাধীনতার জন্য সবোর্চ্চ দুই, আপনার সন্তোষ্ট না হওয়ার সুযোগ তারা রাখেনি, আবার তারা আপনার স্বাধীনতাকে কিন্তু কৃপাও করেছে।
তাদের আবাহন করা ছাড়া আপানর কোন বিকল্প খোলা নেই।
আমি নেবো কোনটা: প্রথম সংখ্যা যোগ দ্বিতীয় সংখ্যা সমান তৃতীয় সংখ্যা, এবং দ্বিতীয় সংখ্যা বিয়োগ প্রথমসংখ্যা এবং এর ফলের সাথে যোগ দ্বিতীয় সংখ্যা সমান তৃতীয় সংখ্যা। সংখ্যা ঐ তিনটাই: প্রথম সংখ্যা, দ্বিতীয় সংখ্যা, এবং তৃতীয় সংখ্যা।
আর এর একটা সাথে নিয়ে বালিশে তলিয়ে যায় মাথাটা, খোলাচোখটা বন্ধ হতে হতে, যেটা আদতে বন্ধই ছিলো, যেটা ঐসব ছাড়া দেখেনি কিছুই, কিংবা হায়, ভাবেনি কিছুই, বা টের পায়নি সে রয়েছে তার ঐ বাক্স-পরিধির ভেতরেই, শুধ ঘুম তাকে ছিটকে ফেলে দিয়েছে যেনো তার বাইরে!
আর স্বপ্ন আসে, আবার টিভি বাক্সের স্ক্রিন থেকে গড়িয়ে নামে, তার মাথার ভেতর, লালার মতো, তার ঘুমন্ত অপুষ্ট মুখ থেকে যেভাবে ঝরে, দরিদ্র আত্মার অপুষ্টি-চিহ্নই শুধু, কোন সমাধান নেই, আর সে গোপন করে ফেলে তা জেগেই, কেননা তা শরমের বলে চারপাশে প্রচারিত, বহুকাল থেকেই!
তার, বা তাকে, বা তাদের বলছি কেন আমি!
চোখ একটাই, কান একটাই, মাথা সেও একটাই, তার বা আমারই।
অন্যকথায়, মাথাটা আসলে যেকারো মাথা, মানে মধ্যবিত্তের, মানে তার, বা আমারই, নিশ্চয় তারই, বা আমারই নিশ্চয়!
১২.১২.২০১০
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।