আমি পেশায় একজন স্পীচ থেরাপিষ্ট কিন্তু ব্লগ পড়া আমার নেশা। আর একটা নেশা আছে সেটা হল মুক্তিযুদ্ধের আসল ইতিহাস প্রতিটা মানুষের কাছে পৌছে দেয়া। আমি সে চেষ্টা এখনও চালিয়ে যাচ্ছি। আমি কোন ভালো লেখক নই কিন্তু আমি একজন ভালো পাঠক। আমাদের বাপ জীবনে বিরাট কিছু করতে পারেননি, ৭১ এ যুদ্ধের বাজারে দাদা সম্পত্তির পাহাড় বানিয়ে যাননি।
আমরা থাকি ভাড়া বাসায়। ঢাকায় থাকতে পারা আমাদের জীবনের বড় সার্থকতা। আপোষ করে বেঁচে থাকতে পারা আমাদের বড় বৈশিষ্ট্য।
আমরা মাসে দশ হাজার টাকা আয় করি, ব্যয় করি বারো হাজার। তারপরেও কীভাবে দিনের পর দিন আমরা চলছি
আর চলছি, সেটা একটা বিরাট রহস্য।
আসল আয়ের কয়েকগুণ বেশি জাঁকজমকের স্বপ্ন দিনের পর দিন দেখে যাই আমরা, বাস্তবে সেটাকে ফলতে না দেখে কষ্ট পাই। মিশি আমরা উচ্চবিত্তদের সাথে, এবং তাল রাখতে গিয়ে খাবি খাই।
আমাদের বাবাদের কাছে প্রতিটি পয়সার হিসেব দিতে হয়, কোথায় খরচ করেছি, কীভাবে করেছি। বাবাদের আমরা ভয় পাই, এবং যাবতীয় অভিযোগ করি মায়েদের কাছে। গৃহবধূ মা, বেচারিরা কোথা থেকে যে টাকা পান, কীভাবে পান - সেটা আমরা জানার চেষ্টা করি না।
শুধু শখের কিছু চাইলে কোথা থেকে যেনো টাকা এনে দেন - এটুকু আমরা জানি।
মাসের শেষের তিনদিন আমরা মাছ-মাংস খেতে পাই না, ডিমের ঝোল খাই। মা লজ্জা চেপে বলেন, "আজকে এই রান্না হয়েছে। " সামান্য খাবারের মধ্যে আমরা অসাধারণ স্বর্গীয় সুখ খুঁজে পাই।
আমরা রিকশায় চড়ি, লোকাল বাসে ঝুলি।
একান্ত দরকার ছাড়া সিএনজিতে আমরা খুব একটা চড়ি না। কারও প্রাইভেট কারের সামনের সিটে বসতে পারলে নিজেকে আমরা গাড়িটার মালিক বলে মনে করি।
আমাদের প্রেম, ভালোবাসা ইত্যাদি আবেগ সম্পর্কিত ব্যাপার নিয়ে খুব বেশি মাথা ঘামালে চলে না। যারা ঘামায় তারা কেউ ইতিহাস হতে পারেনি, তারা হেরে গিয়েছে। বাবা-মায়েরা তাই আতংকিত থাকেন আমাদের জীবনে প্রেমের গন্ধ পেলে।
আমরা শিল্প ভালোবাসি, সাহিত্যও ভালোবাসি। পরিবারে আমাদের গান-বাজনার চর্চাও থাকে অল্পবিস্তর। তবে সন্তানদের মধ্যে কেউ শিল্পকে পেশা বানাতে চাইলে আমরা বিস্তর আপত্তি জ্ঞাপন করি। আমাদের জীবনে সবচেয়ে বেশি আবৃত্ত বাক্য হচ্ছে, "এসব করে পেট চলে না। "
আমাদের সন্তানদের ওপরে আমরা চাপিয়ে দিই জীবনে মেলাতে না পারা যত অপূর্ণ চাওয়া-পাওয়ার হিসেব।
ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হয়ে গেলে ভালো, না হলে দিনের পর দিন আমরা বিসিএস পরীক্ষা দেই। পায়ের তলে শক্ত মাটি খোঁজা আমাদের চিরন্তন অভ্যাস।
আমরা ছেলে-মেয়েদের সরকারী ইউনিভার্সিটিতে পড়াতে চাই, এর বেশি খরচ করার সাধ্য আমাদের কোনওদিনও ছিলো না। ভাবখানা এমন, আমাদের সংসারে মধ্য-মেধার সন্তান জন্মাতে নেই। যদি ভুলে একটা কুলাঙ্গার জন্ম নিয়েই নেয়, তবে তার ওপরে সব রাগ ঝেড়ে মনে মনে অশ্রুপাত করি, আর বলি, "এর বেশি সামর্থ্য ছিলো না আমাদের।
"
ছাত্রজীবনে অনেক আশা নিয়ে প্রবেশ করি আমরা, ভাবি বিরাট কিছু করে ফেলবো। পাশ করে বের হয়ে মামা, চাচাদের খোঁজে দৌড়াই। মিলে গেলে ভালো, না মিললে বেকার বসে থাকতে হয় আর "কিছু একটা হয়ে যাবে" ভাবতে ভাবতে দিন পার করতে হয়।
সন্তানদের বিদেশ পাঠাতে পারলে আমাদের চেয়ে সুখী আর কেউ হয়না। বিদেশ গিয়ে সেই সন্তান যখন আমাদের ভুলে যায়, তখনও আমরা বড় গলা করে বলি, " আমার ছেলে বিদেশ থাকে।
"
অবচেতন মনে আমরা ছেলেই চাই, মেয়ে হলেও অবশ্য আপত্তি নেই, তবে তাকে যত দ্রুত সম্ভব বিয়ে দিয়ে তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করাটা আমাদের কর্তব্য বলে মনে করি। মেয়েদের পড়ালেখা আমাদের কাছে মূল্য রাখে অবশ্যই, তবে ছেলেদের মতো নয়।
আমরা শান্তিও খুঁজি, পিতৃপ্রদত্ত ধর্মটাকেও রাখতে চাই। আমরা পারতপক্ষে অন্য ধর্মের কাউকে বিয়ে করতে চাইনা লোকলজ্জার ভয়ে। পরিবারের মধ্যে যে এই কাজটি করে, পারিবারিকভাবে আমরা তার সাথে সম্পর্ক এড়িয়ে চলি।
জীবনসঙ্গী হিসেবে আমাদের আশা থাকে একটি রাজকন্যা পাওয়ার, এবং পাই মফঃস্বলের উচ্চ মাধ্যমিক পাশ, মোটামুটি ধরনের মেয়ে। আমাদের বিয়েগুলো পারিবারিক পছন্দে হয়। আমরা বিবাহ বিচ্ছেদের ঝামেলায় জড়াতে চাই না সন্তানদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে। স্বামী-স্ত্রী একে অপরকে পছন্দ না হলেও দিনের পর দিন আমরা সুখী দাম্পত্য জীবনের অভিনয় করে কাটিয়ে দেই ও আড়ালে দীর্ঘশ্বাস ফেলি।
আমাদের বার্ধক্য শুরু হয় পেনশন সংগ্রহের দৌড়ের মধ্য দিয়ে।
কিছুদিন পর আমরা হয়ে উঠি নাতি-নাতনিদের রূপকথা শোনানোর মেশিন। আমাদের প্রাচীনপন্থী চিন্তাধারার জন্য নাতি-নাতনিদের বাবা মায়েরা অবশ্য আমাদের সব উপদেশে কান দিতে নিজের সন্তানদের নিষেধ করেন।
তাই পুরনো স্মৃতি রোমন্থন আর ছেলের বৌয়ের অপমানজনক কথাবার্তা শুনতে শুনতে নিজের পরিবারেই গলগ্রহ হয়ে আমরা ভারতীয় বাংলা সিরিয়াল দেখতে দেখতে ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাই।
এই যে আমাদের মধ্যবিত্ত জীবনচক্র, এটা খুব সাধারণ। এর মধ্যে অসাধারণ কিছুই নেই।
মধ্যবিত্তরা অসাধারণ শুধু স্বপ্ন দেখার ক্ষেত্রে। জীবনে এমন কোনও স্বপ্ন নেই যেটা মধ্যবিত্তরা দেখে না, কিন্তু বেশির ভাগ স্বপ্ন হেরে যায় সামর্থ্যের কাছে।
স্বপ্ন দেখা, স্বপ্নে বসবাস করা, নিজের চোখে সেই স্বপ্নের মৃত্যু দেখা, এবং এবং আবার কোনও স্বপ্ন তৈরি করে তার মধ্যে বসবাস শুরু করা - এই হচ্ছে মধ্যবিত্ত জীবন। এখানে আর কোনও কিছুর স্থান নেই।
টাকা নামের এক মূল্যবান কাগজ দ্বারা চালিত এই পৃথিবীতে সব জায়গাতেই কেউ কেউ জিতে যায়, কেউ কেউ হেরে যায়।
যারা জিততেও পারে না, হারতেও পারে না, মাঝখানে নির্লজ্জের মতো ঝুলে থাকে - তারাই মধ্যবিত্ত।
courtesy - Shubhajit Bhowmik
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।