আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

খুনিরা নয়, কাঠগড়ায় গণমাধ্যম

আমাদের বিচার বিভাগ এবার গণমাধ্যমের দিকে দৃষ্টি দিয়েছে। শহীদ মিনার থেকে রাজধানীর ফুটপাত—কোনো কিছুই বিচার বিভাগের নির্দেশের বাইরে আর যাচ্ছে না। কেউ একজন জনস্বার্থে রিট আবেদন করলে সদাশয় বিচারপতিরা সে ব্যাপারে একটা রুল জারি করছেন। বিচার বিভাগ বা আরও নির্দিষ্ট করে বললে কয়েকজন বিচারপতি যেভাবে দ্রুততার সঙ্গে নির্দেশ দিচ্ছেন, তা খুবই প্রশংসনীয়। কিন্তু সব সময় তা বিতর্কের উর্ধে থাকতে পারছে না।

বিচারকদের কোনো কোনো রায়, মন্তব্য বা নির্দেশ দলীয় সংকীর্ণ স্বার্থ দ্বারা প্রভাবিত বলে অনেকে মনে করেন। দলীয় পৃষ্ঠপোষকতা ও দলীয় বিবেচনায় সম্প্রতি কয়েকজন বিচারপতি নিয়োগ পেয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। বিশিষ্ট আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক-উল হকের ভাষায়, ‘এখন মামলা কোন আদালতে হবে তা নিয়ে ভাবতে হয়। বিএনপি কোর্টে হবে না আওয়ামী লীগ কোর্টে হবে। ’ এ ধরণের অভিযোগ ওঠা আদালতের জন্য সম্মানজনক নয়।

রাজনীতি যত দিন দূষিত থাকবে, রাজনীতি যত দিন দুর্বৃত্তদের হাতে জিম্মি থাকবে, তত দিন নিরপেক্ষ বিচার ব্যবস্থা আশা করা করা যায় না। আদালত গণমাধ্যমকে নসিহত করেছে, কী লিখতে হবে, কীভাবে লিখতে হবে ইত্যাদি। এ প্রসঙ্গে আমাদের বক্তব্য হল, সাংবাদিকতা একটা দায়িত্বশীল ও স্বাধীন পেশা। সাংবাদিকদের বিবেকই তাঁদের রক্ষাকবচ। সাংবাদিকেরা বিবেকের নির্দেশেই পরিচালিত হয়।

এর সঙ্গে রয়েছে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত কিছু নিয়ম, নীতি ও নৈতিকতা। এর ব্যত্যয় হলে যেকোনো পাঠক বা দর্শক প্রেস কাউন্সিলে মামলা করতে পারেন। এমনকি ফৌজদারি আদালতেও মামলা করতে পারেন। মামলায় কোনো পত্রিকা, টিভি, বেতার বা সাংবাদিক দোষী সাব্যস্ত হলে তিনি তাঁর প্রাপ্য শাস্তি পাবেন। এ ব্যাপারে আমাদের বলার কিছু নেই।

কিন্তু সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়াই ঢালাওভাবে গণমাধ্যমকে অভিযুক্ত করা ঠিক নয়। আদালতের রায়, বিচারব্যবস্থা, বিচারকদের (নাম উল্লেখ করে) ভূমিকা সম্পর্কে কেউ তথ্যপ্রমাণহীন বক্তব্য দিলে আদালত তাঁর বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নিতে পারেন। ‘আদালত অবমাননা’ নামে একটা কথা আজকাল খুব পরিচিতি পেয়েছে। সম্প্রতি ইংরেজি দৈনিক নিউ এজ-এর একজন সাংবাদিক, ‘একুশে টিভি’ চ্যানেলের একজন উপস্থাপককে ‘আদালত অবমাননার’ অভিযোগে যথেষ্ট হয়রানির সম্মুখীন হতে হয়েছে। পরে তাঁদের দুজনকেই আদালত সতর্ক করে দেন।

গণমাধ্যমে ‘আদালত অবমাননা’ বলতে আসলে কী বোঝায়, তা এখনো খুব স্পষ্ট নয়। এ ব্যাপারে আদালতের নিজস্ব একটা ব্যাখ্যা আছে। কিন্তু সেই ব্যাখ্যাই যে শেষ কথা, এমনও নয়। গণমাধ্যমে ‘আদালত অবমাননা’ বিষয়ে আইনজীবী, বিচারক, সাংবাদিক ও সিভিল সোসাইটির সমন্বয়ে আলোচনা ও বিতর্ক হওয়া প্রয়োজন। প্রত্যেক সাংবাদিক, আলোচক, কলামিস্ট ও উপস্থাপকদের এ ব্যাপারে স্পষ্ট ধারণা থাকা উচিত।

সে জন্য সিরিজ আলোচনার মাধ্যমে এ ব্যাপারে একটা সর্বসম্মত নীতিমালা প্রণয়ন করা দরকার। বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউট এ উদ্যোগ নিতে পারে। কিন্তু এসব কাজে তাদের আগ্রহ আছে বলে মনে হয় না। সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে আদালত সাংবাদিকদের উদ্দেশে যে নির্দেশ দিয়েছেন, তা সাংবাদিক সমাজ মেনে নিতে পারেনি। ১ মার্চ ঢাকায় সাংবাদিকদের সমাবেশে সাংবাদিক নেতারা এ নির্দেশের সমালোচনা করেছেন।

তাঁরা বলেছেন, ‘বিচার বিভাগ থেকে কথা বন্ধের চেষ্টা হলে সাংবাদিকেরা তা মেনে নেবেন না। আদালত অবমাননার কারণে যদি জেলে যেতে হয়, তাহলে আমরা সবাই এক সঙ্গে জেলে যাব। ’ ‘বিচার বিভাগ আমাদের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করলে আমরা চুপ করে থাকতে পারি না। ’ ‘সাংবাদিকদের স্বাধীনতায় এর আগে যাঁরাই হস্তক্ষেপ করেছেন, তাঁদের হাত পুড়ে গেছে। ’ ‘এ নির্দেশ আপনারা দিতে পারেন না।

আপনাদের কাজ আপনারা করুন, গণমাধ্যমকে তাদের কাজ করতে দিন। যার যা কাজ তা-ই করতে হবে। ’ ‘খুনিদের কাঠগড়ায় দাঁড় না করিয়ে যেন গণমাধ্যমকেই কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হলো। ’ ‘কারও নির্দেশনায় গণমাধ্যম চলবে না। গণমাধ্যমের ওপর যেকোনো বাধা এলে তা আমরা প্রতিহত করব।

’ (প্রথম আলো, ২ মার্চ ২০১২) আশা করি, বিচার বিভাগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা সাংবাদিক নেতাদের বক্তব্য অনুধাবন করার চেষ্টা করবেন। সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের প্রতিবেদন লিখতে বা প্রচার করতে গিয়ে অনুমাননির্ভর মন্তব্য, লালমনিরহাটের জনসভায় বেগম খালেদা জিয়ার রায় দিয়ে দেওয়ার ভঙ্গিতে মন্তব্য করার জন্য আদালত বেগম খালেদা জিয়ার তীব্র সমালোচনা করেছেন। আদালতের এ সমালোচনার মধ্যে যুক্তি আছে। কিন্তু হঠাৎ একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে গণমাধ্যম ও রাজনৈতিক বক্তৃতার ভাষা পাল্টানো সম্ভব হবে কি? আমাদের অনেক দায়িত্বশীল রাজনৈতিক নেতা, সরকারের নানা মন্ত্রী প্রায়ই বিচারাধীন মামলার অভিযুক্ত ব্যক্তিদের ‘চোর’, ‘খুনি’ ‘যুদ্ধাপরাধী’ ইত্যাদি বিশেষণে ভূষিত করছেন না? মামলার রায়ের জন্য কি তাঁরা অপেক্ষা করছেন? মহামান্য আদালত কখনো এসব বক্তৃতা সম্পর্কে প্রশ্ন তোলেননি। আগেই বলেছি বিচার বিভাগের এ বক্তব্য যুক্তিসংগত।

কিন্তু তা শুধু খালেদা জিয়ার জন্য নয়, সব নেতার জন্যই প্রযোজ্য হবে। আমরা আশা করব, আদালত প্রধানমন্ত্রী ও অন্যান্য মন্ত্রীর এ ধরনের মন্তব্য সম্পর্কেও প্রতিক্রিয়া জানাবেন। ব্রিটেন বা অন্য কোনো সভ্য দেশে এ ধরনের মন্তব্য করলে যে জেলে যেতে হয়, এটাও যেন সবাইকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়। ব্রিটেন বা অন্য কোনো গণতান্ত্রিক দেশে আদালত পক্ষপাতমূলক মন্তব্য করেন না বা ওসব দেশে রাজনৈতিক দলের পরিচয়ে কোনো বিচারকের বেঞ্চও নেই। গণমাধ্যম, রাজনৈতিক নেতা, আলোচক কোনো বিচারাধীন মামলা সম্পর্কে কী বলতে পারবেন ও কতটুকু সমালোচনা করতে পারবেন—তা নিয়ে খোলামেলা আলোচনা হওয়া দরকার।

পুলিশ, র‌্যাব, গোয়েন্দা বিভাগ গণমাধ্যমকে বিচারাধীন ও তদন্তাধীন মামলা সম্পর্কে কতটুকু বলতে পারবে বা আদৌ কিছু বলতে পারবে কি না, তা-ও আলোচনা হওয়া দরকার। একটি তদন্তাধীন ও বিচারাধীন মামলার অগ্রগতি সম্পর্কে গণমাধ্যমের সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে কে কথা বলবেন, তা আগেই নির্ধারণ ও ঘোষণা হওয়া দরকার। সংশ্লিষ্ট কোনো কর্মকর্তা একজন ব্যক্তি সাংবাদিকের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে তথ্য দেবেন, না সব সাংবাদিকের সামনে নির্দিষ্ট দিন ও সময়ে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রেস ব্রিফিং করবেন, তা নিয়েও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটা সিদ্ধান্ত থাকা দরকার। টিভি ক্যামেরা দেখলেই কথা বলার অভ্যাস ত্যাগ করতে হবে। আমরা মনে করি, প্রেস ব্রিফিংয়ের সময় লিখিত বক্তব্য পাঠ করাই ভালো।

সেই কপিটি প্রত্যেক সাংবাদিককে দেওয়া যায়। এতে বক্তাকে ভুলভাবে উদ্ধৃত করার আশঙ্কা কমে। আমাদের সংবাদপত্র, টিভি, সংবাদ সংস্থার সবাই ধোয়া তুলসী পাতা, তা আমরা মনে করি না। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ নানা এজেন্ডা নিয়ে কাজ করতে পারেন। এ রকম সন্দেহ অনেকেই করেন।

তাঁরা নানা বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে চাইতে পারেন। সাংবাদিকতার মধ্যে তথ্যপ্রমাণহীন কিছু পাওয়া গেলে, সংবাদপত্র বা টিভি চ্যানেল সাংবাদিকতার নামে ‘মিডিয়া ট্রায়াল’ করার অপচেষ্টা করলে, বিচার কাজ বা তদন্ত কাজকে প্রভাবিত করতে চাইলে সুনির্দিষ্ট অভিযোগসহ প্রেস কাউন্সিলে মামলা করা যায়। এসব ক্ষেত্রে প্রেস কাউন্সিলকে দ্রুত রায় দেওয়ার উদ্যোগ নিতে হবে। দোষী প্রমাণিত সম্পাদক, প্রকাশক ও সাংবাদিককে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা রাখতে হবে। সাংবাদিকতার নামে ‘মিডিয়া ট্রায়াল’ কোনোভাবেই বরদাস্ত করা উচিত নয়।

তবে কোনটা ‘সাংবাদিকতা’ আর কোনটা ‘মিডিয়া ট্রায়াল’ তা ব্যাপক আলোচনা ও বিতর্কের মাধ্যমে আগেই স্থির করতে হবে এবং সব সাংবাদিককে এই সীমারেখা জানতে হবে। সাংবাদিকতার শুদ্ধতা বা দুর্বলতা চিহ্নিত করার দায়িত্ব তথ্য মন্ত্রণালয়ের নয়। এটা একমাত্র প্রেস কাউন্সিলই করতে পারে। আমরা বারবার লিখছি, প্রেস কাউন্সিলকে শক্তিশালী করা হোক। কিন্তু তথ্য মন্ত্রণালয় এ আহ্বানে সাড়া দিচ্ছে না।

আদালতে বা তথ্য মন্ত্রণালয় নয়, একমাত্র প্রেস কাউন্সিলই সাংবাদিকদের ত্রুটি বা দুর্বলতা চিহ্নিত করতে পারে। কোনো মহল থেকেই গণমাধ্যমের প্রতি নির্দেশ বা হস্তক্ষেপ কাম্য নয়। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.