প্রবাসী ছাত্র জীবনে লেখাপড়ার চিন্তা ছিল। এরপর কর্মজীবনে ছিল অর্থ উপার্জনের চিন্তা। আর এখন কোন চিন্তা নেই। কথায় বলে বেকারের কাজ বেশী। অর্থাৎ অবসর জীবনে আমার বেশী চিন্তা।
এ চিন্তার আগা মাথা নেই। ভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন চিন্তা মাথায় উকি দেয়। মাকড়শা যেমন ছোট থেকে শুরু করে আস্তে আস্তে বড় জাল বোনে আমার চিন্তা গুলোর পরিধি ও আস্তে আস্তে বেড়েই চলে। কেন্দ্র যখন পরিধি বাড়িয়ে বৃত্তের রূপ নেয় তখন কেন্দ্র আর খুজে পাই না। ডালপালার ভিড়ে কান্ডকে হারিয়ে ফেলি।
আমার চিন্তা গুলো হয়ে দাঁড়ায় “বিষম চিন্তা” চিন্তা করছিলাম মহাশুন্য নিয়ে লেখার, চলে এলো এসিড বৃস্টি।
বায়ুদুষনের এক কুফল হল এসিড বৃস্টি। এসিড সম্পর্কে কমবেশী সবাই জানেন, যারা বিজ্ঞানের ছাত্র তারা তো জানেনই । শান্তিপদ নন্দী ছিলেন স্কুলজীবনে আমাদের রসায়নের শিক্ষক। তার হাত ধরে সেই যে এসিডে হাতেখড়ি তারপর অনেক অনেক বছর কেটে গেছে, কিন্তু এসিডের চিন্তা এখনও মগজে ঘুরপাক খায়।
কোন দ্রবন অম্ল (এসিড) বা খার(এলকালি) তা নির্ভর করে কি পরিমান হাইড্রোজেন আয়োন বা হাইড্রক্সিল আয়োন থাকে তার উপর। কোন দ্রবন অম্ল না খার তা নির্দেশ করে ঐ দ্রবনের pH। pH হল হাইড্রোজেন আয়নের ঘনত্বের নেগেটিভ লগারিদম। এর মানে হল আপাতদৃস্টিতে ১ pH বদলানো খুব বড় মনে না হলেও তা কিন্তু হাইড্রোজেন আয়নের মাত্রা বদলায় ১০ গুন। pH মাপার স্কেল হল ০-১৪ পর্যন্ত।
পানিতে দুই আয়োনের পরিমান সমান আর তা হল নিউট্রাল অর্থাৎ অম্ল ও নয় আবার খার ও নয় এবং এর pH হল ৭। pH ৭ এর উপরে গেলে তা হল খার বা এলকালি, আর ৭ এর নীচে নামলে তা হল এসিড। আমাদের রক্তের pH হল ৭.৪ অর্থাৎ তা মৃদু খার। বৃস্টির পানি( pH ৫.৬) এবং পৃথিবীর অধিকাংশ জলাধার যেমন হ্রদ, সমুদ্র, নদীর পানি,সবগুলোই মৃদু এসিড। বায়ুমন্ডল ও হল মৃদু এসিড( pH ৫.৭) বায়ুমন্ডলের কার্বন ডাই অক্সাইড জলীয় বাস্পের সাথে মিশে তৈরী হয় কার্বনিক এসিড স্বাভাবিক অবস্থাতেই আর তাই বায়ুমন্ডল হল মৃদু এসিড।
ইতিহাস- বায়ুমন্ডলের অম্লত্ব বেড়ে গেলে তা যে পাথরের স্থাপনা বা ধাতব পদার্থের উপর প্রভাব ফেলে তা মানুষ জেনেছে অনেক কাল। মথুরার তেল রিফাইনারীর কারনে তাজমহলের পাথর তার ঔজল্য হারায় । শীতকালে বৃস্টির অম্লত্বের কারনে ধাতুর মুর্তিগুলো ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারে দেখে তা প্লাস্টিকের আবরনে ঢেকে রাখা হয় আমেরিকাতে। বৃটিশ বিজ্ঞানী রবার্ট আঙ্গুস স্মিথ ১৮৫২ সালে বৃস্টিরপানির অম্লত্ব বা এসিডিটি মেপে তার ক্ষতিকর প্রভাবের কথা বলেন। ১৯৭২ সালে এর নাম হয় “এসিড রেইন” কানাডার বিজ্ঞানী হারল্ড হার্ভে এর ক্ষতিকর দিক নিয়ে প্রথম গবেষনা করেন।
১৯৬০এর দশকে হ্রদ এবং গাছপালার উপর এসিডের প্রভাব নিয়ে তোলপাড় শুরু হয় ইউরোপ, আমেরিকা ,কানাডাতে। ১৯৭০ এর দিকে নিউ ইয়র্ক টাইমসে এসিড বৃস্টির ক্ষতিকর দিকের উপর নিবন্ধ প্রকাশ করে। ১৯৭৯ সালে জেনেভা কনভেনশানে এসিড বৃস্টি নিয়ন্ত্রনের পদক্ষেপ নেওয়া হয়।
কারনঃ-
শিল্প বিপ্লব জীবনযাপনকে করেছে সহজ এবং আরামদায়ক । তার হাত ধরেই এসেছে বায়ু দুষন।
শিল্পের তাপ এবং বিদ্যুতের চাহিদা মেটাতে, যানবাহনের জ্বালানী হিসেবে, প্রতিদিন পোড়ানো হচ্ছে লক্ষ লক্ষ টন তেল ,কয়লা,গ্যাস জীবাশ্ম জ্বালানী। এর থেকেই বায়ুমন্ডলে নির্গত হচ্ছে সালফার ডাই অক্সাইড, নাইট্রোজেন অক্সাইড ইত্যাদি গ্যাস। এদের মধ্যে ক্ষতিকর সালফার ডাই অক্সাইড গ্যাস সবচে’ বেশী নির্গত হয় কয়লা পোড়ানো থেকে। এসিড বৃস্টিকে দুই ভাগে ভাগ করা যায় ১)শুস্ক, ২) ভেজা। বায়ুমন্ডলের সৃস্ট এসিড যখন গ্যাস বা ধুলির আকারে নীচে নেমে আসে তা হল শুস্ক এসিড বৃস্টি আর যখন বৃস্টি, কুয়াশা বা বরফের সাথে এসিড নীচে নেমে আসে তা হল ভেজা এসিড বৃস্টি।
সালফার ডাই অক্সাইড পানির সাথে মিশে তৈরী হয় সালফিউরিক এসিড আর নাইট্রোজেন অক্সাইড থেকে তৈরী হয় নাইট্রিক এসিড, এমোনিয়াম নাইট্রেট প্রভৃতি।
এসিড বৃস্টির উৎপত্তি
ক্ষতিকর প্রভাবঃ- এসিড বৃস্টি পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। মাটি, গাছপালা, ঘরবাড়ী , নদী, সমুদ্র সবকিছুই এসিড বৃস্টির কারনে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। উদাহরন স্বরুপ পানিতে যদি অম্লত্ব ৪. ৫ এর নীচে নেমে যায় তাহলে মাছ , ব্যাঙ এবং অধিকাংশ অনান্য কীট পতংগ মারা যাবে।
এসিড বৃস্টির প্রভাব
গাছপালা এবং বনভূমির উপর এসিড বৃস্টি এবং বায়ূদুষনের প্রভাব অনাবৃস্টি, পোকামাকড়ের আক্রমন, বা দাবানলের চেয়েও বেশী ক্ষতিকর।
ইউরোপের ৩০টি দেশে গবেষনা চালিয়ে তারা সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে ঐ দেশগুলোতে ২৫% ভাগ বনভূমি বায়দুষন এবং এসিড বৃস্টির শিকার। জার্মানীতে গাছপালার মড়ক পরীক্ষা করতে গিয়ে বিজ্ঞানীরা দেখেছেনএসিড গাছের পাতার উপরকার মোমের মত আস্তরন ক্ষতিগ্রস্থ করার ফলে তা আর পানি ধরে রাখতে না পেরে শুকিয়ে যায়। এসিড বৃস্টি ইউরোপ এবং উত্তর আমেরিকাতে কমে এলেও তা উদ্বেগ জনক হারে বাড়ছে এশিয়াতে। চীন, কোরিয়া, ভারত, রাশিয়া প্রভৃতি দেশে ২০১০ সালে ১৯৯১ সালের তুলনায় বায়ুদুষন এবং এসিড বৃস্টি বেড়েছে তিনগুন। এর কারন হল এশিয়ার এই দেশগুলোতে জীবাশ্ম জ্বলানী ব্যবহারের পরিমান বাড়ছে দ্রুতগতিতে।
১৯৯০ সালের এক হিসেব অনুসারে সে বছর এশিয়াতে ৩ কোটি ২০লক্ষ মেট্রিক টন সালফার ডাই অক্সাইড নির্গমন ঘটে যা উত্তর আমেরিকার চেয়ে ৪০% বেশী। এসিডের ক্ষতিকর দিক বিবেচনা করে গ্যাসগুলোকে উচু উচু চিমনী দিয়ে বায়মন্ডলের উচু স্তরে নির্গমনের ব্যাবস্থা করা হয়েছে। উদ্দেশ্য হল বায়ু দুষন কমানো। দেখা গেছে যে কারখানা থেকে নির্গত গ্যাস বায়ুবাহিত হয়ে কয়েকশ বা হাজার মাইল দুরেও এসিড বৃস্টি হিসেবে নেমে আসছে।
এসিড বৃস্টিতে শুকিয়ে যাওয়া গাছপালা
মাটির উপর প্রভাব- বৃস্টির সাথে নীচে নেমে আসা এসিড মাটির নাইট্রিফাইয়িং ব্যাকটেরিয়াগুলোকে মেরে ফেলে।
এসিড জীবনের জন্য ক্ষতিকর মাটির উপাদান যেমন এলুমিনিয়াম বা ম্যাগনেসিয়াম ইত্যাদিকে সক্রিয় করে তোলে। জমি হারায় উর্বরতা। এসিড বৃস্টির ক্ষতিকর প্রভাব ইতিমধ্যেই প্রভাব ফেলেছে বিভিন্ন দেশের কৃষিক্ষেত্রে এবং গাছপালার উপর। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে পূর্ব ভারতের এক কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে নির্গত সালফার ডাই অক্সাইড বৃস্টির পরিমান মাটির শুষে নেওয়ার ক্ষমতার চেয়ে পাঁচ গুন বেশী। ফলে সেই বিদ্যুৎকেন্দ্রের আশে পাশের জমির উৎপাদন ক্ষমতা নেমে এসেছে ২২ কিলোমিটার দূরের জমির অর্ধেকের নীচে।
চীনের ঘুইঝৌ এবং সিচুয়ান প্রদেশের দুই তৃতিয়াংশ জমি এসিড বৃস্টির শিকার। ফলে শস্য উৎপাদনক্ষম জমির পরিমান কমে গেছে ১৬% ভাগ। কোরিয়াতে এসিড বৃস্টিতে আক্রান্ত শহর এবং গ্রাম্য বনভূমির পাইন এবং ওক গাছের বেড়ে ওঠা কমে গেছে উদ্বেগজনক হারে।
বাড়ী ঘর দোরের উপর প্রভাব- মার্বেল বা পাথর বা ধাতব পদার্থ দিয়ে তৈরী বাড়ী ঘরদোর এসিড আক্রমনের শিকার হয় বেশী। তাজমহলের উপর এসিডের প্রভাব ইতিমধ্যেই উল্লেখ করা হয়েছে।
মানব দেহের উপর প্রভাব- এসিড বৃস্টির সরাসরি প্রভাব স্বাস্থ্যের উপর খুব বেশী দেখা না গেলেও পরিবেশ দুষনের কারনে পরোক্ষ প্রভাব পড়ে। সালফার ডাই অক্সাইড গ্যাস যদি ধুলিকনার সাথে মিশ্রিত হয়ে নীচে নেমে আসে তা শ্বাস তন্ত্রের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। এসিড বৃস্টির কারনে মাটি থেকে ক্ষতিকর উপাদান যেমন মারকারী বা পারদ অধিক হারে পানিতে মিশে গিয়ে পানিকে করে তোলে দুষিত।
সমাধান- প্রথমতঃ বায়ু দুষনের জন্য দায়ী ক্ষতিকর গ্যাস যাতে তৈরী না হয় তা খেয়াল রাখতে হবে। প্রচলিত জ্বালানী শক্তির বিকল্প ক্লীন এনার্জি বা পরিবেশ বান্ধব শক্তির উৎস যেমন সুর্য শক্তি কে কাজে লাগাতে হবে।
দ্বিতীয়ত যে জ্বালানী যতকম ক্ষতিকর গ্যাস তৈরী করে তা ব্যবহার করতে হবে, যেমন উন্নত মানের কয়লাতে সালফারের পরিমান কম থাকায় তা ব্যবহার করা অধিকতার ভাল। তৃতীয়তঃ নির্গত গ্যাসগুলোকে লাইমস্টোন বা অন্য রাসায়নিক পদার্থ দিয়ে নিস্ক্রিয় করে দিতে হবে। এ লক্ষ্যে সমস্ত গ্যাস উদ্গীরনকারী কলকারখানায় এফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্লান্ট বসাতে হবে। বায়ুদুষন কারী গ্যাস গুলোকে বায়ুমন্ডলে বেরুতে না দেওয়াই এর সমাধান।
বাড়ী ঘরদোরে যত কম সম্ভব বিদ্যুৎ কম ব্যবহার করা যায় তত ভাল।
যেমন প্রয়োজন ছাড়া বাল্ব না জ্বালানো, এনার্জী সেভিং বাল্ব ব্যবহার, এনার্জী সেভিং বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার, এয়ার কন্ডিশানিং ব্যাবহার কম করা, যতকম সম্ভব জীবাশ্ম জ্বালানী বা গাছপাতা জ্বালানী হিসেবে ব্যবহার করা ইত্যাদি। কেনার সময় পরিবেশ বান্ধব জিনিসপত্র কেনা, স্থানীয়ভাবে উতপাদিত জিনিস ব্যবহার, যত কম সম্ভব গাড়ী ব্যবহার করা, গাড়ীর ইঞ্জিন নিয়মিত পরীক্ষা করা, হাটা বা সাইকেল চালানো , তেলের বিকল্প হিসেবে ইথানল বা প্রাকৃতিক গ্যাস ব্যবহার, সি এফ,সি বা ক্লোরোফ্লুরোকার্বন নির্গমন কমানো ইত্যাদি। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।