পাঠকের চিন্তা ও কর্মের সক্রিয়তা নিশ্চিত করাই পাঠকমেলার উদ্দেশ্য খোমেনী ইহসান একজন কথক। মানুষের দুনিয়াদারি বিষয়ে পরিচিত-অপরিচিত নির্বিশেষে কথা বলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবনে যখন তার পেশা ছিল ছাত্রত্ব, তখনো ছাত্র আন্দোলনের দরকারের প্রচুর কথা বলেছেন আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিকভাবে। এখন পেশাগত জীবনে সাংবাদিকতা করলেও কথা বলা চালু আছে। কিছু ক্ষেত্রে ভিন্ন মাত্রা এসেছে প্রকাশের দিক থেকে।
এখন সমসাময়িক বিষয়ে তার কথাবার্তার কিছুটা বলছেন লিখিত রুপে।
২০১১ সালের যেসব ঘটনা-প্রবণতাকে তিনি গুরুত্বপূর্ণ মনে করেছেন, সে সব নিয়ে বলার পাশাপাশি ইন্টারনেটে সামাজিক যোগাযোগ ওয়েবসাইট ফেসবুকে ও বিভিন্ন ব্লগে লিখেছেন প্রচুর। ওইসময় এক বছরকাল বেঁচে ছিল অনলাইন ম্যাগাজিন- রাজনৈতিক ডট কম। রাজনৈতিকে প্রকাশিত লেখাগুলো থেকে নির্বাচিত ছয়টি লেখার সংকলন 'খোমেনী ২০১১'। বইটি সম্পাদনা করেছেন মোহাম্মদ আরজু।
বইটির প্রকাশক আদর্শ, স্টল ৯৭ (বাংলা একাডেমী প্রাঙ্গণ বটতলার পশ্চিম পাশে)। দাম ১২৮ টাকা। মেলায় পাওয়া যাবে ৯৫ টাকায়।
বইটির শুরু হয়েছে খোমেনীর দুর্দান্ত পর্যালোচনা 'শেখ মুজিব ফিরে এসেছেন'র মাধ্যমে। এ পর্যালোচনায় তিনি দেখিয়েছেন কিভাবে নিহত হওয়ার সাড়ে তিনদশককাল পরে এসে শেখ মুজিবকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে এমন এক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে যে, তাকে অস্বীকার করে দেশটির রাজনীতি চলতে পারছে না।
কিভাবে একুশ শতকের সাম্রাজ্যবাদী বিন্যাসের দুনিয়াদারির অধীন বাংলাদেশ এখন তার দৃষ্টিভঙ্গির অনুসারেই পুর্নগঠিত হচ্ছে।
'শেখ মুজিব ফিরে এসেছেন'র পরের লেখা 'শিশু-কিশোরদের ওপর পরীক্ষা ও সাংবাদিকতার নিষ্ঠুরতা'। এ লেখায় তিনি দেখিয়েছেন কিভাবে গত দেড় দশকজুড়ে বাংলাদেশের শিশু-কিশোরদের মন-মগজে ক্রমশ এটা গেঁথে যাচ্ছে যে, প্রাতিষ্ঠানিক পরীক্ষার পাস-ফেলে’র সাথে তাদের বেঁচে থাকার শর্ত জড়িত আছে। কিভাবে শিশু-কিশোরদের জনপরীক্ষার ফলাফল নিয়ে পত্র-পত্রিকাগুলো কান্ডজ্ঞানহীন নিষ্ঠুরতায় লিপ্ত হয়েছে।
এরপরে ছাপানো হয়েছে খোমেনীর গুরুত্বপূর্ণ লেখা '‘অনভিপ্রেত ঘটনাবলী’ নয়, আগস্টে ‘পরিকল্পিত ছাত্র-গণ অভ্যুত্থান’ হয়েছিল'।
২০০৭-এর ২০ আগস্টে শুরু হওয়া ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম পরিকল্পক ও সংগঠক ছিলেন খোমেনী ইহসান। তিনি এ আন্দোলন করতে গিয়ে দৈহিক নির্যাতন ও মিথ্যা মামলার শিকার হন। ছাত্র আন্দোলন দমনের ব্যাপারে ২০১১ এর ১৯ মে জাতীয় সংসদের শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি কর্তৃক গঠিত উপ-কমিটিতে সাক্ষ্য দেন তিনি। তার ওই সাক্ষ্যের পরিপূর্ণ বিবরনই আছে লেখাটিতে।
এরপর খোমেনী কথা বলেছেন এমন এক জনের ব্যাপারে যখন মিরসরাইয়ে সড়ক দুর্ঘটনায় অর্ধশতাধিক শিশু-কিশোর নিহত হলে সবাই ঝাপিয়ে পড়েছিল তার উপর।
সেই ট্রাক চালক মফিজ উদ্দিনসহ বাংলাদেশের ড্রাইভারদের পক্ষ নিয়ে স্রোতের বিপরীতে গিয়ে তিনি সত্য উদ্ধার করেছেন। তিনি দেখিয়েছেন বাংলাদেশে মফিজ উদ্দিনদের মতো সাড়ে তিন হাত মানুষের গায়ে সড়ক দুর্ঘটনায় হাজার হাজার মানুষের খুন হওয়ার দায়ভার চাপিয়ে দিয়ে কিভাবে দায়িত্ব শেষ করা হচ্ছে। কিন্তু সড়ককে দুর্ঘটনা মুক্ত করার দায়টা কেউই নিচ্ছে না।
২০১১ সালে বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হচ্ছে বাংলাদেশ ও ইনডিয়ার পক্ষে করা 'শেখহাসিনা-মনমোহন চুক্তি'। এই চুক্তির তাৎপর্য ও প্রতিক্রিয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও এটা নিয়ে বাংলাদেশে কোন গুরুত্বপূর্ণ আলোচনাই হয়নি।
কেন হয়নি? বাংলাদেশে কি এমন পরাধীনতার পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে যে এই চুক্তির তাৎপর্য পর্যালোচনা করারও লোক খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এমন পরিস্থিতিতে আবারো হাজির হয়েছে খোমেনী। তিনি 'হাসিনা-মনমোহন চুক্তি : যার যা লোকসান ' শীর্ষক লেখায় এ চুক্তির ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ ও সিদ্ধান্ত হাজির করেছেন। তিনি দেখিয়েছেন এ চুক্তি বাংলদেশের নাগরিকদের সামনে হাজির হয়েছে জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো ও সুশিল সমাজের অনিচ্ছা ও দুর্বলতার দলিল হিসেবে। এর মধ্য দিয়ে এ শাসক শ্রেনীর পায়ের নীচ থেকে রাষ্ট্রের নেতৃত্ব দেয়ার মত অনুকূল শর্ত সরে যাচ্ছে।
রাজনৈতিক দলগুলোর কর্তৃত্ব দুর্বল হয়ে পড়ছে। অন্যদিকে, বিদ্যমান রাজনৈতিক দলগুলোর বিকল্প হিসাবে সুশিল সমাজের হাজির হবার মত অনুকূল পরিস্থিতি মাঠে মারা গেছে।
২০১১ সালে বাংলাদেশের সব মানুষের জন্য সবচেয়ে শোকের ও অসহায়ত্বের ঘটনা ছিল সৌদি আরবে শিরোশ্ছেদের নাম করে ৮ জন বাংলাদেশী শ্রমিককে হত্যার ঘটনা। 'শিরোশ্ছেদ প্রসঙ্গে' লেখায় খোমেনী ইসলামের কিসাস সংক্রান্ত বিধি-বিধানের দীর্ঘ পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত হাজির করেছেন- শিরোশ্ছেদের নামে সৌদি বিচারক ও জল্লাদগণ আট জন শ্রমিককে হত্যা করেছেন। যে হত্যাকান্ডের জন্য সৌদিকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।
তিনি দেখিয়েছেন কিভাবে শ্রমিকের প্রাণ রক্ষার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ সরকার অবহেলা ও গাফেলতি করেছে।
সব শেষে খোমেনী 'সরল মানুষ কাজী দীন মুহাম্মদ' লেখায় এমন একজন মানুষকে স্মরণ করেছেন যিনি ২০১১ সালে মারা গেছেন। মজাদার কিছু ঘটনার কথা বলে খোমেনী দেখিয়েছেন লোকটি কত সরল ছিল। যদিও তার ব্যাপারে মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীনতা বিরোধী ভূমিকা অভিযোগ ছিল। কিন্তু খোমেনী উদ্ধার করেছেন কাজী দীন মুহাম্মদের জ্ঞান তাপসের পরিচয় ও বিনয়কে।
এ বইটি বাংলাদেশের পর্যালোচনা সাহিত্যের বিস্তারকে আরো গতিময় করবে। যারা দুনিয়াদারির বিষয়াশয় নিয়া রাজনৈতিক পর্যালোচনা পছন্দ করেন, তারা এই বইটি পড়লে আরো সমৃদ্ধ হবেন। আর সবাই নিশ্চয় টের পাবেন কথক খোমেনী বাংলাদেশের কেমন ভবিষ্যতের একজন প্রোপাগান্ডিস্ট। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।