জাদুনগরের কড়চা
(লেখাটির সংক্ষিপ্ত সংস্করণ আজকের প্রথম আলোতে প্রকাশিত হয়েছে)
জ্ঞানের কোনো শেষ নেই, আর জ্ঞানই একমাত্র সম্পদ, যা দান করলে কমার বদলে বাড়তে থাকে। আর বহুজনের অল্প অল্প তথ্যকে সমন্বিত করে তৈরী করা সম্ভব জ্ঞানের বিশাল ভাণ্ডার। গত ১১ বছর ধরে এই কাজটিই করে চলেছে উইকিপিডিয়া নামের জনমানুষের বিশ্বকোষ, যার প্রতিটি শব্দ লেখা হয়েছে সম্পূর্ণ স্বেচ্ছাসেবীদের হাতে। মানবজাতির ইতিহাসে সর্বকালের সর্ববৃহৎ এই বিশ্বকোষ বর্তমানে তৈরী হয়ে চলেছে ২৭২টি ভাষায়। আর এরই একটি হলো বাংলা উইকিপিডিয়া http://bn.wikipedia.org - বাংলা ভাষায় লেখা একমাত্র মুক্ত জ্ঞানভাণ্ডার।
উইকিপিডিয়ায় বাংলা, বাংলায় উইকিপিডিয়া
উইকিপিডিয়ার সার্বজনীন যে লোগোটি সব উইকিপিডিয়াতেই ব্যবহৃত হয়, তার দিকে তাকালেই চোখে পড়বে, আমাদের প্রাণপ্রিয় বাংলা ভাষার "উ" অক্ষরটি। এই লোগোটি তৈরী করার সময়ে বিশ্বের সব গুরুত্বপূর্ণ ও বৃহত্তম ভাষাগুলোর লিপি এখানে দেয়া হয়েছে, আর তার মাঝে স্থান করে নিয়েছে বাংলাও। ভাষাভাষীর সংখ্যার দিক থেকে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ৭টি ভাষার মধ্যে রয়েছে বাংলা ভাষা। ২০০৪ সাল থেকে যাত্রা শুরু হওয়া উইকিপিডিয়ার বাংলা সংস্করণটি কাজপাগল কিছু তরুণের হাতে আস্তে আস্তে গড়ে উঠছে, আবির্ভূত হয়েছে বাংলা ভাষায় বিশ্বের বৃহত্তম তথ্যভাণ্ডার হিসেবে। বর্তমানে বাংলা উইকিপিডিয়াতে রয়েছে নানা বিষয়ের উপরে প্রায় ২৩,১০০টি নিবন্ধ।
এছাড়া বাংলা উইকি সংকলনে বর্তমানে সংরক্ষণ করা হয়েছে কপিরাইটের আওতামুক্ত বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সব নিদর্শনকে।
বাংলা উইকিপিডিয়ার নিবেদিত কর্মীদের কারো বাস বাংলাদেশে, কারো পশ্চিমবঙ্গে, কিংবা দূর প্রবাসে। কিন্তু যেখানেই থাকুননা কেনো, বাংলা উইকিপিডিয়ার মান বাঁড়াতে নানা কর্মকাণ্ডে তাঁরা জড়িত আছেন। সম্প্রতি যাত্রা শুরু করেছে উইকিমিডিয়া ফাউন্ডেশনের স্থানীয় শাখা উইকিমিডিয়া বাংলাদেশ - বাংলাদেশে উইকিপিডিয়ার প্রচার ও প্রয়াসই যার লক্ষ্য। এছাড়া অচিরেই চট্টগ্রামে প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে উইকিপিডিয়া অসম্মেলন তথা আনকনফারেন্স।
বাংলায় কেন দরকার বিশ্বকোষ?
আমাদের মায়ের ভাষা বাংলার মর্যাদা রক্ষায় ১৯৫২ সালে রক্ত দিয়েছেন সালাম বরকতেরা। এই বাংলা ভাষায় জ্ঞান বিজ্ঞানের চর্চাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া তাই আমাদেরই কর্তব্য। তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে ইন্টারনেটে বাংলা পিছিয়ে আছে অনেকাংশেই। ইউনিকোডভিত্তিক বাংলা ওয়েবসাইটের সংখ্যা ইন্টারনেটে হাতে গোনা। আর ইমেইল, ফেইসবুক থেকে শুরু করে এসএমএস সহ নানা প্রযুক্তি ব্যবহারে আমাদের নতুন প্রজন্ম বাংলার চেয়ে ইংরেজিতেই বেশি সাচ্ছন্দ্য অনুভব করে থাকে।
অনেক ক্ষেত্রেই বাংলা হরফের বদলে ইংরেজি হরফে লেখা হয় বাংলা। ইন্টারনেটে যেহেতু ইংরেজি ভাষার জয়জয়কার, সারা বিশ্বের অধিকাংশ তথ্য যেহেতু ইংরেজিতে, তাই আস্তে আস্তে জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চায় বাংলার বদলে ইংরেজিই প্রাধান্য পেয়ে যাচ্ছে।
এর পাশা পাশি রয়েছে আমাদের ইতিহাস আমাদের ঐতিহ্য রক্ষার তাগিদ। বাংলাদেশের প্রতিটি অঞ্চলেরই রয়েছে চমৎকার সব ইতিহাস। যেমন ধরুন, এই যে আজিমপুর এলাকার নামকরণ করা হয়েছে মোগল শাহজাদা আযম, অথবা মতান্তরে নায়েবে নাজিম আজিমউশশানের নামানুসারে।
পলাশী ব্যারাক এলাকা, বকশীবাজার, কারওয়ান বাজার – প্রতিটিরই নামের পেছনে আছে অনেক অনেক কাহিনী। আরো আছেন আমাদের ইতিহাসের জানা অজানা অনেক মানুষের কথা – শূণ্য পুরাণের রচয়িতা রামাই পন্ডিত, বাঁশের কেল্লার তিতুমীর, অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের প্রীতিলতা। এঁদের কথা সারা বিশ্বের অনেক বিশ্বকোষেই স্থান পায় নি। এর কারণ কিন্তু এরকম না যে, এঁরা উল্লেখযোগ্য নন। আসলে তো বিদেশীদের জন্য আমাদের দেশের অনেক তথ্যই রয়ে গেছে অজানা।
সেই তথ্যকে সংরক্ষণ করতে এগিয়ে আসতে হবে আমাদেরকেই। মনে রাখতে হবে, আমাদের ইতিহাস ঐতিহ্যকে রক্ষা করার কাজটা বিদেশ থেকে এসে কেউ করে দিবে না, এটা করতে হবে আমাদের নিজেদেরই।
বাংলাদেশের কোটি কোটি কিশোর ও তরুণ শিক্ষার্থীদের জন্য তথ্যের সমন্বিত সংকলনের বড়ই অভাব। একটা পূর্ণাঙ্গ বিশ্বকোষ কিনতে হাজার হাজার টাকার দরকার হয়। তাই তা অনেকেরই নাগালের বাইরে থেকে যায়।
কিন্তু উইকিপিডিয়া পাওয়া যাচ্ছে বিনা মূল্যেই, আর এর তথ্য হালনাগাদ করা হচ্ছে প্রতি নিয়তই, যা অন্য বিশ্বকোষে হয় না। উইকিপিডিয়ার তথ্য পেতে হলে ইন্টারনেট সংযোগ লাগবেই, এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নাই। এমন ব্যবস্থাও করা সম্ভব, যে পুরো উইকিপিডিয়ার ছোট একটি সংস্করণ একটা কম্পিউটারের হার্ড ড্রাইভে, পেন ড্রাইভে, বা সিডিতে করে সংরক্ষণ করা যায়।
কী করণীয়?
আমাদের প্রত্যেকের কাছেই কিছু না কিছু তথ্য আছে, এই ছোট ছোট তথ্যগুলোকে আমরা যদি একত্রিত করতে পারি, তাহলে কিন্তু খুব বিশাল একটা জ্ঞানের ভান্ডার গড়া সম্ভব। বাংলা উইকিপিডিয়া আমাদের এই সুযোগটা করে দিয়েছে।
মনে রাখতে হবে, উইকিপিডিয়ার মূল শক্তিই হচ্ছে আম জনতার সহযোগিতা। ইতিমধ্যে প্রচুর মানুষের সহযোগিতা আমরা পেয়েছি, পেয়েছি অনেক গুরুত্বপুর্ণ স্থাপনা ও পুরাকীর্তির ছবি। ভাষা সৈনিক অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম তাঁর তোলা ভাষা আন্দোলনের অমূল্য সব ছবি দান করেছেন উইকিপিডিয়ায়। বাংলা উইকিপিডিয়াকে সমৃদ্ধ করার কাজটা আসলে খুব কঠিন কিংবা সময়সাপেক্ষও নয়। প্রতিদিন ৫টি মিনিট সময় দিয়ে ছোট্ট একটি তথ্য যোগ করা, কিংবা ইংরেজি হতে বাংলায় তথ্য অনুবাদ করে দেয়া -- এরকম কাজগুলো যে কেউই করতে পারেন।
আর উইকিপিডিয়াতে কাজ করার জন্য বিশেষজ্ঞ হতে হবে এমন কথা নেই, বরং কাজ করার সদিচ্ছাটাই দরকার।
আগামী দিনের বিশ্বকে নিয়ে আমার অনেক স্বপ্ন রয়েছে, তার মধ্যে একটা হলো, বাংলাদেশের সব গ্রামের সব স্কুলের কিশোর কিশোরীদের কাছে পৌছে গেছে কম্পিউটার প্রযুক্তি ও ইন্টারনেট। এই প্রযুক্তি তারা ব্যবহার করছে পুরোপুরিই বাংলা ভাষায়। যে কোনো তথ্য জোগাড়ের প্রয়োজন হলেই তারা মুহুর্তের মধ্যে সেটা খুঁজে পাচ্ছে উইকিপিডিয়াতে। আমাদের এই সোনার বাংলার ইতিহাস, ঐতিহ্য – সব কিছুর কথা আগামী দিনের প্রজন্ম জানতে পারছে উইকিপিডিয়া ঘেঁটে।
আমার এই স্বপ্ন সফল হতে বেশি দিন লাগবেনা। দরকার শুধু আমাদের একটু চেষ্টা, একটু সময় দেয়া। সোনার বাংলার সোনার মানুষেরা সেটা করেই ছাড়বে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।