আগের পর্বগুলো:
ডারউইনের বিবর্তনবাদ থেকে মনুষ্যত্বের অবমাননাকারী বর্ণবাদী ইউজেনিক্স-গোড়ার কথা
ডারউইনের বিবর্তনবাদ থেকে মনুষ্যত্বের অবমাননাকারী বর্ণবাদী ইউজেনিক্স- এর প্রসার (১ম অংশ)
ডারউইনের বিবর্তনবাদ থেকে মনুষ্যত্বের অবমাননাকারী বর্ণবাদী ইউজেনিক্স- এর প্রসার (২য় অংশ)
সমাজতন্ত্রীরাও যে এই ইউজেনিক্স দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল তাও অজানা নয়। নাজীর অধীনস্হ মেডিসিন এর ইতিহাসবিদ রোবার্ট প্রক্টর এর মতে ১৯৩১ সালে জার্মানীর কম্যুনিস্ট পার্টি, বিশেষ ব্যবস্থায় মানসিকভাবে অসুস্হদের জন্য জন্মশুদ্ধিকরণের প্রতি সমর্থন ব্যাক্ত করেন….১৯৩১ থেকে ১৯৩৮ সাল পর্যন্ত জার্মান ও সৌভিয়েত ইউনিয়নের বিজ্ঞানীরা যৌথভাবে মস্কোতে প্রতিষ্ঠিত একটি রেসিয়াল জীববিজ্ঞান প্রতিষ্ঠানে একসাথে কাজ করত, যার উদ্যোক্তা ছিল জার্মান ইউজেনিস্ট লুডউইগ অ্যাশকফ এবং ওসকার ভগ। [১]
একই সুর ধ্বনিত হয় যুক্তরাষ্ট্রের কম্যুনিস্ট নেতা উইলিয়াম জে. ফস্টার এর কথায়। তিনি মনে করতেন, কম্যুনিস্ট সমাজ মানুষের মৌলিক উন্নতির দিকে মনোনিবেশ করবে। আর এই উন্নতি সম্ভব মানব প্রজাতির অমানবিক পন্থায় পরিশুদ্ধিকরণের মাধ্যমে!
অবশ্য রুশ বিজ্ঞানীদের মধ্যে ডারউইনবাদের চেয়ে ল্যামার্ক এর প্রতি আনুগত্য ছিল সবচেয়ে বেশী।
ল্যামার্কের মত তারাও মনে করত 'ব্যক্তির অর্জিত গুণাবলী বংশানুক্রমে সঞ্চারিত হয়'। কে. এ. তিমিরিয়াজেভ (১৮৪৩-১৯২০), আই. আই. মেচনিকফ (১৮৪৫-১৯১৬), পি. এ. ক্রপটকিন (১৮৪২-১৯২১), ভি. ও. কোভালেভ (১৮৪২-১৮৮৩), এ. ও. কোভালেভস্কি (১৮৪০-১৯০১) প্রমূখদের লেখা পড়লে দেখা যায় তারাও ডারউইনের বিবর্তনবাদকে পুরোপুরিভাবে মানতে পারেননি। বিবর্তনবাদকে ইংল্যান্ডের ধনতান্ত্রিক সমাজের প্রতিফলন হিসাবে দেখেছেন। এইসব রুশ বিজ্ঞানীদের প্রতিবাদ ছিল ডারউইনের 'অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই' নিয়ে, তারা মনে করতে এধরণের দৃষ্টিভঙ্গী সমাজে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব চের্নিশেভস্কি একহাত নিয়েছিলেন ডারউইনের উপর।
তিনি মনে করতেন ডারউইনের তত্ত্ব যদি সঠিক হত তাহলে জীবজগতে এক চরম বিশৃঙ্খলাতা দেখা দিত এবং সমাজ অগ্রগতির পথে পা বাড়াতে পারত না। তিনি মনে করতেন প্রকৃতি জগতে প্রতিযোগীতাই শেষ কথা নয়, সহযোগিতাই শেষ কথা। রুশ বুদ্ধিজীবিদের মধ্যে চের্নিশেভস্কির এই মতবাদকে অভিহিত করা হয়েছিল "চমৎকার, শক্তিশালী ও অনিন্দ্যসুন্দর' হিসেবে। রুশ বিজ্ঞানী ক্রপটিকনও মনে করতেন প্রাণীদের অস্তিত্বরক্ষার চাবিকাঠি হল তাদের সামাজিক জীবন-যাপন ও সহযোগিতার মনোভাব।
একই প্রজাতির প্রতিটি সদস্য প্রয়োজনে একে অপরের সাথে রক্তাক্ত সংঘর্ষে লিপ্ত হয় (অরিজিন অব স্পেসিস)- চরমপন্হী নেতা নিকোলাই নঝিন ডারউইনের এই কথাকে মানতে পারেননি।
তিনি ডারউইনকে অভিহিত করেন একজন 'বুর্জোয়া-প্রকৃতিবিদ' হিসেবে। রুশ রাজনৈতিক নেতাদের প্রাথমিক অবস্থায় বিবর্তনবাদ তত্ত্ব নিয়ে সংশয়ে ডারউইনের পারিবারিক অবস্থান প্রভাব ফেলেছিল। ডারউইনকে সাম্রাজ্যবাদী ইংল্যান্ডের উচ্চশ্রেণীর প্রতিনিধি হিসেবেই দেখেছেন।
সমাজতান্ত্রিক নেতৃত্বগোছীয়দের কাছে ডারউইনের বিবর্তনবাদ ছিল আশীর্বাদস্বরূপ। সমাজতান্ত্রিক মতবাদের প্রতিষ্ঠাতা মার্ক্স ও এঙ্গেলস [২] ডারউইনের প্রশংসায় ছিলেন পঞ্চমূখ।
বস্তুবাদী ধারণার উপর প্রতিষ্ঠিত ডারউইনের বিবর্তনবাদের সাথে দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ খুব ভালভাবেই খাপ খায়। সমাজতান্ত্রিক বলশেভিক বিপ্লবী নেতা ট্রটস্কি ডারউইনের আবিষ্কারকে দেখেছেন জৈব পদার্থের সমস্ত ক্ষেত্রে দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের সবচেয়ে বড় সফলতা। স্ট্যালিনও বিবর্তনবাদে এতই মজে ছিলেন যে, মেন্ডেলের জীনতত্ত্বকে গ্রহণ করতে অনীহা প্রকাশ করেন এটি বিবর্তনবাদের সাথে সাংঘর্ষিক হবে মনে করে। অপরদিকে কোটি কোটি মানুষ হত্যা করে তার উপর প্রতিষ্ঠিত চীনা সমাজতন্ত্রের স্থপতি মাও সে তুং-ও মনে করতেন চায়নার সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ডারউইন ও তার বিবর্তনবাদ তত্ত্বের উপর।
বস্তুবাদকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য বা নিরীশ্বরবাদ প্রচারের জন্য ডারউইনের মতবাদের কোনো বিকল্প ছিল না।
তবে সমাজতান্ত্রিকরা এই তত্ত্বের প্রয়োগে সমাজতন্ত্রের রং চটাতে ভুলতো না। বর্ণবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের গন্ধ থাকলেও সমাজতান্ত্রিকদের বস্তুবাদী ধারণার সাথে এর দহরম-মহরমটা বেশী থাকায় ডারউইনের বিবর্তনবাদকে গ্রহণে তারা পিছিয়ে থাকেনি। [৩]
উপসংহারে, ডারউইনের বিবর্তনবাদের সাথে ইউজেনিক্সের এক নিবিঢ় যোগসাজোশই পাওয়া যায়। প্রথম দিকে বস্তুবাদী সমাজতান্ত্রিকরা (রাশিয়ান) ডারউইনের বিবর্তনবাদকে বুর্জোয়া ও সাম্রাজ্যবাদীদের চাল হিসেবে অভিহিত করে একে দূরে ঠেলে দিলেও বস্তুবাদী ধারণার উপরই প্রতিষ্ঠিত বিবর্তনবাদকে পরবর্তীতে সমাজতন্ত্রের মধ্যে জায়গা করে দিতে কার্পণ্য করেনি। যে বিজ্ঞানের হাত ধরে এই ইউজেনিক্স প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল তাকে চাইলেই বিজ্ঞান থেকে সম্পর্কহীন বলার উপায় নেই।
রথী-মহারথী, রাজনৈতিক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের এই ইউজেনিক্সের প্রতি প্রত্যক্ষ সমর্থনতো ইতিহাসেরই অংশ! বর্ণবাদী ধারণার উপর প্রতিষ্ঠিত মনুষ্যত্বের অবমাননাকারী ইউজেনিক্স মতবাদ থেকে ইংল্যান্ডের উচ্চবংশীয় সমাজের প্রতিনিধি ডারউইনের অবদানকে চাইলেই ফুৎকারে উড়িয়ে দেয়া সম্ভব নয়। এই ডারউইনই ইংল্যান্ডের উচ্চবংশীয় সমাজের প্রথা অনুযায়ী কাজিন এম্মা উডজকে বিয়ে করেন। ডারউইনের কাজিন ফ্রান্সিস গাল্টন ইউজেনিক্সের প্রতিষ্ঠাতা। ডারউইনের পারিবারিক বন্ধু হাক্সলে বিজ্ঞানমহলে ইউজেনিক্সকে প্রতিষ্ঠা করতে সহায়তা করেছিলেন। ডারউইনের দুই ছেলে জর্জ ও লিওনার্দ ইউজেনিক্স আন্দোলনে সক্রিয় ভুমিকা রাখেন।
এর মধ্যে লিওনার্দ ১৭ বছর যাবৎ বৃটিশ ইউজেনিক্স সোসাইটির চেয়ারম্যান ছিলেন। বিবর্তনবাদীদের তারপরও ডারউইনকে ও তার বিবর্তনবাদ তত্ত্বকে ইউজেনিক্স এর সাথে সম্পর্কহীন বলে প্রচারণা চালানোটা দৃষ্টিকটূই ঠেকে! (সমাপ্ত)
সুত্র:
১। Robert N. Proctor, Racial Hygine: Medicine Under the Nazis, Harvard University Press, P23
২। Communism and Natural Selection
৩। Stephen Jay Gould’s Critique of Progress
এছাড়া সাহায্য নেয়া হয়েছে বাসুদেব মুখোপাধ্যায়ের "মানুষটির নাম ডারউইন (শ্রেয়া পাবলিকেশনস্)" বইটি থেকে।
পাদটীকা: লেখাটি ইতিপূর্বে সদালাপে প্রকাশিত হয়েছিল। সদালাপে আমি শামস নামে লিখি।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।