আগের পর্বগুলো:
ডারউইনের বিবর্তনবাদ থেকে মনুষ্যত্বের অবমাননাকারী বর্ণবাদী ইউজেনিক্স-গোড়ার কথা
ডারউইনের বিবর্তনবাদ থেকে মনুষ্যত্বের অবমাননাকারী বর্ণবাদী ইউজেনিক্স- এর প্রসার (১ম অংশ)
ইউজেনিক্সের সফল প্রয়োগকারী ছিলেন হিটলার। শুধু হিটলারের জার্মানীই নয় আধুনিক সভ্যতার ধারক দেশগুলিতেও ইউজেনিক্স প্রসার পায় ব্যাপকভাবেই, যা এক অর্থে করুণ। সভ্যতাকে টিকেয়ে রাখতে হলে দুর্বলের প্রতি অমানবিক হতে, তাদের নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারলেই যেন সভ্যতা নিষ্কন্টক হয়! [১]
হিটলারের নাজী জার্মানীর পর ইউজেনিক্স দ্বারা সবচেয়ে বেশী প্রভাবিত প্রতিষ্ঠানটির নাম সুইডেনের সোসাল ডেমোক্রেটিক পার্টি। [২] দলটি আবার গোঁড়া মার্ক্সিজম এরও অনুসারী। সুইডেনে ৪০ বছর যাবৎ প্রায় ৪০ হাজার লোককে বন্ধ্যাকরণ করা হয়।
১৯৭৬ সালে সুইডিশ পত্রিকা ড্যাগেন ন্যাইহেটার এ প্রকাশিত না হলে তা অজানাই থেকে যেত। সুইডিশ বিজ্ঞানীদের প্রত্যক্ষ সমর্থনেই সংঘটিত হয়েছিল এই বন্ধ্যাকরণ।
'ওয়ার অব দ্যা ওয়ার্ল্ডস' এর মত জনপ্রিয় কল্পকাহিনীর লেখক এইচ.জি. ওয়েলস ইউজেনিক্সকে জনপ্রিয় করতে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। উল্লেখ্য এই বই এর উপর ভিত্তি করে টম ক্রুজ অভিনীত হলিউডের একটি ছবি বছর কয়েক আগে মুক্তি পায়। এইচ জি ওয়ালেস ১৯২৮ সালে মেনিফেস্টো 'দ্যা ওপেন কন্সপাইরেসী (The Open Conspiracy)' তে মান-নিয়ন্ত্রিত সংকরায়নের পক্ষে মত দেন।
বিখ্যাত বৃটিশ লেখক জর্জ বার্নার্ড শ' হিটলারেরর অসহায় ও মানসিকভাবে বিকলাঙ্গদের হত্যাকাণ্ডকে সমর্থন করতেন। বামপন্থী ঘরনার এই বিশিষ্টজন স্ট্যালিনের সাথে সাথে হিটলারের প্রতি ব্যক্ত করেছিলেন প্রত্যক্ষ সমর্থন [৩]। উল্লেখ্য যে, হিটলারের নাজী সংগঠনটি "ন্যাশনাল সোস্যালিস্ট ওয়ার্কার্স পার্টি" বা "জাতীয় সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক সংগঠন" নামে পরিচিত।
নিউইয়র্কে কোল্ড স্প্রিং হারবর গবেষণাগারের প্রতিষ্ঠাতা চার্লস ডেভেনপোর্ট যুক্তরাষ্ট্রে ইউজেনিক্স মতবাদের প্রচারে আত্ননিয়োগ করেন। আর তার এই গবেষণাগারে অবাধে টাকা ঢালতেন নামকরা সব ব্যক্তিরা, তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল জন. ডি. রকফেলোর, এন্ড্রু কার্ণেগী এবং হারিম্যান পরিবার।
এ গবেষণাগারে মানুষের উপর ইউজেনিক্স এর ব্যবহারিক প্রয়োগের ব্যাপারে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হতো। চার্লস ডেভেনপোর্ট ১৮৯৯ সাল পর্যন্ত শিক্ষকতা করেন এর পরপরই শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে স্হানান্তরিত হন। অবশ্য এর আগেই তিনি লং আইল্যান্ড এর কোল্ড স্প্রিং হারবর এ কার্নেজী ইনস্টিটিউট'স অব জেনেটিক্স ও বিবর্তন বিষয়ে গবেষণাগার প্রতিষ্ঠা করেন। অন্যদিকে রকফেলার জার্মানীর "কাইসার ওয়েইহেলম প্রতিষ্ঠান"কে ইউজেনিক্স এর প্রসারের জন্য উদারহস্তে দান করতেন এবং নাজী সংগঠনের উপর প্রভাব বিস্তার করেন।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসন সর্বপ্রথম অমানবিক জন্মশুদ্ধিকরণ আইন পাশ করেন।
এই আইন সমাজের অপাংক্তেয় বিশেষ করে মানসিকভাবে অসুস্হ, কম আইকিউ সম্পন্ন লোক, এমনকি বিকলাঙ্গ শিশুদের উপর প্রয়োগ করা হয়। এই সময় কালেই অষ্ট্রেলিয়া-কানাডাতেও এর প্রভাব পড়তে থাকে। ১৯১০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় 'যুক্তরাষ্ট্র ইউজেনিক্স রেকর্ড কেন্দ্র'।
তাছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের আইনজীবী, নৃতত্ত্ববিদ ম্যাডিসন কনরাড বিখ্যাত হয়ে আছেন 'দ্যা পাসিং অব দ্যা গ্রেট রেস (The Passing of the Great Race)' বইটার জন্য। এই বইটিকে হিটলার তার বাইবেল নামে অভিহিত করেন।
পিছিয়ে ছিলেন না নারীবাদী ইউজেনিস্ট মার্গারেট সানগার। তিনি যে শুধু এইচ.জী. ওয়েলসের উত্তম সহকর্মী ছিলেন তা-ই নয়, তিনিই প্রথম জন্মনিয়ন্ত্রণ ক্লিনিক খোলেন যা অবশেষে পরিকল্পিত পিতৃত্ব নামে খ্যাতি লাভ করে। আর এর মূল অর্থ যোগানদাতা সেই রকফেলার।
ইউজেনিক্স এর প্রথম আন্তর্জাতিক সন্মেলন হয় ১৯১২ সালে আর তাতে সভাপতিত্ব করেন বিবর্তনবাদের প্রতিষ্ঠাতা ডারউইনের ছেলে লিওনার্দ ডারউইন [৪]। অনুষ্ঠানটা উৎসর্গ করা হয় ডারউইনের চাচাত ভাই ও ইউজেনিক্স এর প্রতিষ্ঠাতা স্যার ফ্রান্সিস গাল্টনকে।
এতে উপস্হিত ছিলেন জর্জ বার্নার্ড শ', বৃটিশ সোস্যাল ডেমোক্রাট নেতা সিডনী ওয়েব ও কানাডা থেকে টমি ডগলাস, লেখক এইচ. জি. ওয়েলস, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসন, রুজভেল্ট, স্যার উইস্টন চার্চিল এবং আরো অনেক নামকরা ব্যক্তিরা। উল্লেখ্য, লিওনার্দ ১৯১১ থেকে ১৯২৮ সাল পর্যন্ত বৃটিশ ইউজেনিক্স সোসাইটির চেয়ারম্যান ছিলেন [৫]। ডারউইনের আরেক ছেলে জর্জও [৬] ইউজেনিক্স আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন।
আর দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক সম্মেলন হয় নিউইয়র্কে ১৯২১ সালে। তারবার্তা উদ্ভাবনের জনক বিজ্ঞানী আলেকজান্ডার গ্রাহামবেল ছিলেন এর সম্মানিত প্রেসিডেন্ট।
এতে ল্যাটিন আমেরিকার দেশ মেক্সিকো, কিউবা, ভেনিজুয়েলা, উরুগুয়ে এবং এশিয়ার জাপান, ভারত ও সিয়াম থেকেও প্রতিনিধিরা জড়ো হয়। আর প্রধান আলোচ্য বিষয় ছিল উন্নত বংশধারা ধরে রাখার জন্য 'অনুপোযুক্ত'কে নিশ্চিহ্ন করে দেয়া। ইউজেনিক্সের তৃতীয় আন্তর্জাতিক সম্মেলন হয় নিউইয়র্কে ১৯৩২ সালে আর এর সভাপতিত্ব করেন চার্লস ডেভেনপোর্ট।
ইউজেনিক্স দ্বারা প্রভাবিত হয়েই যুক্তরাষ্ট্রে ১৯২৪ সালে অধিকাংশ রাজ্যে অভিবাসন আইন পাশ করে যার দ্বারা যেসব দেশে 'নীচ প্রজাতির' মানুষের সংখ্যাধিক্য বেশী, যেমন: দক্ষিণ ইউরোপ ও এশিয়া সেসব দেশে থেকে মানুষ আসার ব্যাপারে বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়। প্রেসিডেন্ট কলিজ এই আইনে স্বাক্ষর করেন এবং ভাইস প্রেসিডেন্ট থাকা অবস্হায় বলেছিলেন: "আমেরিকা আমেরিকান হিসাবেই থাকবে….. জীববিজ্ঞানের আইনানুসারে অন্য জাতির সাথে মিশলে জাতিসত্তায় ভেজাল ঢুকে পড়ে [৭]।
"
ইউজেনিক্স পাশ্চাত্যের সীমা ছাড়িয়ে প্রাচ্য ও প্রাতীচ্যেও প্রসার লাভ করেছিল। চীনের জীনবিজ্ঞানীদের উপর ১৯৯৩ সালে করা এক জরিপে দেখা গেছে শতকরা ৯১ জন ইউজেনিক্সকে সমর্থন করেন [৮]। জরিপে ২৫৫ জন জীনবিজ্ঞানীর অংশগ্রহণ করেন, আর তা বৃটিশ পত্রিকা নিউ সায়েন্টিস্ট-এ প্রকাশিতও হয়েছিল। (আগামী পর্বে শেষ…)
সূত্রঃ
১. http://www.theepochtimes.com/n2/opinion/hitler-socialism-racial-agenda-part-ii-13209.html
২. http://www.nature.com/nature/journal/v389/n6646/full/389009a0.html
৩. http://www.youtube.com/watch?v=hQvsf2MUKRQ
৪. http://en.wikipedia.org/wiki/Leonard_Darwin
৫. http://en.wikipedia.org/wiki/Leonard_Darwin
৬. http://citation.allacademic.com/meta/p_mla_apa_research_citation/0/8/8/7/7/pages88779/p88779-53.php
৭. http://www.pbs.org/wgbh/aso/databank/entries/dh23eu.html
৮. http://news.bbc.co.uk/2/hi/asia-pacific/198555.stm
পাদটীকা: লেখাটি ইতিপূর্বে সদালাপে প্রকাশিত হয়েছিল। সদালাপে আমি শামস নামে লিখি।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।