প্রগিশীল, মুক্তমনা, সমঅধিকার এবং মানবতাবাদে বিশ্বাসী [প্রবন্ধটি ঢাকার শ্রী শ্রী রমানা কালী মন্দির এবং শ্রীমা আনন্দময়ী আশ্রমে অনুষ্ঠিত শারদীয় দুর্গোৎসব ১৪১৯ উপলক্ষে প্রকাশিত স্মরণিকায় প্রকাশিত ।] বিবর্তনবাদের জনক চার্লস রবার্ট ডারউইন নাস্তিক ছিলেন, নাকি আস্তিক? তাঁর মৃত্যুর সোয়া’শ বছরে বেশি সময় পরও এই বিতর্ক মাঝেমধ্যেই মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে ৷ শুধু তাই নয়, ডারউইনের মূল আবিষ্কার বিবর্তনবাদের প্রতিও ব্যাপক ভিন্নমত পোষণ করতে দেখা যায় ৷ আমেরিকার পিউ রিসার্চ সেন্টার কর্তৃক ২০০৫ সালে পরিচালিত এক জনমত জরিপে দেখা যায় ৬৪% মার্কিনী শ্রেণীকক্ষে ছাত্রদেরকে বিবর্তনবাদের পাশাপাশি সৃষ্টিবাদ পড়ানোর পক্ষপাতী ৷ পরবর্তী বছর একই গবেষণা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক পরিচালিত আরেক জনমত জরিপে দেখা যায় ৬৩% মার্কিনী বিশ্বাস করেন যে, এক মহাশক্তির নির্দেশনায় মানুষ এবং অন্যান্য প্রাণিকূল তাদের বর্তমান আকারে অবস্থান করছে অথবা সময়ের সাথে সাথে তাদের আকার বিবর্তিত হচ্ছে ৷ মাত্র ২৬% মার্কিনীরা উত্তরে বলেন যে, পুরোপুরি প্রাকৃতিক নিয়মের মাধ্যমে জীবজগতের বিবর্তন হয়ে আসছে ৷ ঈশ্বর সম্পর্কে ডারউইনের বিশ্বাস নিয়ে বিগত দশকের টেলিভিশনের উত্সাহী গসপেল প্রচারক জিমি সোয়াগার্ট ১৯৮৫ সালে বিতর্কের সূত্রপাত করেন ৷ তিনি দর্শক-শ্রোতাদেরকে একটি চমত্কৃত ঘোষণার মাধ্যমে অনেকটা বিমোহিত করে ফেলেন৷ সোয়াগার্টের ঘোষণায় বলা হয়- মৃত্যুশয্যায় ডারউইন একখণ্ড বাইবেল চেয়েছিলেন ৷ তবে পরবর্তীতে জানা যায় এই প্রচারণাটি ছিল পুরোপুরি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত একটি রটনা এবং ডাহা মিথ্যা কথা ৷ ডারউইন নাস্তিক, নাকি আস্তিক ছিলেন এ নিয়ে মূলত প্রথম বিতর্কের সূত্রপাত করেন এডমিরাল স্যার জেমস হোপের স্ত্রী এলিজাবেথ কটন ৷ ১৮৮২ সালে ১৯ এপ্রিল ডারউইনের মৃত্যুর ৩৩ বছর পর ১৯১৫ সালে লেডি হোপ প্রচার করেন যে, তিনি ডারউইনকে মৃত্যুশয্যায় বলতে শুনেছিলেন- “আমার বিবর্তন তত্ত্ব লোকজনকে ওভাবে না জানালেই পারতাম” ৷ লেডি হোপ ইঙ্গিত করেন, মৃত্যুশয্যায় ডারইউন সদাই বাইবেল পড়তেন এবং কী পড়ছেন জিজ্ঞেস করা হলে তিনি নাকি উত্তরে জানিয়েছিলেন, “রাজসিক বই- হিব্রুস” ৷ ডারইউনকে নাকি এরকমও মন্তব্য করতে শোনা গিয়েছিল, “আমি অপরিপক্ক ধারনাসম্পন্ন এক যুবক ছিলাম” ৷ লেডি হোপ পুনরায় দাবি করে বলেন যে, তিনি ডারউইনের বাসভবন থেকে চলে আসার পূর্বে ডারউইন নাকি তাকে পুনরায় তাঁর গ্রীষ্মকালীন বাসভবনে যেতে বলে তার গৃহকর্মীদের সাথে কথা বলতে বলেছিলেন৷ কী কথা বলবেন জিজ্ঞেস করলে ডারউইন নাকি লেডি হোপকে উত্তরে জানিয়েছিলেন, “যিশু খ্রিস্ট সম্পর্কে” ৷ লেডি হোপের বক্তব্যের পূর্ণ বিবরণ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হলে দুর্ভাগ্যজনকভাবে তাতে অনেক অসঙ্গতি ধরা পড়ে বলে তা অসমর্থনযোগ্য হয়ে যায়, অর্থাৎ ডারউইনরে মৃত্যুশয্যায় লেডি হোপ তাঁকে দেখতে যাননি এবং ডারউইন তাঁর বিবর্তনবাদ পরিহার করে কখনোই কোন বক্তব্য দেননি বা বাইবেল বা যিশু খ্রিস্ট সম্পর্কে তিনি কোন কথাই বলেন নি ৷ অন্যদিকে, জনসমক্ষে লেডি হোপের বক্তব্য প্রকাশের পরপরই ডারউইনের পরিবার থেকে তা প্রত্যাখান করা হয় ৷ তাঁর পুত্র-কন্যারা এ সব অপপ্রচারে বেজায় চটে যান৷ ১৯১৫ সালে জেমস হো’কে লেখা এক পত্রে ডারউইনের পুত্র ফ্রান্সিস জানান, “তিনি (ডারউইন) তাঁর পরিবারের অজ্ঞাতসারে প্রকাশ্যে ও সোত্সাহে খ্রিস্টান বনে যাননি এবং এ ধরনের কোন পরিবর্তন ঘটেনি” ৷ ১৯১৮ সালের ২৮ মে লেখা পত্রে ফ্রান্সিস পুনরায় জানান, “আমার পিতা সম্পর্কে লেডি হোপের দেয়া তথ্য পুরাপুরি অসত্য ৷ তার মিথ্যাবাদীতার জন্য আমি তাকে প্রকাশ্যে অভিযুক্ত করেছি, কিন্তু আমি কোন উত্তর দেখতে পাইনি” ৷ আর ১৯২২ সালে ডারউইনের কন্যা হেনরিয়েটা লেখেন, “আমি তাঁর মৃত্যুশয্যাপাশে উপস্থিত ছিলাম৷ তাঁর শেষ রুগ্নতাকালে বা কোন রুগ্নতাকালেই লেডি হোপ উপস্থিত ছিলেন না ৷ তিনি কখনোই, অর্থাৎ মৃত্যুশয্যায় বা তার পূর্বে তাঁর কোন বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিকে অমূলক বলে পরিহার করেননি” ৷ এ ব্যাপারে যা সত্য তা হচ্ছে- ১৮৮২ সালের ১৯ এপ্রিল মারা যাবার পূর্বে স্ত্রী এমাকে উদ্দেশ্য করে পরিবারের প্রতি ডারউইনের শেষ বক্তব্য ছিল, “মৃত্যু নিয়ে আমি এতটুকু ভীত নই৷ মনে রেখো, তুমি আমার কাছে কতটাইনা উত্তম স্ত্রী ছিলে ৷ আমার সন্তাদেরকে মনে রাখতে বলবে, ওরা কতটাইনা আমার কাছে উত্তম ছিল” ৷ মূলত জীবদ্দশায় ডারউইন কখোনই নিজেকে নাস্তিক বলে ঘোষণা দেননি বিধায় ধর্ম ও ঈশ্বর প্রশ্নে তাঁর অবস্থান নিয়ে মাত্রাতিরিক্ত বিতর্কের সৃষ্টি হয় ৷ এ বিষয়টি নাস্তিক ও আস্তিক- উভয় পক্ষের জন্যই খানিকটা অসুবিধারই বটে ৷ এতদ্সত্ত্বেও ধর্ম ও ঈশ্বর নিয়ে তাঁর অবস্থানকে হেঁয়ালিপূর্ণ বলার সুযোগ নেই ৷ পরিণত বয়সে ডারউইনের লেখা আত্মজীবনীমূলক রচনাসমূহের “ধর্মীয় বিশ্বাস” শীর্ষক প্রবন্ধে এসব বিষয় প্রকাশ পেয়েছে ৷ এতে দেখা যায়- স্বঘোষিত নাস্তিক না হলেও পরিণত বয়সে এসে তিনি প্রচলিত ধর্মে আস্থা হারিয়েছিলেন ৷ তাঁর ভাষায়, “চল্লিশ বছর বয়সে পৌঁছার পূর্ব পর্যন্ত আমি মোটেও খ্রিস্টধর্ম পরিত্যাগ করিনি” ৷ ডারউইনের এই বক্তব্যে প্রকাশ পায়- ১৮৪৯ সালে ৪০ বছরে পা দেবার পর ধর্মের প্রতি তাঁর অনীহার উদ্রেক ঘটে ৷ তবে মোটেই সহজভাবে বা হঠাৎ করেই ধর্মের সাথে তাঁর বিচ্ছেদ ঘটেনি ৷ কারণ, পিতা রবার্ট এবং পিতামহ ইরাসমাস দু’জনই মুক্তচিন্তার মানুষ হিসেবে পরিচিত থাকলেও ডারউইন প্রথম জীবনে যিশুখ্রিস্টে বিশ্বাসী ছিলেন ৷ ডারউইনের জীবনী ঘেটে দেখা যায়- কেম্ব্রিজে অধ্যয়নকালে পরীক্ষা ঘনিয়ে এলে তিনি উইলিয়াম পেলি’র ‘খ্রিস্টীয় সাক্ষ্যপ্রমাণ’ শীর্ষক ভাষা ও যুক্তিবিদ্যার প্রতি ঝুঁকে পড়েন ৷ ১৮৩১ সালে জানুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিত উক্ত বিষয়ের পরীক্ষায় ১৭৮ জন ছাত্রের মধ্যে তিনি ১০ম স্থান লাভ করেন৷ ঐ বছর জুন মাস পর্যন্ত ডারউইনকে কেম্ব্রিজে অবস্থান করতে হয় ৷ সেখানে তিনি পেলি’র ‘প্রাকৃতিক ধর্মতত্ত্ব’ বিষয়ে পড়াশুনা করেন৷ কেম্ব্রিজ থেকে পাশ করার পর একজন ধর্মীয় যাজক হবেন বলে তাঁর লক্ষ স্থির ছিল৷ উল্লেখ্য, তাঁর সবচেয়ে প্রিয় মামাতো বোন, পরবর্তীতে স্ত্রী এমা গভীরভাবে ধর্মে বিশ্বাসী ছিলেন বলে এ ব্যাপারে তিনি ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন ৷ কিন্তু, ১৮৩১ সালের ২৭ ডিসেম্বর থেকে ১৮৩৬ সালের ২ অক্টোবর পর্যন্ত এইচএমএস বিগ্ল জাহাজে সমুদ্রযাত্রায় ডারউইনের জীবনের আমূল পরিবর্তন ঘটে৷ পাঁচ বছরের এই সমুদ্রযাত্রা বিবর্তনবাদের জনকের ধর্মীয় বিশ্বাসের শুধু পরিবর্তনই নয়, তাঁকে নাস্তিক বা অজ্ঞেয়বাদী করে তোলে ৷ ২২ বছর বয়সের তরুণ ডারউইন যখন বিগ্ল জাহাজে চড়েন, তখন তাঁর কোন ধারণাই ছিল যে, ঐতিহাসিক ঐ সমুদ্রযাত্রা কেবলমাত্র তাঁর নিজের জীবনের মোড়ই নয়, গোটা মানবজাতির ইতিহাস, জীব ও প্রকৃতি সম্পর্কে ধারণা, ঈশ্বরের সাথে মানবজাতির সম্পর্কের ভিত ইত্যাদি সবকিছুই নাড়িয়ে দেবে ৷ মজার ব্যাপার হচ্ছে- বিগ্লে চড়ার সময় নিত্যব্যবহার্য জিনিসপত্রের সাথে তিনি একখণ্ড বাইবেলও নিয়েছিলেন৷ কারণ, তখনও ডারউইন ধর্ম-দর্শনের প্রশ্নে ঈশ্বরের ‘অমোঘ ও অলংঘনীয়’ বিধানে বিশ্বাসী ছিলেন ৷ সে সময় তাঁর সরল বিশ্বাসের মধ্যে ছিল- প্রকৃতিতে সবকিছুর একটা চূড়ান্ত পরিণতি রয়েছে, আর এই প্রকৃতির অপার লীলার আড়ালে রয়েছে মহাপ্রতিভাবান ও মহাসৃজনশীল কারো হাত- যিনি ঈশ্বর এবং প্রকৃতির সবকিছু মূলত এই ঈশ্বরের বিধানেরই প্রমাণ৷ ডারউইন নিজেই তাঁর আত্মজীবনীতে যেমনটি বলেছেন, “বিগ্লে আরোহন করার পরও আমি খুবই রক্ষণশীল ধরনের ছিলাম ৷ আমার মনে পড়ে- নৈতিকতা বিষয়ে কোন কোন সময়ে আমি যখন বাইবেল থেকে উদ্ধৃত করতাম, তখন জাহাজের বহু অফিসার- যারা নিজেরাও রক্ষণশীল ছিলেন, আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করতেন” ৷ প্রাথমিকভাবে বিগ্লের সমুদ্রযাত্রা ২ বছরের জন্য নির্ধারিত থাকলেও ঘটনাচক্রে তা ৫ বছরে গিয়ে ঠেকে ৷ এই পাঁচ বছরে এমন কিছু ঘটেছিল যা তাঁকে প্রায় যাজক হওয়া থেকে বিজ্ঞানী করে তোলে ৷ কারণ প্রলম্বিত এই সমুদ্রযাত্রার পথিমধ্যে নানান অনুসন্ধান ও গবেষণাই ডারউইনকে সম্পূর্ণ বিপরীত বিশ্বাসে বিশ্বাসী এক মানুষে পরিণত করে তোলে ৷ এই জাহাজে ভ্রমণের সময়ই তিনি জীবনে প্রথমবারের মত পাহাড় ও অন্যান্য ভূ-তাত্ত্বিক বস্তুর বিবর্তনগত পরিবর্তনের চিহ্ণ প্রত্যক্ষ করেন ৷ ডারউইনই প্রথম বিজ্ঞানী যিনি বিখ্যাত গেলাপাগস দ্বীপপুঞ্জ ভ্রমণ করে সেখান থেকে নানা রকমের জীবাশ্ম, ছোট-বড় উদ্ভিদ ও প্রাণির নমুনা সংগ্রহ করেন ৷ এসবের মধ্যে অনেকগুলোই ছিল অবলুপ্ত প্রাণিসমূহের জীবাশ্ম৷ কী কারণে ঐসব প্রাণি পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ণ হয়ে গেছে তা জানতে ডারইউন প্রচণ্ড আগ্রহী হয়ে ওঠেন৷ প্রাণিকূলের মধ্যে বিরাজিত অঙ্গসংস্থানপন এবং অন্তর্গত তন্ত্রসমূহের পার্থক্য তিনি অত্যন্ত মনোযোগসহকারে অধ্যয়ন করেন ৷ গেলাপাগস দ্বীপপুঞ্জ থেকে গবেষণার কাজে তিনি হরেক প্রজাতির প্রচুর ফিংগে পাখিও সংগ্রহ করেছিলেন ৷ বিগ্লে ভ্রমণের সময় ঐ জাহাজের ক্যাপ্টেন রবার্ট ফিজরয়ের দেয়া চার্লস লিয়েল নামক জনৈক ভূ-তত্ত্ববিদের লেখা ‘প্রিন্সিপলস্ অব জিওলজি’ গ্রন্থটি ডারউইরে বিশেষভাবে কাজে লাগে ৷ বিগ্ল জাহাজ ভ্রমণান্তে দেশে ফিরে ডারউইন তাঁর সংগৃহীত নমুনাগুলো নিয়ে নিবিষ্টচিত্তে বছরের পর বছর গবেষণা চালিয়ে যান এবং প্রচুর অধ্যয়ন করেন ৷ যার ফলে তিনি বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ থমাস ম্যালথাসের জনসংখ্যা বৃদ্ধির প্রতিবন্ধকতায় শিকারী ও হিংস্র প্রাণি, দুর্ভিক্ষ এবং মহামামরীর ভূমিকা সম্পর্কিত তত্ত্ব অবগত হয়েছিলেন বিধায় এর দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়ে পড়েন ৷ নিজের গবেষণা এবং ম্যালথাস তত্ত্বের মধ্যে তিনি সাযুজ্য খুঁজে পান ৷ এতে ডারউইন উত্সাহিত এবং ভিতরে ভিতরে দারুণভাবে উত্তেজিত হয়ে অধ্যয়ন এবং গবেষণা কর্ম পূর্ণোদ্দমে চালিয়ে যেতে থাকেন বটে, কিন্তু তাঁর উদ্ভাবিত তত্ত্ব্ব সম্পর্কে তখনোবধি কাউকেই কোন কিছু অবহিত করা থেকে বিরত থাকেন ৷ বিগ্লযাত্রাশেষে অধ্যয়ন এবং স্বগবেষণালব্ধ ফলাফল থেকে ডারউইনের এই উপলব্ধি ঘটে যে, বাইবেলের জেনেসিসে সর্বমোট ছয় দিনে ঈশ্বর কর্তৃক পৃথিবী এবং জীবজগৎ সৃষ্টি হয়েছে বলে যা বর্ণিত রয়েছে তা ভ্রান্ত কাহিনী ৷ তবে বিষয়টি তাঁর জন্য মোটেও স্বস্তিদায়ক ছিল না ৷ কারণ নানাবিধ ৷ প্রথমত, নিজেরই হাতে সংগ্রহ করা চাক্ষুস এবং অনস্বীকার্য প্রমাণপাতি ও তথ্য-উপাত্ত তাঁর সারা জীবনের লালিত বিশ্বাসকে ভেঙ্গে চুরমার করে দিল ৷ দ্বিতীয়ত, তাঁর প্রিয়তমা স্ত্রী এমা ছিলেন গভীরভাবে খ্রিস্টীয় ধর্মে বিশ্বাসী এবং সে মতে তিনি নিয়মিত আচার-আচরণ লালন-পালন করতেন ৷ তাছাড়া, তত্কালীন গোঁড়া রক্ষণশীল ইংল্যান্ডে ডারউইনের গবেষণালব্ধ তত্ত্ব প্রকাশ করা ছিল অনেক ঝুঁকিপূর্ণ কাজ৷ সে যাহোক, এসব মোহভঙ্গের বেদনা কাটাতে তিনি একাত্মবাদের দিকে ঝুঁকে পড়েন ৷ উল্লেখ্য, একাত্মবাদে বিশ্বাসীরা মনে করেন, জগত-প্রকৃতির ঐকতান শুধুমাত্র দৈব ঘটনাচক্রের ফল নয় এবং ঈশ্বর প্রশ্নে তাঁরা প্রচলিত ধর্মগুলোর গোঁড়ামিতাপূর্ণ ব্যাখাদি অগ্রাহ্য করে চলেন ৷ তবে তাতেও ডারউইন ততটা তুষ্ট হতে পারেননি ৷ তাই শেষ পর্যন্ত তিনি তাঁর নিজের উদ্ভাবিত ‘থিওরি অব ন্যাচারাল সিলেকশন’ এর মধ্যেই সৃষ্টি সম্পর্কিত অনেক প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পান ৷ স্বতত্ত্ব ডারউইনকে এমনই এক অভ্যন্তরীণ ক্রিয়া-প্রক্রিয়ার সন্ধান দেয় যা প্রকৃতিগতভাবেই যুগপৎ জগতের সকল সৃষ্টির ভারসাম্য ও শৃংখলা তৈরি এবং সেসব চলমান রাখতে সক্ষম বলে প্রতীয়মান ৷ আর তাই বিবর্তনটি ডারউইন নিজেই প্রথম আত্মস্থ করেন ৷ এ কাজে তিনি ক্রমান্বয়ে ধর্ম এবং ধর্মগ্রন্থে বর্ণিত ঈশ্বরীয় বিশ্বাস থেকে নিজেকে গুটিয়ে ফেলতে থাকেন ৷ এমনকি অপ্রকাশ্যে তিনি বাইবেলে বর্ণিত ঈশ্বরের কঠোর সমালোচকও বনে যেতে থাকেন ৷ এখানে কাকতালীয় একটি বিষয়ের উল্লেখ না করলেই নয় ৷ তা হচ্ছে- পৃথিবীতে এ যাবতকাল মানবসভ্যতার বিকাশ এবং উত্কর্ষ সাধনে যতসব দার্শনিক ও বিজ্ঞানী নব নব আবিষ্কার ও তত্ত্ব উদ্ভাবন করেছেন তাঁদের সবাই এক কাতারের, অর্থাৎ জীবনের এক পর্যায়ে এসে তাঁরা ঈশ্বরে বিশ্বাস হারিয়েছেন ৷ আবার এই বিশ্বাস হারানোর মধ্যে কিছুটা তারতম্যও পরিলক্ষিত হয় ৷ তবে ঈশ্বর প্রশ্নে পরবর্তীকালে ডারউইনের মতামত আর বিশ্বখ্যাত অপর বিজ্ঞানী ও দার্শনিক আলবার্ট আইনস্টাইনের মতামত প্রায় একই ধরনের ৷ দু’জনের কেউই সরাসরি নিজেকে নাস্তিক ঘোষণা দেননি বটে, কিন্তু তাঁরা জীবনের এক পর্যায়ে এসে এমন কোন ঈশ্বর বা ঈশ্বরীয় শক্তির অস্তিত্ব মানতেও রাজি ছিলেন না- যা কিনা সর্বশক্তিমান এবং পরম ও সর্বাধিক দয়ালু; আবার সেই শক্তিই নির্দেশ অমান্যকারী, যেমন- সংশয়ী ও অবিশ্বাসীদেরকে কঠিন, ভয়াবহ এবং নির্মম নরকযন্ত্রণা দিতেও কসুর করে না ৷ আর উভয়েই তথাকথিত কোন আলৌকিকত্বেও বিশ্বাস করতেন না ৷ সে যা-ই হোক, ধর্ম এবং ঈশ্বর বিষয়ে ডারউইনের সমালোচনা কেবলমাত্র যে বাইবেলে বর্ণিত ঈশ্বরেই সীমাবদ্ধ ছিল তা নয়, তিনি মূলত বিবর্তনের আলোকে ধর্ম ও ঈশ্বর বিশ্বাসের ভিত্তি খোঁজার প্রয়াস পেয়েছেন ৷ তাই বাইবেলের ওল্ড টেস্টামেন্টে বর্ণিত খ্রিস্টান ধর্মের ব্যাখা এবং নির্দয় ও নিষ্ঠুর ঈশ্বরে বিশ্বাস সম্পর্কে তিনি মানুষের আদিম সত্তার শেষ চিহ্ণ বলে মন্তব্য করেছেন ৷ তাঁর গবেষণা সন্দর্ভের বর্ণনায় দেখা যায়- জীবের বাঁচার সংগ্রাম, কষ্ট, ক্লেশ, ভোগান্তি ইত্যাদির কারণ, আবার সেসব থেকে মুক্তির উপায় ও অস্তিত্বের ব্যাখ্যায় ‘সর্বদয়ালু ও সর্বশক্তিমান’ কোন এক বিধাতার বদলে নৈতিকতার বিচারে অন্ধ প্রাকৃতিক ক্রিয়াদির সাথেই বেশি সাযুজ্যপূর্ণ ৷ ডারউইন মনে করেন, খোদ ধর্মের ইতিহাসই একটি বিবর্তনশীল প্রক্রিয়া৷ তিনি পর্যবেক্ষণ করে প্রাণিকূলের মধ্যে বেশকিছু সর্বপ্রাণবাদী আচরণের অস্তিত্ব খুঁজে পান ৷ এটিকে তিনি এক প্রকার ধর্মবিশ্বাসের আদিম প্রকাশ বলে অভিমত ব্যক্ত করেন ৷ ডারউইনের বিশ্বাস, ধর্মও নৈতিকতার মতো বিবর্তনের একটি সৃষ্টি৷ তাই শুধু ঐশী বাণীই নয়, ধর্মের বিভিন্ন ধাপ ও বিধি-বিধানেরও পুনর্সন্ধান এবং পুনঃপ্রবর্তন সম্ভব ৷ জার্মানীর একটি পত্রিকার সম্পাদকের লিখিত অনুরোধের ভিত্তিতে ডারউইন আত্মজীবনী লেখা শুরু করেন - যার প্রকাশকাল ৩১ মে ১৮৭৬ ৷ এতে ধর্ম, ঈশ্বর, নৈতিকতা ইত্যাদি বিষয়ে খুব ধীরলয় এবং অপ্রকাশ্যে তাঁর মনোজগতের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটে বলে প্রকাশ পেতে দেখা যায় ৷ ধর্ম ও ঈশ্বর বিষয়ে ডারউইনের বক্তব্যের সারসংক্ষেপ এরূপ- “আমি আমার বিশ্বাস পরিহার করতে খুবই অনিচ্ছুক ছিলাম ৷ কারণ বিশিষ্ট রোমান যাজকদের মধ্যে বিনিময়কৃত পুরানো চিঠিপত্র এবং পম্পেই নগরী থেকে আবিষ্কৃত গোসপেলে লিখিত পাণ্ডুলিপিসমূহ আমার মনে গভীর রেখাপাত করেছিল বলে বিশ্বাস বদলানো কঠিন থেকে কঠিনতর বলে টের পাচ্ছিলাম ৷ তাই আমার গবেষনালব্ধ ধারানার পক্ষাবলম্বনের অবারিত সুযোগ থাকা সত্ত্বেও আমি লক্ষ করলাম এ ব্যাপারে আমাকে রাজি হতে হলে এর স্বপক্ষে প্রমাণ আবিষ্কারের প্রয়োজন ৷ কাজেই ধর্মে অবিশ্বাসের বিষয়টি খুবই ধীর গতিতে আমার মধ্যে প্রোথিত হয়, তবে তা শেষ পর্যন্ত সম্পন্ন হয় ৷ এর গতি এতোটাই শ্লথ ছিল যে, বিশ্বাসের এই পরিবর্তনের জন্য আমি কোন প্রকার মানসিক যন্ত্রণা অনুভব করিনি এবং এমনকি আমার গবেষণার ফলাফল যে সঠিক ছিল সে ব্যাপারে আমার মনে ক্ষণিকের জন্যও কোন সন্দেহের উদ্রেক ঘটেনি” ৷ ডারউইনকে কখনোই ধর্ম বা ঈশ্বর নিয়ে বাক-বিতণ্ডায় জড়াতে দেখা যায়নি ৷ এর কারণ একাধিক বলে ধারণা করা হয়৷ প্রথমত, তাঁর অমূল্য ‘অন দ্য অরিজিন অব স্পীশীজ’ গ্রন্থটি প্রকাশের পূর্বে তিনি কোনভাবেই ইংল্যান্ডের রক্ষণশীল ও গোঁড়া খ্রিস্টান সম্প্রদায়কে চটাতে চাননি ৷ তাছাড়া গভীর ধর্মবিশ্বাসী তাঁর স্ত্রী এবং ধীরলয়ে ধর্মে তাঁর নিজের অবিশ্বাসের বিষয় দু’টি পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে । সে যা-ই হোক, ১৮৫৯ সালের ২৪ নভেম্বর গোটা মানব জাতিকে চমকে দিয়ে ডারউইন তাঁর অমর বিজ্ঞানগ্রন্থ ‘অন দ্য অরিজিন অব স্পীশীজ’ প্রথম জনসমক্ষে প্রকাশ করেন ৷ এর মাধ্যমে তিনি তাঁর সুদীর্ঘ আড়াই দশকেরও অধিককালের অক্লান্ত পরিশ্রম ও নিরবচ্ছিন্ন গবেষণার ফলাফল তুলে ধরেন ৷ এতে তিনি বললেন- “এতদিন আমাদের ইতিহাস সম্পর্কে আমরা যা জেনে এসেছি তা-ই কেবল চরম সত্য নয় ৷ ঈশ্বর নামে কেউ মানুষসহ অন্যান্য প্রাণি ও উদ্ভিদকূলকে হঠাৎ সৃষ্টি করে পৃথিবীতে পাঠাননি, বরং কোটি কোটি বছরের প্রাকৃতিক ও পরিবেশগত পরিবর্তনের মাধ্যমে জীবজগতের এক প্রজাতি থেকে অন্য প্রজাতির উদ্ভব ঘটেছে ৷ তাই তাত্ক্ষণিক বিচারে ভিন্নতা পরিলক্ষিত হলেও, আসলে একই সরল কোষ থেকে সকল প্রজাতির উদ্ভিদ এবং প্রাণির উত্পত্তি হয়েছে” ৷ এতে যা ভাবা গিয়েছিল তাই ঘটল, অর্থাৎ ‘অন দ্য অরিজিন অব স্পীশীজ’ এ বিবর্তনবাদ প্রকাশের পর পরাক্রমশালী চার্চ অব ইংল্যান্ড প্রচণ্ড ক্ষেপে যান৷ তাঁরা এই তত্ত্বকে ‘ভয়ংকর’ এবং ‘ধর্ম্রোহিতা’র শামিল বলে অখ্যায়িত করেন ৷ তাঁরা তত্ত্ব প্রত্যাহারের জন্য ডারউইনের উপর চাপ সৃষ্টি করতে থাকেন ৷ তবে তিনি তা না করে ১৮৬০ সালে ‘অন দ্য অরিজিন অব স্পীশীজ’ এর দ্বিতীয় সংস্কররে শেষের দিকে এক জায়গায় শুধুমাত্র ‘সৃষ্টিকর্তা’ শব্দটি জুড়ে দেন ৷ জীবদ্দশায় এর চেয়ে তাঁকে দিয়ে আর বেশি কিছু করানো সম্ভব হয়নি ৷ কিন্তু ১৮৮২ সালের ১৯ এপ্রিল ডারউইনের মৃত্যুর পর তাঁর ঈশ্বরভীরু স্ত্রী এমা স্বামীর নরকভোগের আশংকায় ভুগতে থাকেন ৷ তাই ডারউইনের আত্মজীবনীর যে অংশে ঈশ্বর কর্তৃক অবিশ্বাসীদের অনাদিকাল ধরে শাস্তিপ্রদানের বিষয়ের প্রতি কঠোর তিরস্কারপূর্ণ বর্ণনা ছিল তা তিনি ছয় মাসের মধ্যে, অর্থাৎ ঐ বছর অক্টোবর মাসে বাদ দিয়ে দেন ৷ যদিও পরবর্তীতে ১৯৫৮ সালে ডারউইনের নাতনি নোরা বারলো তাঁর দাদীমা এমা কর্তৃক ছেটে ফেলা অংশ দাদার আত্মজীবনীতে পুনঃসংযোগের মাধ্যমে এর আদিরূপদান করেন ৷ এই প্রবন্ধের প্রারম্ভে করা ডারউইন নাস্তিক ছিলেন, নাকি আস্তিক- এই প্রশ্নের উত্তর তাঁর আত্মজীবনীতেই খুঁজে পাওয়া যায় ৷ আত্মজীবনীর যে অংশে ঈশ্বর ও ধর্মীয় বিশ্বাস সম্পর্কে তিনি যা বর্ণনা করেছেন সেখান থেকে কিয়দাংশের অনুবাদ এখানে তুলে ধরা হল- “আমি এ ধরনের দুর্বোধ্য সমস্যাসমূহের উপর স্বল্প আলোকপাত করার ভান ধরতে পারি না ৷ সবকিছু শুরুর গুরুরহস্য আমাদের কাছে মীমাংসাতীত এবং এ কারণে আমি অবশ্যই একজন অজ্ঞেয়বাদীর ধারক হিসেবে অবস্থান করব” ৷ পরিশেষে বলা যায়, প্রথমজীবনে ধর্ম ও ঈশ্বর সম্পর্কে ডারউইনের কী বিশ্বাস ছিল বা পরবর্তীতে তিনি নিজেকে নাস্তিক বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন কিনা, তার কোনটিই আদৌ গুরুত্বপূর্ণ কোন বিষয় নয় ৷ মূল ব্যাপারটি হচ্ছে- পরিণত বয়সে এসে এককালের লালিত বিশ্বাসের ঊর্দ্ধে উঠে প্রকৃতি থেকে আহরিত জীব ও জড়বস্তুর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে এবং নিজস্ব বিচার-বুদ্ধি খাটিয়ে গবেষণালব্ধ ফলাফলের উপর পূর্ণ আস্থা জ্ঞাপন এবং সেসব ধীর- স্থির ও নিঃশঙ্কচিত্তে প্রকাশ করেন ৷ কোন বাহ্যিক চাপ বা পারিবারিক বা পারিপার্শ্বিক পরিবেশ সেই আস্থার জায়গা থেকে তাঁকে বিচ্যুত করতে পারেনি৷ এখানেই ডারউইনের শ্রেষ্ঠত্ব এবং অমরত্ব ৷
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।