আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ডারউইনের বিবর্তনবাদ থেকে মনুষ্যত্বের অবমাননাকারী বর্ণবাদী ইউজেনিক্স-গোড়ার কথা

বিবর্তনবাদকে বিজ্ঞানের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখাটাই সমাচীন হত কিন্তু অতিউৎসাহী কিছু নাস্তিকের বিবর্তনবাদের প্রচারের অন্তর্নিহিত কারণটির সাথে ধর্ম সম্পর্কযুক্ত তা তাদের অনেকেই স্বীকার করতে চায় না। তবে কেউ কেউ আছে গায়ের জোরেই যেন বিবর্তনবাদকে প্রতিষ্ঠা করতে চায়। নাস্তিকরা বিবর্তনবাদকে নাস্তিকতার সাথে সমার্থক হিসাবে দেখাতে চাইলেও তাদের কতজন বিবর্তন নিয়ে পড়ে ও বুঝে নাস্তিক হয়েছে তা প্রশ্নবোধক, কিন্তু বিবর্তনবাদই যে নাস্তিকতাকে একটা ভিত্তি দিয়েছে তা বললে হয়তো অত্যুক্তি হবে না। বিবর্তনবাদকে প্রসারে নাস্তিকদের একটা ভুমিকা থাকলেও এর উৎপত্তি (ডারউইনের বিবর্তনবাদ) ও প্রসারের সাথে শুধুমাত্র নাস্তিকতাকে বিবেচনায় নিলে হয়তো ভুল হবে। এলেখায় তাই অনুসন্ধান করার চেষ্টা করা হবে।

প্রকৃতির অজানা রহস্যের ব্যাপারে প্রাচীন অনেক দার্শনিকই ভেবেছেন। যেমনঃ প্লেটোর (৪২৭ বিসি - ৩৪৭ বিসি) মতে মানুষ প্রকৃতির অজানা রহস্যকে ততটুকুই উদ্ভাবন করতে পারে যতটুকু জ্ঞান তাকে দেয়া হয়েছে, যদিও তারই ছাত্র আরিস্টটল (৩৮৪বিসি - ৩২২বিসি) প্লেটোর এই ধারণাকে ভুল বলেই মনে করতেন। প্লেটো ও আরিস্টটল এর বৈজ্ঞনিক পরিচয়ের চেয়ে দার্শনিক পরিচয়টাই মুখ্য। অবশ্য বলা যায় আঠারশ শতকের আগে বিজ্ঞান ও দর্শনের মধ্যে স্পষ্ট কোনো সীমারেখা টানা বেশ কষ্টকর ছিল। বিজ্ঞানীদের অনেকেই একই সাথে দার্শনিকও ছিলেন।

বিজ্ঞান যেখানে পরীক্ষা দ্বারা তত্ত্ব ও ধারণাকে প্রতিষ্ঠিত করে, সেখানে দর্শন সাহায্য করে বৈজ্ঞনিক প্রনালীকে গঠন করতে। এখন অবশ্য বিজ্ঞান ও দর্শনের মধ্যে সম্পর্কটা সে অর্থে নিবিড় না হলেও একেবারে পড়ও নয়। গ্রীকদের পর রোমানরা ও তারো পরে মুসলিম বিজ্ঞানী বিশেষ করে ইবনে সিনা (৯৮০ - ১০), ইবন আল হাইতাম, আল বেরুনী এই বৈজ্ঞনিক প্রনালীকে উন্নত করতে অবদান রাখেন। অন্যদিকে আল বেরুনী বৈজ্ঞনিক পরীক্ষায় 'ভুল (এরর)' এর প্রয়োজনীয়তাকে সর্বপ্রথম সামনে নিয়ে আসেন। তবে ফ্রান্সিস বেকন (১৫২১- ১৬২৬)-ই প্রথম ব্যক্তি যিনি বিজ্ঞান ও দর্শনের মধ্যে মধুচন্দ্রিমায় বাধ সাধেন।

বিখ্যাত বিজ্ঞানী ও দার্শনিক গ্যালিলিও (১৫৬৪-১৬৪২) কিন্তু যুক্তি ও পরীক্ষা দুটোর প্রতিই সমান গুরুত্ব আরোপ করেছেন। দার্শনিক ক্রিস্টিয়ান হিউজেন (১৬২৯ - ১৬৯৫) আবার বিজ্ঞান ও গণিতকে পৃথক ক্ষেত্র বলে মনে করতেন। কারন বিজ্ঞান কেবল একটি ফলাফলকে সত্য কিনা তার সম্ভবনার কথা বলে, যেখানে গণিত ও জ্যামিতি কোনো ফলাফলকে সন্দেহাতীতভাবে সত্য বলে প্রমাণ করে। তবে বৈজ্ঞনিক গবেষণায়ও আজকাল অহরহ গণিতের ব্যবহার হচ্ছে। এটাও ঠিক বিজ্ঞানের সব তত্ত্বের প্রমাণে এই গণিত সার্বজনীনভাবে ব্যবহার করা যায় না।

ডারউইনের বিবর্তনবাদ প্রমাণে এই গণিত কার্যত তেমন ভুমিকা পালন করে না। এটা একটি পর্যবেক্ষণমূলক বিজ্ঞান যাতে ফাঁক ফোঁকড় এর সম্ভবনা বেশী। দার্শণিক হিউজেন বেচে থাকলে হয়ত এই বিবর্তনবাদকে বিজ্ঞানের মধ্যে ফেলতে আপত্তি করতেন। ঊনিশ শতকের বিজ্ঞানীদের মধ্যে কার্ল পপার (১৯০২ - ১৯৯৪) বিখ্যাত হয়ে আছে বিজ্ঞান থেকে মেটাফিজিক্সকে দূরে ঠেলে দিয়ে। তার মতে সামাজিক বিজ্ঞান, নৃবিজ্ঞান এমনকি সাইকোলজী বিজ্ঞানের অন্তর্ভূক্ত নয়।

খুবই অপ্রতুল মাইক্রোইভ্যুলুশন ছাড়া বিবর্তনবাদকে প্রমাণ করতে জীবাষ্ম পরীক্ষার উপর নির্ভর করা ছাড়া উপায় নেই। দেখা যায়, কার্ল পপারের হিসাব অনুযায়ী বিবর্তনবাদ বিজ্ঞানের অন্তর্ভূক্ত হবার কথা নয়! পপার বিখ্যাত হয়ে আছেন, ফলসিফিয়েবল তত্ত্ব দেয়ার জন্য। কোনো তত্ত্ব ফলসিফিয়েবল (falsifiable) না হলে তাও বিজ্ঞানে ঠাঁই পাওয়া উচিত নয়। যাক দার্শনিক ক্রিস্টিয়ান হিউজেনের কথায় আসি। তিনিই প্রথম দার্শনিক যিনি অনুসিদ্ধান্ত ও সেই অনিসিদ্ধান্তকে পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষালব্ধ ফলাফল দ্বারা প্রমাণের ব্যাপারে তার মতামত দেন।

নিউটন আবার অনুসিদ্ধন্ত দেয়াকে বৈজ্ঞনিক বলে মনে করতেন না, এর প্রধান কারণ হতে পারে তার ব্যাকগ্রাউন্ড হল গণিত। এই নিউটনও বিজ্ঞানী ও দার্শনিক দুটোতেই অভিহিত হন, যদিও তার বিজ্ঞানী পরিচয়টার কাছে দার্শনিক পরিচয়টা অনেকটাই ম্লান। অবশ্য হিউজেনের সাথে নিউটনের চিন্তাধারায় এই ব্যাপারে মিল ছিল যে, তারা উভয়েই মনে করতেন, বিজ্ঞান কোনো সুনির্দিষ্ট উত্তর দেবার সামর্থ্য রাখে না। এজন্যই হয়ত নিউটনের ঈশ্বরবিশ্বাস এত প্রবল ছিল। অপরদিকে জন হার্শেল (১৭৯২ - ১৮৭১) অনুসিদ্ধান্তের পক্ষপাতি আর সেই অনুসিদ্ধন্তকে খুব কঠিন ও বারবার পরীক্ষা দ্বারা প্রমাণের পক্ষপাতী।

সে সময়ের ঐসব বিজ্ঞানী ও দার্শনিকদের মধ্যে একটা মিল হল তারা কমবেশী, অতিন্দ্রীয় ক্ষমতায় বিশ্বাস করতেন। তবে ফরাসী বিপ্লবের পরপরই চিত্র পাল্টে যেতে থাকে। এক্ষেত্রে সামাজিক ও পরিবেশগত উপাদান দায়ী। রাজা, চার্চ ও পাদ্রীদের মিলিত অনাচারে ওষ্ঠাগত হয়ে উঠা নাগরিকদের সামনের বিপ্লবের বিকল্প ছিল না। সমাজের উচ্চশ্রেণী, রাজা ও চার্চরা সবধরণের সুযোগ সুবিধা ভোগ করত, সেখানে দরিদ্র জনসাধারণের একটু অন্নেরও নিরাপত্তা ছিল না।

চার্চ ও পাদ্রী এ অনাচারে যুক্ত থাকায় স্বাভাবিকভাবে এই বিপ্লবীরা ধর্মকে বিদায় করতে একটুও কার্পণ্য করেনি, আর তাতে সাধারণ মানুষের সমর্থনও ছিল। ফ্রান্সের এই ঢেউ ইউরোপের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। আর এর ঢেউ থেকে বিজ্ঞানও রক্ষা পায়নি। কিন্তু মজার ব্যাপার হল, ইংল্যান্ডের অভিজাত সমাজই ফরাসী বিপ্লবের ফলে পরিবর্তিত বিজ্ঞানের এই মশালকে বহন করত। আর এই পরিবর্তিত বিজ্ঞানে ডারউইনের বিবর্তনবাদকে ঠাই করে নেয়াতে কোন সমস্যাই হয়নি।

ডারউইনের তত্তের উপর ভিত্তি করে যে সোসাল ডারউইনিজমের প্রসার ঘটে তার শুরুটা ডারউইনবাদ নয় বা ডারউইন নিজেও না। এর বীজ ইউরোপের ভুমিতে প্রসার ঘটে অনেক আগে থেকেই। ইউরোপের এনলাইটেনমেন্ট (১৮শো শতককে ধরা হয়, যদিও মতভেদ আছে) এর সময় থেকেই। ইউরোপীয়ানরা এই ‘এনলাইটেনমেন্টের’ বায়োলজিক্যাল ধারণা দিতে শুরু করেন। এদের মধ্যে বাফন (Buffon), গোবিনিয়া (Gobineau) বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

এই বাফনকে ডারউইনের যোগ্য উত্তরসুরী হিসাবেও আখ্যায়িত করেন অনেকে। বাফন নিজের প্রকৃতিবিদ, গণিতজ্ঞ ও মহাকাশবিজ্ঞানী হিসাবে পরিচিত। তার প্রক্বতির ইতিহাস বেশ কয়েকটি ভাষায় রচিত হয় (Histoire naturelle), যার জন্য বিখ্যাত দার্শনিক রুশো, ভলতেয়ারের বিপরীতে তাকে সেই সময়ের সবচেয়ে পঠিত লেখক বলে স্বীকৃ্তি দেয়া হয়। বাফন’স ল বিখ্যাত হয়ে আছে তার বায়োজিওগ্রাফীর প্রথম সুত্র হিসাবে। এই বাফনকেই ডারউইনের প্রিকারসর বলা হয়।

কারণ জলবায়ুর পরিবর্তনই যে প্রাণীর ব্যাপ্তি ঘটায় সেব্যাপারে তিনি মতামত দেন। ইউরোপের এনলাইটেনমেন্টের বায়োলজিক্যাল যে ধারণা তার গভীরে ছিল বর্ণবাদ। এই বর্ণবাদের সবচেয়ে আধুনিক উপাদান হল ‘বেল কার্ভ’ (Bell Curve)। হার্ভার্ডের মনোবিজ্ঞানী বিচার্ড জ়ে হার্নস্টেইন ও আমেরিকান এন্টারপ্রাইজ ইন্সিটিটিউটের বাষ্ট্রবিজ্ঞানের চার্লস মারে ১৯৯৪ সালে এই বেল কার্ভকে সামনে নিয়ে আসেন। তার মতে বুদ্ধিমত্তা জিন, পরিবেশ, ব্যক্তির আয়-রোজগার, শিক্ষাগত যোগ্যতা ইত্যাদির নির্ভরশীল।

এর দ্ধারা তিনি দেখাতে চেয়েছেন যে সাদা ও কালোদের মধ্যে বুদ্ধিমত্তার পার্থক্য আছে। তার গবেষণালব্দ ফলাফলে দেখিয়েছেন সাদাদের গড় বুদ্ধিমত্তা কালোদের চেয়ে বেশী। সমাজের শ্রেণীবিভাগটাকে দেখিয়েছেন ক্লাস এর উপর ভিত্তি করে যার সবচেয়ে উপরে আছে ‘কগনিটিভ এলিট’ রা যারা সবচেয়ে বেশী সুবিধাভোগী। সাদাদের আধিক্য এই গ্রুপে যেখানে কালো ও ল্যাটিনরা কম আই কিউ থাকার জন্য অবস্থান করে নীচের স্তরে। এমনকি পরিবেশ ও পরিস্থিত তাদের অনুকুলে থাকলেও কালো ও ল্যাটিনদের আই কিউ লেভেলের পরিবর্তন হয়নি।

এই আই কিউ টেস্ট এর উদ্ভাবনে ধারণা দানকারী ব্যাক্তিটি হলে্ন ডারউইনের চাচাতো ভাই স্যার ফ্রান্সিস গাল্টন। গাল্টনই ডারউইনের দ্ধারা প্রভাবিত হয়ে চরম বর্ণবাদী ‘ইউজেনিক্স’ এর স্থপতি। তিনি মনে করতেন উচ্চবংশ ও নীচুবংশের মধ্যে পার্থক্যনির্ণয়কারী কোন হিসাব পদ্ধতি থাকা উচিত যা পরে ‘সাইকোমেট্ররী’ নামে পরিচিতি পায়। ডারউইন পরিবার ইংল্যান্ডের উচ্চবংশীয় সমাজের হওয়ায় তার প্রতিনিধিত্বকারীও বটে। গাল্টন এর মতে উচ্চবংশীয় সাদারা অন্যান্য মানুষদের চেয়ে উন্নত।

এরপর ফরাসী মনোবিজ্ঞানী আলফ্রেড বিনেট ও সিমন, ইংলিশ মনোবিজ্ঞানী চা্র্লস স্পিয়ারম্যান বুদ্ধিমত্তা হিসাবের পদ্ধতি বাৎলে গেছেন। ১৯১০ সালের দিকে যুক্তরাষ্ট্রের ইউজেনিক্স আন্দোলন বিনেট-সিমন এর বুদ্ধিমত্তা পরিমাপকে গ্রহণও করে। পরবর্তীতে আমেরিকান মনোবিজ্ঞানী লুইস টারমান এই বিনেট-সিমন এর পরিমাপকে মার্জন করেন ও জার্মান মনোবিজ্ঞানী উইলিয়াম স্টার্ণ এর ‘(intelligence quotient) ইন্টিলিজেন্ট কোটেন্ট (IQ)’ কে চালু করেন। এই টার্মানও মনে করতেন ইউরোপের উত্তরের সাদা মানুষেরা অন্যান্য মানুষের চেয়ে উন্নত। তথ্যসুত্রঃ ১।

Click This Link ২। Click This Link ৩। http://www.indiana.edu/~intell/bellcurve.shtml নোট: মূল লেখাটি সদালাপে ইতপূর্বে প্রকাশিত হয়েছিল। ওখানে 'শামস' নামে লিখি। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.