আগের পর্বঃ ডারউইনের বিবর্তনবাদ থেকে মনুষ্যত্বের অবমাননাকারী বর্ণবাদী ইউজেনিক্স- গোড়ার কথা
ডারউইনের বিবর্তনবাদের সামাজিক প্রয়োগ যা ইউজেনিক্স (Eugenics) নামে পরিচিত তা নেয়া হয়েছে গ্রীক ভাষা থেকে, 'eu' মানে হল ভাল আর 'gen' মানে হল জন্ম। পুরো শব্দটার অর্থ দাঁড়ায় 'ভাল জন্ম'। একে 'বিশুদ্ধ জন্ম' বললেই বেশী মানায়। বিশ্বখ্যাত বৈজ্ঞনিক জার্নাল 'Nature*'-এ ইউজেনিক্সকে বলা হয়েছে জীনতত্ত্বের প্রয়োগ ঘটিয়ে উন্নত প্রজাতির মানুষ সৃষ্টি করা, "Eugenics was the effort to apply the principles of genetics and agricultural breeding towards improving the human race." এই মতবাদ অনুসারে উন্নত বুদ্ধিমত্তা ও ক্ষমতা হল বিশেষ গুণ যা বংশপরম্পরায় বাহিত হতে পারে। ইউজেনিক্স 'ইউজেনিক্স বিজ্ঞান' নামেও পরিচিত- বিশেষত বিজ্ঞানীদের এর প্রতি আনুগত্য ও এতে অবদান রাখার জন্য।
এটা হল বৈজ্ঞনিক উপায়ে ডারউইনবাদের সামাজিক প্রয়োগ। এই অতি উচ্চাকাংঙ্খী মতবাদটির প্রসার ঘটেছিল বিজ্ঞানের দ্বারাই। গবেষণার নিমিত্তে ইউজেনিক্সরা Annals of Eugenics নামে বৈজ্ঞনিক গবেষণাপত্রও প্রকাশ করে এবং ১৯০০-১৯৪৪ সালের মধ্যে ২৬২টা গবেষণাপত্র প্রকাশও হয়। উদ্দেশ্য হল সামাজিক নিয়ন্ত্রণ আর এ নিয়ন্ত্রণ হল অমানবিক উপায়ে দুর্বল, অসহায়, মানসিকভাবে বিকলাঙ্গদের হত্যা ও শুদ্ধীকরণের মাধ্যমে। ইউজেনিক্স মতবাদের সমর্থকরা এভাবেই বিশুদ্ধতা রক্ষা করতে চেয়েছিল, যেখানে কেবল উন্নত ও সুস্হ লোকগুলোই বেঁচে থাকাবে।
ভবিষ্যতেও যে বংশধররা আসবে তারাও হবে উন্নত ও সুস্হ। ডারউইনের কাজিন গাল্টন এই ইউজেনিক্স এর প্রতিষ্ঠাতা। তিনি ডারউইনের মতই বৃটেনের উচ্চবংশের (ভিক্টোরিয়ান) প্রতিনিধিত্বকারী। আর ডারউইনের পারিবারিক বন্ধু টি.এম. হাক্সলে বিশ্ববিদ্যালয় ও বৈজ্ঞনিক পরিমণ্ডলে এর প্রসার ঘটাতে সাহায্য করেন। কিন্তু একে বাড়াবাড়ির চরম পর্যায়ে নিয়ে যান হিটলার।
Hitler: A Study in Tyranny বইতে জন বুল্লক হিটলারের রাজনৈতিক বিশ্বাসকে দেখেছেন অপরিণত ডারউইনবাদ হিসাবে। তবে এই আন্দোলন শুধু হিটলারের জার্মানীতেই সীমাবদ্ধ ছিল না, ছড়িয়ে পড়েছিল বিশ্বের অন্যান্য দেশেও বিশেষত সাদা অধ্যুষিত দেশগুলোত।
ইউজেনিক্সের প্রচার ও প্রসারে যারা সবচেয়ে অগ্রগামী ভূমিকা নিয়েছিল তারা পাশ্চ্যাত্যের। ইউজেনিক্সের সমর্থকদের মতে, জাতীয়তার বিচারে বিশুদ্ধ জন্মের দিক থেকে এগিয়ে পাশ্চাত্যের সাদারা আর সবচেয়ে নীচের স্তরে 'কালো' ও অন্যান্য জাতিগোষ্টীগুলো। বিবর্তনবাদী জীববিজ্ঞানী জে.বি.এস. হালদেন যিনি নিজে ছিলেন একজন মার্কসবাদী, গভীরভাবে বিশ্বাস করতেন মানুষ জন্মগতভাবে অসম এবং তিনি অমানবিক বর্ণবাদী ইউজেনিক্স এর সমর্থক।
তিনি ডারউইনের প্রাকৃতিক নির্বাচন এর গাণিতিক তত্ত্ব দেন এবং এর প্রসারে ব্যাপক ভূমিকা রাখেন। পপুলেশন জেনেটিক্স এর প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে তিনিও একজন। তিনি ১৯৫২ সালে মর্যাদাশীল রয়্যাল সোসাইটি থেকে পান ডারউইন পদক, ১৯৫৬ সালে পান হাক্সলে মেমোরিয়াল পদক। রাজনৈতিকভাবে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের সাথে সরাসরি জড়িত ছিলেন এবং সমাজতান্ত্রিক পত্রিকা 'ডেইলি ওয়ার্কার' এ নিয়মিত লেখক এবং আপাদমস্তক স্ট্যালিনের এক অন্ধ সমর্থক। অনেক সমাজতান্ত্রিকদের মত তিনি ইউজেনিক্সকে সমর্থন করতেন বৈজ্ঞনিক আগ্রহের জন্য।
"Darwin on Slavery" নভেম্বর ১৪, ১৯৪৯ তে তিনি এর ব্যাপারে কিছু ধারণা দিয়েছেন। তার মতে: "I think the world would be a much duller place if there were no differences in innate powers between the different individuals and group of individuals….Races do not differ like individuals. But I think it highly likely that they differ in the proportions of highly-gifted peoples." শুধু যে হালদেন তাই নয়, অনেক নামীদামী রথী-মহারথী ও বিজ্ঞানীরা বর্ণবাদী ও অমানবিক ইউজেনিক্স এর সমর্থনে এগিয়ে আসেন- বেট্রিক্স, সিডনি ওয়েব, জর্জ বার্নার্ড শ', হ্যাভলক এল্লিয়াস, ইডেন, সিডার পল, এইচ.জে.লাস্কি, গ্রাহাম ওয়াল্লাস, ইমা গোল্ডম্যান, এইচ.জি.ওয়েলস, এডওয়ার্ড এভেলিং, জুলিয়ান হাক্সলি, জোসেফ নিডহাম, সি.পি.স্নো, এইচ.জি.মুলার, পল কামেরার ও আরো অনেকে। জার্মানীর মত আমেরিকাতে ইউজেনিক্স খুব বেশী শিকড় না গাড়তে পারার কারণ হল: ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান বিশেষ করে রোমান ক্যাথলিকদের থেকে প্রতিবাদ আর তুলনামূলকভাবে স্বাধীন বিচার বিভাগ। অবাক করা ব্যাপার হল, যে চার্চ এর অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে এবং এর অমানবিকতা রুখতে ফরাসী বিপ্লবের পর পাশ্চাত্যবাসীরা চার্চকে রাষ্ট্র থেকে পৃথক করেছিল সেই চার্চ থেকেই ইউজেনিক্সে এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আসে সবচেয়ে জোড়ালোভাবে। শুধু আমেরিকাতেই নয় জার্মানীতেও চার্চ এই ইউজেনিক্সের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড প্রতিবাদে সরব হয়।
সংঘর্ষ এড়াতে, নাজীরা দুর্বল নাগরিকদের ইচ্ছা বা অনিচ্ছায় যে পরিশুদ্ধকরণ প্রকল্প নেয় তা থেকে রোমান ক্যাথলিকদের অব্যাহতি দেয় [১]। আমেরিকাতে এতসব বাধা সত্ত্বেও সমাজের উঁচুস্তরের লোক, শিক্ষিত ও বৈজ্ঞনিকদের সমর্থন নিয়ে ১৯৪৩ থেকে ১৯৬৩ সাল পর্যন্ত ২৭টি রাজ্যের ২৭০০০ লোককে পরিশুদ্ধিকরণ করা হয় [২]। উল্লেখ্য তাদের অধিকাংশই আবার আফ্রিকান বংশোদ্ভুত কালো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যেখানে জার্মানীতে পরিশুদ্ধকরণের নামে নির্মম হত্যা কমে যায়, সেখানে আমেরিকাতে বেশীর ভাগ লোককে ভুগতে হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যা চলে ১৯৬৩ সাল পর্যন্ত। সাথে সাথে নিম্নস্তরের জাতি হিসাবে যাদের বিবেচনা করা হত তাদের দেশে ঢুকার ব্যাপারে সাবধানতা অবলম্বন করা হত।
অপরদিকে চার্চের প্রতিবাদ সত্ত্বেও ১৯৩৯ থেকে ১৯৪১ পর্যন্ত আনুমানিক ৭০ হাজার লোককে মৃত্যুবরণ করতে হয় [৩]।
এই নির্মম হত্যাকান্ডে অংশীদারীত্ব ছিল বিশিষ্ট জীনবিজ্ঞানী, ডাক্তার, জীববিজ্ঞানীর। শুধু অংশীদারীত্ব বললে হয়ত ভুল হবে, প্রত্যক্ষ সমর্থনের বাইরেও এই মতবাদ প্রচারে তাদের ছিল বিশেষ ভূকা। এই ইউজেনিক্স যা একসময় বিজ্ঞান মহলে বিশেষ করে জার্মানীতে ছিল ব্যাপক জনপ্রিয়। কালের কী পরিহাস এখন তাকে অপ-বিজ্ঞান হিসাবে পাশ কাটানোর প্রবণতা দেখা যায়।
পল ও স্পেন্সার [৪] দেখিয়েছেন যে অধিকাংশ জীনবিজ্ঞানী এই ইউজেনিক্সকে সমর্থন করতেন যা 'Nature' নামক বিখ্যাত জার্নাল-এ প্রকাশিত হয়। (চলবে…)
সূত্রঃ
১.Popenoe p. The German Sterilization law
২.Robitscher j. Eugenic Sterilization Springfield
৩.Lifton RJ, The Nazi Doctors: Medical Killing and the Psychology of Genocide
৪.Paul DB, Spencer HG, The hidden science of Eugenics
*http://www.nature.com/nrg/journal/v1/n2/full/nrg1100_153a.html
পাদটীকা: লেখাটি ইতিপূর্বে সদালাপে প্রকাশিত হয়েছিল। সদালাপে আমি শামস নামে লিখি। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।