পৃথিবীর কোনো দেশই উৎপাদনের ক্ষেত্রে স্বয়ংসম্পূর্ণ না। এই স্বয়ংসম্পূর্ণ না হওয়ার কারণেই আমদানি রপ্তানি নামক বাণিজ্যিক প্রক্রিয়াটি চলে আসছে আদিকাল থেকে। আদিকালে পণ্যের বিনিময়ে পণ্য দেয়া হত। এখন অর্থের বিনিময়ে পণ্য দেয়া হয়। মহাপ্রলয়ের আগ পর্যন্ত এই প্রক্রিয়া ব্যাহত হবে বলে মনে হয় না।
কিন্তু আধুনিক যুগে পণ্যের পাশাপাশি দিবসও আমদানি রপ্তানি হয়। কিছু হয় প্রয়োজনের তাগিদে আর কিছু ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে। প্রয়োজনের তাগিদে যেসব দিবস সেগুলোর ক্ষেত্রে আমদানি রপ্তানি না বলে বরং আদান প্রদান বলাই ভাল। সেক্ষেত্রে বেনিয়াসুলভ মনোভাব দিবসের তাৎপর্যকে ছাড়িয়ে যায় না। এসবের মধ্যে আছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, শ্রমিক দিবস ইত্যাদি।
এসবের নির্দিষ্ট তাৎপর্য আছে। মানুষ যখন কোনো একটি বিষয়ের গুরুত্ব উপলব্ধি করতে না পারে বা যদি ঐ বিষয়ের তাৎপর্য মানুষের সামনে নতুন করে উপস্থাপন করার প্রয়োজন হয় সেক্ষেত্রে নতুন দিবসের সৃষ্টি হয়। প্রয়োজনমাফিক তা বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়ে। মাতৃভাষা দিবস আগে ছিল শুধু আমাদের নিজস্ব দিবস। কিন্তু এখন
তা বিশ্বময় পালিত হচ্ছে পৃথিবীর সব ভাষাকে রক্ষার উদ্দেশ্যে।
যে দিনটি ছিল শুধু বাংলাকে রক্ষার প্রতীক সেটি এখন সব ভাষার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কারণ আজকের পৃথিবীতেও এক ভাষার দাপটে অন্য ভাষা হারিয়ে যাচ্ছে এমন নজির আছে। তাই এই দিবসের তাৎপর্য অস্বীকার করার উপায় নেই। তদ্রূপ শ্রমিক দিবস এবং অন্যান্য আরো অনেক।
আর কিছু দিবস আছে যার প্রচলন শুধু ব্যবসায়িক স্বার্থ ছাড়া আর কিছু না।
ভ্যালেন্টাইন'স ডে তার ভেতর একটি। আমাদের দেশের নিজস্ব যেসব দিবস আছে যেমন স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, পহেলা বৈশাখ এসবের সাথে এই দিবসের পার্থক্য আকাশ পাতাল। আমাদের দিবসগুলো আমাদেরকে দেশের প্রতি, নিজস্ব ঐতিহ্যের প্রতি সচেতন হতে শেখায়। শেখায় কি করে স্বাধীনতা, স্বকীয়তা ধরে রাখতে হয়। এগুলোর উদ্দেশ্য মহৎ।
উল্টো দিকে ভালবাসা দিবস যা মূলত তরুণদের ভেতরেই বেশী দেখা যায় এই ধরনের মহৎ কোনো শিক্ষা বয়ে আনতে পারে কি? না। বরং আমাদেরকে পশ্চিমা ভোগবাদী সংস্কৃতির দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার অপচেষ্টা চলে। "পশ্চিমারা করে তাই আমাদেরও করতে হবে" এই মানসিকতার লোকের অভাব নেই সমাজে। এভাবে চললে ধীরে ধীরে দেশীয় সংস্কৃতি প্রতিস্থাপন হয়ে যাবে পশ্চিমা ভোগবাদী মানসিকতার দ্বারা। এসব দিবসের কি আদৌ কোনো প্রয়োজন আছে? আমাদের জাতীয় স্বার্থের সাথে এসবের সম্পর্ক কতটুকু তা ভেবে দেখার প্রয়োজন।
ভালবাসা দিবসের উদ্দেশ্য যদি হয় ভালবাসার প্রসার তবে ভালবাসা তো আমাদের সমাজে তথা প্রাচ্য সমাজে এমনিতেই বিদ্যমান। আপনজনদের প্রতি আমাদের ভালবাসা কোনো দিবসকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয় না। তাই দিবসকে কেন্দ্র করে ভালবাসার গুরুত্ব বাড়ানোর চেষ্টা সময় নষ্ট ছাড়া আর কিছু না।
যদিও মাঝে মাঝে "সবার জন্য ভালবাসা'' কথাটা শোনা যায় এবং এই সবাই দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করা হয় সমাজের সকলকেই তবে এই দিবসটি মূলত প্রেমিক প্রেমিকার ভালবাসার প্রতিই ইঙ্গিত করে সে বিষয়ে সন্দেহ পোষণ করার উপায় নেই। এই মুহূর্তে তথাকথিত প্রেমিক প্রেমিকার সম্পর্ক ধর্মীয় বা সামাজিক দৃষ্টিতে বৈধ নাকি অবৈধ, এই সম্পর্কে সুবিধা নাকি অসুবিধা বেশী সে দিকে নাই গেলাম আলোচনার মোড় যাতে না ঘোরে সেজন্য।
ভালবাসা দিবস উপলক্ষে দেখবেন পত্রিকায় নিবন্ধ আসে বা বিভিন্ন স্থানে একেকটা অফার দেয়া হয়, কার্ড, ফুল এসবের বিক্রিও হয় প্রচুর। আর এসবের সাথে যে সরাসরি ব্যবসা জড়িত সে বিষয়টি তো বোঝাই যায়। তাহলে কি বলা যায় না যে এই দিবস শুধু কিছু
মুনাফালোভী ব্যবসায়ীর লাভ ছাড়া আর কিছুই হচ্ছে না? অনেকে হয়তো এই উদাহরণের সাথে ঈদ, পূজা, বড়দিন বা আমাদের দেশীয় উৎসব যেমন পহেলা বৈশাখ এসবের তুলনা করবেন কারণ এসবের সাথে কিছুটা ব্যবসা জড়িত। কেউ কেউ হয়তো ঈদ ও বড়দিনকেও বিদেশী বলে তাড়িয়ে দেবেন কারণ এই দুটির উৎপত্তি আমাদের দেশে না। এক্ষেত্রে কিছু কথা বলতে চাই।
এসব ধর্মীয় উৎসবগুলো যা বিভিন্ন ধর্মকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠে তার পেছনে একটি শিক্ষা থাকে মানুষের জন্য। এসবের সাথে ব্যবসা জড়িত হলেও এসবের উৎপত্তির উদ্দেশ্য ব্যবসা ছিল না। এখনও ব্যবসা এই ধর্মীয় তাৎপর্যকে ছাড়িয়ে যায়নি। ব্যবসায়ীদের বিক্রি এসব উৎসবে বাড়ে কিন্তু এসবে ধর্মীয় তাৎপর্যটাই প্রধান থাকে।
যাইহোক, এই ভালবাসা দিবসে আগে যেমন বলা হয়েছে তেমন সবার জন্য ভালবাসার কথা প্রচার করা হলেও যেহেতু এখানে প্রেমিক প্রেমিকার বিষয়টিই মুখ্য এবং একে নিয়ে যেহেতু বিক্রি হয় ভাল এর প্রচার প্রসার মুনাফাখোর বুর্জোয়া সমাজ চাইবেই।
তাছাড়া এভাবে একটি ব্যক্তিগত সম্পর্কে একটি দিবসের মোড়কে প্রকাশে নিয়ে আসাটাও যুক্তিসংগত না। এতে সম্পর্ক হয়ে পড়বে কেনাবেচা তথা পণ্য নির্ভর এবং সম্পর্কের মূল চেতনাটাই হারিয়ে যাবে একথা বললে অত্যুক্তি হবে না। এই দিবস আমাদের তরুণ সমাজের ভেতর প্রেমের সম্পর্ক নিয়ে কিছু উম্মাদনার সৃষ্টি করে। অনেক ছেলেকে দেখি এই দিন প্রেমিকা নিয়ে ঘুরতে বের হওয়াকে নিজের স্ট্যাটাস মনে করে, যারা প্রেম করে না তাদের ভাব ভঙ্গি দুর্ভিক্ষে ভুভুক্ষ মানুষের মত, যেন একটি মেয়ে পেলেই বর্তে যায় অবস্থা, যারা প্রেমিকা বা প্রেমিক থাকার পরও ঘুরতে পারে না তারা শুরু করা হাহুতাশ যেন প্রেম শেষ। এককথায় দিবসটিই যেন সব, মিস হলে সর্বনাশ এই হল এদের মনোভাব।
বন্ধুমহলের ভেতর চলে নানারকম ঠাট্টা যার কিছু কিছু অশ্লীল না হলেও অনৈতিক। এসব কথা সত্য নাকি মিথ্যা এবং তরুণদের কয়জন প্রকৃত প্রেম করে আর প্রেমের নামে সম্পর্ক করে তা তরুণ সমাজের একজন হয়ে আমি ব্যক্তিগতভাবে খুব ভালই অবগত।
সমস্যা এখানেই শেষ না। যেহেতু এই দিবস পাশ্চাত্য থেকে আমদানি করা তাই এর উদযাপনের কৌশলও পাশ্চাত্য থেকেই ধার করা। এবং এর উদাহরণ হল পূর্বে উল্লেখ করা বিক্রি সংস্কৃতি।
পাশ্চাত্য চাইবেই আমাদেরকে তাদের অধীনস্ত করে রাখতে আর তা অতীত যুগের মত সৈন্য সামন্ত নিয়ে দেশ দখল করা সম্ভব না। তাই আজকের যুগে তারা একই কাজ করছে এসব তাৎপর্যহীন পণ্য নির্ভর উৎসবের আড়ালে। আজকের যুগে সামরিক দাসত্বের চেয়ে সাংস্কৃতিক দাসত্বের কার্যকারিতা অনেক বেশী। তাই এসব থেকে কোটি কিলোমিটার দূরে থাকা উচিত। নাহয় আমরা স্বাধীন থাকব শুধু কাগজে কলমে।
মানসিকভাবে হব পাশ্চাত্যের দাস।
তাহলে প্রশ্ন হল, "পাশ্চাত্য মানেই কি পরিত্যাজ্য?" উত্তর হল, "না। " পাশ্চাত্যের সমৃদ্ধি কম না একথা অনস্বীকার্য। গ্রহণ করার মত একটি বিষয় হল সাহিত্য। বিস্তারিত আলোচনায় এই মুহূর্তে নাই বা গেলাম।
তবে যত কিছুই বলা হোক না কেন, দেশীয় মূল্যবোধ সংস্কৃতির দোহাই যতই তোলা হোক না কেন,একথা নিশ্চিত এরপরও, তাদের অর্থাৎ পাশ্চাত্যের বিভিন্ন পণ্য এসব উৎসবের অজুহাতে আমাদের দেশে আসবে, আমরা তা সানন্দে কিনব, হ্যাঁ, আমরা কিনব, যদিও আমরা দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে অতীষ্ট হই, তবুও আমরা এসব উৎসবে পাশ্চাত্যের অর্থনৈতিক টোপ গিলব, আমরা এসব দিবস উপলক্ষে লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করব যদিও ঐ সময় আমাদের লক্ষ লক্ষ ভাইবোন ক্ষুধা, দারিদ্র, অশিক্ষা, মহামারী এসবের সাথে লড়াই করছে শুধু একটি দিন বেশী বাঁচার জন্য, এসব দিবসে আমরা পাশ্চাত্য ভঙ্গিতে টাকা উড়াব এবং দুদিন পর আবার দেশপ্রেমের জিগির তুলব এবং ভুলে যাব ভাষার জন্য, নিজস্ব সংস্কৃতির জন্য '৫২ সালে রাস্তায় গুলি খেয়ে মানুষকে মরতে হয়েছিল। সেই সাথে মনের ভেতর উচ্চস্বরে বলব "যাহা পাশ্চাত্য তাহাই সত্য, জয়, পাশ্চাত্যের জয়। " অবশ্যই মনে মনে বলব, ভয় হয়, পাছে স্বদেশী চেতনা শুনতে পাবে। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।