আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

নৈঃশব্দ আর নিঃসঙ্গতা

ছোটবেলা থেকেই ঘুরে বেড়াতে খুব পছন্দ করি। একটু বড় হয়ে এর সাথে যুক্ত হ’লো পড়া ও লেখালেখি, তারপর ফোটগ্রাফি। মধ্যদুপুর। ঝম ঝম বৃষ্টি পড়ছে। জানালার কাঁচে বৃষ্টির ছাঁটের আওয়াজ শুনে মনে হচ্ছে যেন কোন হিংস্র জন্তু নখ দিয়ে ক্রমাগত আচঁড়াচ্ছে কাঁচ; ভেঙে ভেতরে ঢুকতে চাইছে।

কিছক্ষণ পরপর থেমে যাচ্ছে ছাঁটের প্রকোপ, তখন মনে হয় ক্লান্ত জন্তুটা জিরিয়ে নিচ্ছে। একটু পর আবার শুরু হচ্ছে আঁচড়ানো। বিকেলে বৃষ্টি ধরে এলেও আকাশটা বড্ড ভারী আর কালো হয়ে আছে; এই কালো আকাশই অনেকখানি বিকেল খেয়ে ফেলেছে আজ। রাস্তায় বেরিয়ে ঠিক করতে পারলাম না কোথায় যাবো! শুধু মনে হতে লাগলো আজ এই সন্ধ্যেবেলা আমার জীবনে কিছু একটা ঘটবে। কলোনীর পাশ কাটার সময় দু’টি মেয়েকে দেখলাম চটপটে ভাব নিয়ে রাস্তা পেরিয়ে যেতে।

বর্ষাকালীন মসৃন মাধূর্য লেগে আছে তাদের মুখে, সেই রুপের ঝাপটা এসে আমার গায়ে লাগলো। আমি মনে মনে বললাম, মন তুমি উতলা হয়ো না। ওরা আমার কেউ নয়। ওরা আমাকে কোনদিন চিনবে না। ঠিক এই সময় চোখে পড়লো ধূসর রঙের পাজারো জিপটি।

একেবাড়ে ঝকঝকে নতুন। কলোনীর শেষ প্রান্তে বিশাল বাড়িটির সামনে দাঁড়িয়ে আছে। এবার বাড়ির সিংহ-দরজা খুলে যে মেয়েটি বেরিয়ে এলো তার হাঁটা, ফিগার দেখে বুকের মধ্যে ড্রাম বাজতে লাগলো। একটা মোটা বই হাতে নিয়ে মেয়েটি গাড়িতে উঠে বসতেই সেটা মসৃন গতিতে এগিয়ে গেল। কিন্তু আমার মনে হলো গাড়িতে ওঠার মুর্হুতে মেয়েটির বই থেকে কিছু একটা পড়ে গেল।

নিশ্চিত হতে এগিয়ে গেলাম। বৃষ্টির জল জমে আছে এখানে সেখানে। তারই এককোনায় উল্টে পড়ে আছে কাগজটি। হাতে নিতেই দেখলাম ব্রিটিশ কাউন্সিলের লাইব্রেরি কার্ড। প্রতিমা চক্রবর্ত্তী।

ঠিকানাটাও এই বাড়ীর। কার্ডের একপাশে মেয়েটির ছবি। অর্পূব। এইরকম একটি মুখ কি দিয়ে ঈশ্বর সৃষ্টি করেছেন! ছবিটার দিকে তাকিযে থাকতে থাকতে হঠাৎ নীরক্ত মনে হলো নিজেকে। কবিতার একটি লাইনই বারবার মনে হতে লাগলো - ’এমন একটি মুখের জন্য তিন জন্ম হেঁটে আসা যায়”।

কিন্তু যার ছবি সে তো চলে গেছে অনেÿণ। এখন কার্ডটা নিয়ে কী করবো? মাটিতে ফেলে যেতেও মন চাইছে না। বাড়িটার দরজা বন্ধ হয়ে গেছে। আমি এই এলাকায় নতুন। তাই জানিনা বাড়িটা কার।

কাছে গিয়ে ভালো করে তাকাতেই নেমপ্লেটের গাম্ভির্য আমাকে সন্ত্রস্ত করে তুলল। একজন রিটার্য়াড পুলিশ কর্মকর্তা থাকেন ও বাড়িতে। পরক্ষনেই মনে হলো, পুলিশ তো আমার কি? আমি কার্ড কুড়িয়ে পেয়েছি তাই ফেরত দিতে বেল বাজিয়েছি। ব্যাস। আর একটি কাজ অবশ্য করা যায়।

ডাকযোগে পাঠিয়ে দেওয়া যায়। কিন্তু ডাকবিভাগ যদি ঠিকমতো ডেলিভারি না দেয়! অথচ কার্ড হারিয়ে ফেলায় মেয়েটির অর্থ্যাৎ প্রতিমার কতই না অসুবিধা হবে। এইসব ভাবনার পাকে যখন পাক খাচ্ছি তখনই তখনই পাড়ারোটি ফিরে এলো, মেয়েটি আমার দশ হাত দূরে নেমে এলো গাড়ি থেকে। বিরক্ত মুখে বাড়ির দরজার দিকে যেতে যেতে অন্যমনস্ক আমার দিকে তাকাতেই দাঁড়িয়ে পড়লো । চোখে বিস্ময় ফুটে উঠল।

তারপর এগিয়ে এসে জিঙ্ঘেস করলো-কিছু মনে করবেন না, ওটা কি আমার কার্ড। ততক্ষনে আমার জিভগলা শুকিয়ে কাঠ, বুকের মধ্যে লাবুডপ লাবুডপ শব্দটাও বুঝি থেমে গেল কয়েক মুহুর্তের জন্য। কোনমতে শুধু মাথা নাচালাম। প্রতিমা বললো - এখানে পড়ে গিয়েছিল না? আমি এমন কেয়ারলেস! কী বলে যে আপনাকে ধন্যবাদ দেবো! হাত বাড়ালো সে। তাড়াতাড়ি কার্ডের কাদায় ডোবা অংশটি শার্টের আস্তিনে মুছে এগিয়ে দিতেই হা হা করে উঠল সে, - আরে কি করছেন, কি করছেন ! শার্টটা তো নোংরা হয়ে গেলো! হেসে বললাম - কিছু হবে না।

এবার সে মনোযোগী হলো, পূর্নদৃষ্টিতে তাকালো আমার দিকে। এ ছিল আমাদের পরিচয় কাহিনী। তারপর গড়িয়েছে দিন ভালোবাসার দিকে। অনেকগুলো দিন উড়ে বেড়িয়েছে মিষ্টি রৌদ্দুর ডানা মেলে। জীবনে সত্যিকার ভাবে এই প্রথম কাউকে ভালোবেসেছিলাম আমি।

সে আমার ভালোবাসাকে খুব সহজে নিয়েছিল। অথচ ভালোবাসা যে কোন লিপ্ততা নয়, কোন বিলাসিতা নয়; ভালোবাসা যে একটা ভীষন প্রয়োজন তা তাকে বোঝাতে পারিনি আমি। চুড়ান্ত পরিনয়ের বিষয়ে আমার দারিদ্রতা কাল হলো, প্রবাসী পাত্রের হাত ধরে একদিন সে আমার কাছ থেকে হারিয়ে গেলো। দূরে সরে গিয়ে চিরদিনের মতো আমাকে ভুলে গেলো। আর আমি লোকচক্ষু থেকে পালিয়ে পালিয়ে বেড়াতে লাগলাম।

কেউ যেন আমার বুকের ভেতরটা দেখতে না পায় সহজেই, সে সব ভুলে যাওয়ার দুঃখ, দ্বিধা-দ্বন্দ্ব আর একাকিত্ব। এখনও মাঝে মাঝে ভীষন খারাপ লাগে। এই যে বাকী জীবনটা আমার বুকভাঙা কষ্ট নিয়ে, নিদারুন বিষাদগ্রস্থতা নিয়ে ক্রমাগত তাকে ভাববে, তার জন্যই অনন্ত প্রতীক্ষয় থাকবে, অথচ আমার এই ব্যক্তিগত হাহাকারের কথা সে কোনদিন জানবে না। আমার দশদিগন্ত জুড়ে আজ শুধু নৈঃশব্দ আর নিঃসঙ্গতা। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।