আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গাজীপুরের মান্নানের আমলনামা

নির্বাচনী প্রচারের শেষদিকে এসে ব্যাপক ইমেজ সংকটে পড়েছেন গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ১৮ দল সমর্থিত প্রার্থী অধ্যাপক এম এ মান্নান। নির্বাচনী প্রচার যখন তুঙ্গে তখন অতীতের বেশকিছু কুকর্ম নিয়ে বেশ বিপাকে পড়েছেন তিনি। আর তার অতীতের বিতর্কিত কর্মকাণ্ডগুলো বিশেষ করে অতীতে ধর্ম প্রতিমন্ত্রী থাকাকালীন বিভিন্ন দুর্নীতি, স্থানীয় কলেজ থেকে অনিয়ম ও অসদাচরণের অভিযোগে বরখাস্তের ঘটনা ভোটারদের সামনে তুলে ধরে প্রতিদ্বন্দ্বীরা ভোটারদের কাছে এম এ মান্নানকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে সক্ষম হচ্ছেন। তবে তাকে বেশি বিপাকে ফেলেছে স্থানীয় কাজী আজিম উদ্দিন কলেজ থেকে বরখাস্তের ঘটনা এবং অধ্যাপক না হয়েও নামের আগে অধ্যাপক পদ ব্যবহারের ঘটনা। দেশের সবচেয়ে বড় সিটি করপোরেশন গাজীপুর সিটি নির্বাচনে দুই প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বীর একজন বিএনপি-জামায়াত সহ আঠারো দল সমর্থিত প্রার্থী অধ্যাপক এম এ মান্নান।

বিগত চার সিটি নির্বাচনের মতো গাজীপুরেও তার জয় প্রত্যাশা করছে বিএনপি-জামায়াত ও ১৮ দলের সমর্থকরা। তবে তার বিরুদ্ধে প্রচারিত অভিযোগ অনুসন্ধানে দেখা গেছে, এই অধ্যাপক এম এ মান্নান আসলে অধ্যাপক ছিলেন না। গাজীপুরের কাজী আজিম উদ্দিন কলেজের একজন প্রভাষক ছিলেন তিনি। আর প্রভাষক থাকাকালীনই বেশ কিছু অনিয়ম ও কলেজের অধ্যক্ষের সাথে অসদাচরণের অভিযোগে ১৯৮৯ সালের শেষদিকে স্থায়ীভাবে চাকরি হারান তিনি। অনুসন্ধানে জানা যায়, ১৯৮৯ এর ২৭ মার্চ এম এ মান্নানের বিরুদ্ধে বেশ কিছু অভিযোগে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়।

তিন সদস্যের তদন্ত কমিটিতে আহবায়ক হিসেবে ছিলেন কলেজের ব্যবস্থাপনা বিভাগের বর্তমান চেয়ারম্যান মহসিন মোহাম্মদ আলী, কলেজের প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত কাজী আজিম উদ্দিন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধি প্রয়াত অধ্যাপক এ বি এম খালেদ। চার পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদনে দেখা যায়, কলেজে ব্যাপকভাবে অনিয়ম ও অসদাচরণ করেছিলেন সে সময়কার প্রভাষক এম এ মান্নান। ১৯৮৪ সালের অক্টোবর থেকে ১৯৮৭ সালের নভেম্বর পর্যন্ত ৬২৩ কার্যদিবসের মধ্যে ২২৯ কার্য দিবসে কতৃপক্ষকে না জানিয়ে অনুপস্থিত থেকেছেন তিনি। আরো ৩৫০ দিন তিনি উপস্থিত হয়েও খাতায় সাক্ষর করেই চলে গেছেন ক্লাস না নিয়েই। আর এই ধরনের কর্মকাণ্ড ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ ১৯৭৩-এর প্রথম স্ট্যাটিউটসের ১৬ ধারা অনুযায়ী পেশাগত অসদাচরণ এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

শুধু তাই নয়, ১৯৮১ সালে এই কলেজেই উপাধ্যক্ষ পদের জন্য আবেদন করেছিলেন তিনি। তাতে শিক্ষাগত যোগ্যতা হিসেবে রসায়ন শাস্ত্রে এমএসসির ফলাফলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘উচ্চতর দ্বিতীয় শ্রেণী’ বলে উল্লেখ করেন যা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নেই। এটাও নৈতিকতা বিরোধী ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ। তবে, তদন্ত কমিটির আহবায়ক ও কলেজের ব্যবস্থাপনা বিভাগের বর্তমান চেয়ারম্যান মহসিন মোহাম্মদ আলী বিবার্তাকে বলেন, ‘নিয়মিত অনুপস্থিত ও অনিয়মের কারণে এম এ মান্নানকে বেশ কয়েকবার শোকজ করা হয়। কিন্তু তিনি প্রভাব খাটিয়ে হাজিরা খাতায় উপস্থিত হিসেবে ফাকা ঘরগুলো পূরণ করতেন।

’ তিনি বলেন, ‘এভাবে একদিন তার এক সহকর্মীকেও একই কারণে শোকজ করায় কলেজের তৎকালীন অধ্যাক্ষ মোহাম্মদ হায়দার আলীকে অপমান-অপদস্ত করেন তখনকার প্রভাষক এম এ মান্নান। অধ্যাক্ষের সাথে বাগবিতণ্ডা শুরু করেন, হুমকি ধামকিও দেয়া শুরু করেন। বাগবিতন্ডার এক পর্যায়ে কলেজের অধ্যক্ষ হায়দার আলী এম এ মান্নানকে বলেন, ‘পেন উল টক’। আর এর জবাবে পা’-এর স্যাণ্ডেল তুলে অধ্যক্ষের মুখের উপর নিয়ে এম এ মান্নান বলেন, ‘স্যান্ডেল উইল টক’। ’ এই ঘটনার সাথে সাথেই গভর্ণিং বডির সভাপতি এক সময়কার ঢাকা সিটি মেয়র কর্ণেল অব. এম মালেকের নেতৃত্বে গভর্নিং বডির জরুরী সভায় এম এ মান্নানকে সাময়িক বরখাস্ত করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।

একই সাথে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটিও গঠন করা হয়। এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করে নিজের সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে কলেজে বোমাবাজি ও ভাংচুর করেন বলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষক জানান। মহসিন মোহাম্মদ আলীর সাথে কথা বলে আরো জানা যায়, ১৯৮৯ সালের দিকে এম এ মান্নান গাজীপুর কাউলতিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ছিলেন, পাশাপাশি প্রভাষক হিসেবে হিসেবে কাজী আজিম উদ্দিন কলেজের ক্যামিস্ট্রির ক্লাস নিতেন। মূলত একই সাথে দুই দায়িত্ব চেয়ারম্যান ও শিক্ষকতা করতে গিয়ে কলেজে ঠিকমতো সময় দিতেন না, ক্লাস নিতেন না বলে এম এ মান্নানকে বারবার শোকজ করা হতো। আর অনিয়মের সাথে অধ্যাক্ষের সাথে তার অসদাচরণরণরে বিষয়টি তদন্ত প্রতিবেদনে প্রমাণিত হয় ১৯৮৯ সালের ২৭ জুন।

এরপর গভর্ণিং বডির পরবর্তী সভায়ই তাকে স্থায়ীভাবে বহিস্কারের সিদ্ধান্ত দেয়া হয়। আর চাকরিচ্যুত হবার পর থেকেই তিনি নামের আগে ‘অধ্যাপক’ ব্যবহার শুরু করেন। মহসিন মোহম্মদ আলী বলেন, ‘সমসাময়িক সময়ে আমরা সবাই সহযোগি অধ্যাপক ছিলাম। তার অধ্যাপক থাকার কোন প্রশ্নই উঠে না। ’ তিনি আরো জানান, ‘বরখাস্তের পর স্থানীয় ছাত্রদলের কিছু ক্যাডারকে দিয়ে এম এ মান্নান কলেজের প্রিন্সিপাল হায়দার আলীকে তার বাসা থেকে রাতের অন্ধকারে তুলে নিয়ে যান।

এরপর গাজীপুরের কালিয়াকৈর এর চন্দ্রা এলাকার একটি জঙ্গলে গাছের সাথে বেধে তাকে শারিরীক নির্যাতন চালানো হয়। এমনকি অধ্যক্ষের মাথার চুল ছেটে মুখে কালী মেখে দেয়া হয়’। পরবর্তীতে ১৯৯১ সালে বিএনপি সরকারের ধর্মপ্রতিমন্ত্রী হওয়ার পর চাকুরী ফিরে পাবার চেষ্টা করলেও চাকুরী আর পাননি তিনি। ‘ শুধু তাই নয়, কলেজের বর্তমান শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক এহসানউল্লাহ ঘটনাটির নিশ্চিত করেন। সে সময় তিনি কলেজে নতুন যোগ দিয়েছেন বলে জানান বিবার্তাকে।

তিনি আরো বলেন, ৯১ এ ধর্ম প্রতিমন্ত্রী হবার পর আবেদন করে চাকুরী না পেলেও প্রভাব খাটিয়ে তদন্ত কমিটির সদস্য অধ্যাপক মহসিন মুহাম্মদ আলী, এম এ মালেক ও হিসাব বিজ্ঞান বিভাগের বর্তমান চেয়ারম্যান অধ্যাপক মুজিবুর রহমানকে সাময়িক বরখাস্ত করেন। পরবর্তীতে ৯৬ এ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে এদের উপর থেকে সাময়িক বরখাস্তের আদেশ তুলে দেয়া হয়। সেই ঘটনার সাক্ষী ছিলেন গাজীপুরের জয়দেবপুরের বর্তমান সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আ.ক.ম মোজাম্মেল হক। তিনি আরো বলেন, এম এ মান্নান যখন ধর্মপ্রতিমন্ত্রী ছিলেন তখনো তার বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ ছিল। যা এবারের নির্বাচনী প্রচারণায়ও কাজে লাগাচ্ছে মহাজোট প্রার্থীর সমর্থকরা।

অভিযোগগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল হজ্জ্বের টাকা মেরে দেন এম এ মান্নান। উল্লেখ্য, ১৯৮১ সালে প্রতিষ্ঠিত কাজী আজিম উদ্দিন কলেজের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন গাজীপুর সিটি করপোরেশন থেকে সরে যাওয়া জাতীয় পার্টির প্রার্থী ব্রিগেডিয়ার (অব.) মাহমুদ হাসানের পিতা কাজী আজিমউদ্দিন আহমেদ। আর এম এ মান্নানের বিরুদ্ধে সেই তদন্ত কমিটিরও সদস্য ছিলেন কাজী আজিমউদ্দিন। আর যে কারনেই জাতীয় পার্টির নেতা মাহমুদ হাসান মহাজোট প্রার্থী এডভোকেট আজমত উল্লাহকে সমর্থন না দিলেও বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী অধ্যাপক এম এ মান্নানের বিরুদ্ধে ব্যক্তিগতভাবে প্রচারণা চালাচ্ছেন বলেও জানা গেছে। যদিও এক সভায় স্থানীয় নেতাদের চাপের মুখে তিনি এম এ মান্নানের পক্ষে কাজ করার ঘোষনা দিয়েছেন।

তবে এসব অভিযোগ সম্পর্কে অধ্যাপক এম এ মান্নান বলেছেন, এসব অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা ও বানোয়াট। তাকে হেয় করতেই কেবল এসব কুপ্রচারণা চালানো হচ্ছে। প্রতিপক্ষ ষড়যন্ত্রমূলকভাবে এটা প্রচার করছে বলেও অভিযোগ করেছেন তিনি। ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.