শিক্ষাসফর আমাদের শিক্ষার একটা অন্যতম অংশ তাই প্রতিবছরই ডিপার্টমেণ্ট থেকে সারা দেশের নানা স্থানে শিক্ষাসফরের আয়োজন করা হয়। এবার ডি্পার্টমেণ্টের বার্ষিক পিকনিক আর প্রথম বর্ষের ছাত্রদের জন্য তাদের প্রথম শিক্ষাসফরের আয়োজন করা হয়েছিল গাজীপুরের বঙ্গবন্ধু সাফারী পার্কে। ইচ্ছা ছিল শালবনের ছায়ায় বন্যপশুর বিচরন দেখে আর সুশোভিত বাগানে ঘুরে বন্ধু আর ছোট বা বড় ভাই বোনের সাথে আড্ডা দিয়ে দিনটা সুন্দরভাবে কাটিয়ে দেব। সেই সাথে শিক্ষকদের কাছ থেকে ছোটরা চিনে নেবে অচেনা সব উদ্ভিদ আর আমরাও এই ফাঁকে নিজেরদের জ্ঞানটা সমৃদ্ধ করে নেব।
এই উদ্দেশ্যে চারটি বাসে ডিপার্টমেন্টের প্রায় ২২০ জন ছাত্রছাত্রী সেই সাথে দশজন শিক্ষক তাদের পরিবারের কিছু মানুষ(শিশুসহ) এবং কয়েকজন অফিস সহকারী মিলে সকাল দশটার দিকে ক্যাম্পাস থেকে গাজীপুরের দিকে রওনা হলাম।
প্রায় দুইঘন্টার বাস জার্নি শেষ করে দুপুর ১২টার দিকে আমরা সেখানে পৌঁছায়। বিশাল জায়গা নিয়ে গড়ে উঠেছে এই সাফারী পার্ক। অনেক মানুষে এখানে বেড়াতে আসে তা বুঝলাম অনেক স্কুল ড্রেস পড়া ছাত্রছাত্রী এবং অনেক সাধারন মানুষ আর বাস দেখে। আমাদের দুইটি বাস ক্যাম্পাসের আর দুইটি ছিল ভাড়া করা। এলাকায় পৌঁছে আমরা সবাই বাস থেকে নেমে এদিকে সেদিকে ঘুরে দেখছিলাম।
এই সুযোগে আমাদের স্যার এবং বন্ধুরা ভেতরে প্রবেশের টিকিটের ব্যবস্থা করতে কাউন্টারে গেলেন।
আমাদের কাছে বন অধিদপ্তরের একটা ছাড়পত্র ছিল। সেটা দেখিয়ে স্বল্পমূল্যে ছাত্রদের জন্য প্রবেশ টিকিট সংগ্রহ করার কথা ছিল। এই ফর্মে সচিবের সাইন ছিল কিন্ত সিল ছিল না। সেটা অবশ্যই আমাদের ভুল নয়।
এই অযুহাতে কাউন্টারের লোকজন আমাদের টিকিট দিতে চাইছিল না। তখন আমাদের টিচার এবং ছাত্ররা তাদের বোঝানোর চেষ্টা করে। কিন্ত তারা কোনো কথাই শুনতে চাইছিল না এবং আমাদের সাথে তাদের আচরন দেখে মনে হচ্ছিল আমরা দেশের অন্যতম একটি সর্বোচ্চ বিদ্যাপিঠ থেকে নয় বরং গ্রাম্য কোনো পাঠশালা থেকে বেড়াতে এসেছি। আমাদের স্যারদের সাথে তারা অসম্ভব উদ্ধত ব্যবহার করছিল। তবুও যথেষ্ট নম্র ভাষায় তাদের বলা হচ্ছিল যে আপনারা বন অধিদপ্তরে ফোন দিয়ে কথা বলে নিশ্চিত হন কিন্ত তারা কোনো কথাই শুনছিল না।
এ পর্যায়ে তারা আমাদের একজন শিক্ষকের বুকে ধাক্কা দিয়ে বাজে কথা বলে। স্বাভাবিক ভাবেই তখন উপস্থিত ছাত্ররা উত্তপ্ত হয়ে উঠে বলে যে আপনি জানেন যে আপনি একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের সাথে কথা বলছেন। তখন তারা এমন ভাব দেখায় যেন এটা কোনো বিষয়ই না। আমাদের একজন ছাত্র তখন রেগে উঠে দরজায় একটা লাথি দেয়। এরপরেই আশেপাশের কয়জন সহ কাউন্টারের লোকজন লাঠি নিয়ে এগিয়ে এসে সবাইকে ঘেরাও করে এবং এলোপাথারী আঘাত করা শুরু করে।
এসময় তারা বুকের কলার ধরে আমাদের একজন সিনিয়র শিক্ষক কে ভেতরে টেনে নিয়ে যায় এবং অন্য ছাত্রদের সাথে মারামারি শুরু করে। এত গন্ডগোল দেখে আমাদের অন্য ছাত্ররাও সেখানে ছুটে যায়।
এরপরে চার থেকে পাঁচ দফায় তারা আমাদের ছাত্রদের ধাওয়া করে এবং তদের আহত করে। বেশির ভাগ শিক্ষকের গায়েও লাগে লাঠির আঘাত। ভাগ্যক্রমে আমাদের ম্যাডাম এবং ছাত্রীরা মূল প্রবেশদ্বারের কাছেই ছিল তাই তারা দ্রুত ওপাশে নিরাপদ আশ্র্য়ে যেতে পেরেছিল।
কাউন্টার থেকে মূল প্রবেশদ্বারের দুরত্ব একশ গজ মত হতে পারে। সেখান থেকে তাড়া দিয়ে আমাদের ছাত্রদের তারা মূল গেটে তাড়িয়ে আনে। এসময় গেট খুলে দেওয়ায় অনেক ছাত্র গেটের ভেতরে ঢুকে পড়ে আর যারা ঢুকতে পারেনি তাদেরকে প্রচন্ড প্রহার করা হয়। আমাদের ডিপার্টমেণ্টের সবচেয়ে সিনিয়র ব্যচের এক ভাইয়াকে রাস্তায় ফেলে এলোপাথারী বাঁশের লাঠি আর কাঠ দিয়ে পিটানো হয়।
আতংকিত অবস্থায় যখন আমরা পার্কের দেয়ালের মাঝে অবস্থান করছিলাম তখন আমরা জানতাম না যে আমাদের ভাগ্যে কি আছে।
শিক্ষকদের ফোন পেয়ে প্রায় ঘন্টা খানেকের মধ্যে গাজীপুরের ডিসি সাহেব তার সাথে পুলিশ ফোর্স নিয়ে আসেন। এর ঘন্টা দুয়েক পর পরিস্থিতি একটু স্বাভাবিক হলে তিন ভ্যান পুলিশের পাহারায় আমরা এলাকা ছাড়ি।
এই হলো মূল ঘটনা এবার আসি একটু গভীরে। আমরা উদ্ভিদবিজ্ঞানের শিক্ষার্থী। আমাদের শিক্ষার খাতিরেই দেশের নানা এলাকার বন জঙ্গলে প্রতি বছরই তিন থেকে চারটা শিক্ষাসফর থাকে এক একটা ব্যাচের।
আমরা অনেক দূর্গম এলাকাতেও ভ্রমন করি আর এই জন্য উচ্চতম প্রশাসনের ছাড়পত্র আমাদের দরকার হয় বিষয়টাকে সহজ এবং সুলভ করার জন্য। তাই এবিষয়টা নতুন কিছু নয়। গাজীপুএর সাফারী পার্ক ঠিক শিক্ষাসফরের উপযুক্ত জায়গা না হলেও পিকনিকের জন্য এটাকে আদর্শ বলে আমরা মনে করেছিলাম। আর প্রথম বর্ষের ছাত্রদের শিক্ষা দেবার মত উপকরন আছে বলেই আমাদের এখানে আসা।
এই যে পুরো ঘটনাটা ঘটে গেল আমরা কিন্ত কোনো সিকিউরিটি ফোর্স দেখিনি।
এতবড় এলাকায় মানুষের জানমালের নিরাপত্তার জন্য সিকিউরিটি থাকবে না এটা কেমন কথা?এমন কি মূল প্রবেশ দ্বারে কিছু পুরুষ আর মহিলা লোকের ব্যাগ চেক করছে এবং কোনো পানি বা খাবার দেখলে তা ছিনিয়ে নিয়ে পাশে জমা করে রাখছে। এছাড়া আলাদা কোনো পাহারার ব্যবস্থা আছে বলে মনে হলো না। এদের আচরন ও খুবই রূঢ়। এমনকি আশেপাশে অনেক লোক থাকলেও কেউ আমাদের সাহায্য করতে এগিয়ে আসেনি। টিকিট ছাড়া মূল গেটে ঢোকা যায় না তাই ঝামেলা শুরু হলে মেয়েরা গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল।
একজন শিক্ষক ধমক দিয়ে তাদের ভেতরে না ঢোকালে তাদের সাথে জঘন্য কাণ্ড হয়ে যেত অবলীলায়। তবে অন্য জায়গাতে তো দেখেছি ঝামেলা বাধলে আশেপাশে যারা থাকে তারা মেয়েদের আগে নিরাপদ স্থানে সরে আসতে পরামর্শ দেয়। এখানে তা হয়নি। বরং মেয়েরা যখন গেটের কাছে পাংশু মুখে প্রিয়বন্ধুর জন্য দুঃশ্চিন্তায় নীল হয়ে অপেক্ষা করছিল তখন গেটে থাকা মানুষ গুলো কর্কষ ভাষায় গেট থেকে সরে যাওয়ার জন্য আদেশ দিচ্ছিল বারবার যাতে তাদের অন্য কাস্টোমারদের ভেতরে যাওয়া সুবিধা হয়।
এখন আসি সব চেয়ে বড় প্রশ্নে।
সেটা হচ্ছে কেন ঐ টিকিট কাউন্টারে বাঁশের লাঠি জমা করা ছিল?আর কেনই বা এত তুচ্ছ বিষয় নিয়ে তারা মারামারী করতে এগিয়ে এল?এবং কেন কথা কাটাকাটি শুরু হওয়া মাত্র আশেপাশে থেকে ১৫-২০ জন লোক এগিয়ে আসল এবং নির্দ্বীধায় লাঠি তুলে ছাত্র শিক্ষকদের আঘাত করল?উত্তরগুলোও দিয়ে দিচ্ছি। যতটুকু জেনেছি এই সাফারী পার্কটা সরকারি নয় অর্থাৎ লিজ দেয়া। অবশ্যি লিজ নিয়েছে এলাকার কিছু ক্ষমতাশালী সন্ত্রাসীর দল। তারা কাউন্টারে লাঠি জমা এই জন্যই নিশ্চয় রাখে যাতে অযথা কিছু করে একটা ঝামেলা বাঁধানো যায় এবং এই মারামারির সুযোগে ঘুরতে আসা মানুষদের কাছে থেকে মুল্যবান জিনিস ছিনিয়ে নেয়া যায়। শুনেছি সাফারী পার্কের মূল অংশে(যেটা অনেক ভেতরে এবং পুরোটা ঘুরে দেখতে বাস লাগে।
এখানে আমরা প্রবেশ করতেই পারিনি। তাড়া খেয়ে আমরা তার আগের বাগানের মত অংশে আশ্রয় নিয়ছিলাম) ছিনতাই হয় নিয়মিত। ছাত্রীদের নিয়ে ঘুরতে আসা একজন স্কুল শিক্ষকের কাছে শুনলাম আগের দিনও নাকি এখানে কয়জনকে মেরে মাটিতে শোয়ানো হয়েছে এবং এমন ঘটনা নাকি প্রায়ই হয়। আমি ভেতরের একজন খালাকে বিষয়টা জিগাসা করলে তিনি কিন্ত এটা একদমই স্বীকার করেননি।
প্রথম দিকে তারা ২০ জন আর আমাদের ছেলেরা অনেক বেশি থাকায় দফায় দফায় মেরে আহত করা ছাড়া তেমন কিছু করতে পারেনি।
কিন্ত আমরা যদি সংখ্যায় কম হতাম তবে সেখানে কারো প্রান যাওয়া অসম্ভব ছিলনা। ছাত্রদের কেউ কেউ বলেছে তারা নাকি এলাকার অন্য লোকদের ফোন করে ডাকছিল এবং ফায়ার আর্মসের কথা বলছিল। বিষয়টা আমি বিশ্বাস করছি কারন আমি নিজ চোখে দেখেছি যে কি নির্মম ভাবে ছেলেগুলোকে লাঠি দিয়ে পেটানো হচ্ছিল। কিন্ত তাদের আসলে কোনো অপরাধ ছিলনা। এবং ঝামেলাটা তার অনেকটা ইচ্ছা করেই বাঁধিয়েছিল।
আমরা নিশ্চিত ছিলাম যে স্থানীয় প্রশাসন এখানে নাক না গলালে এবং মন্ত্রী পর্যায়ে খবর না গেলে আমরা সুস্থ দেহে আজ ক্যাম্পাসে ফিরতে পারতাম না।
ডিসি সাহেব এসে অনেক আশ্বাস দিয়েছেন কিন্ত আমরা ফাঁকা বুলি শুনতে চাই না আমরা চাই অপরাধির সাজা হোক। একটা পার্কে পিকনিক করতে গিয়ে যদি সর্বোচ্চ বিদ্যাপিঠের ছাত্রদের প্রানের ঝুঁকি নিতে হয়,যদি আমাদের চোখের সামনে আমাদের শ্রদ্ধেয় শিক্ষকদের গায়ে হাত তোলা হয় তবে কেন আমরা ফাঁকা বুলিতে সন্তষ্ট থাকব?আমাদের দাবী…
১- ঘটনার সাথে যারা জড়িত আমাদের দেয়া ছবি এবং ভিডিও দেখে তাদের সনাক্ত করতে হবে।
২-জড়িতদের গ্রেফতার করে উপযুক্ত আইনের আওতায় আনতে হবে।
৩-এমন ঘটনার পেছনে কাদের মদদ আছে তাদের খুঁজে বের করতে হবে এবং দিনের পর দিন কিভাবে তারা এত নির্ভয়ে সন্ত্রাসী কর্মকান্ড চালাচ্ছে তা খুঁজে বের করে উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে হবে।
৪-গাজীপুর সাফারী পার্ক সহ অন্যসব জাতীয় উদ্যান আর এ জাতীয় অন্যসব ট্যুরিস্ট স্পটগুলোর নিরাপত্তা জোরদার করতে হবে যাতে সাধারন ভ্রমনকারীর জানমাল রক্ষা পায় এবং তাদের কোনো অ্প্রীতিকর অবস্থায় পড়তে না হয়।
আপনি যদি গাজীপুর সাফারী পার্কে যাওয়ার প্ল্যান করে থেকেন তবে আরেকবার ভেবে দেখুন। আমাদের মত অবস্থা আপনারও হতে পারে কিংবা তার চেয়ে খারাপও হতে পারে। যারা বিশ্ববিদ্যালয়ের আড়াইশ ছাত্রের একটা দলের উপর তুচ্ছ কারনে হামলা করতে দ্বিধা করেনা তারা ছোট একটা দলের সাথে কি করতে পারে একটু ভেবে দেখুন। আমি মোটেও আমার দেশের সাফারী পার্ক,ইকো পার্ক বা ন্যাশনাল গার্ডেন গুলোর বিরুদ্ধে প্রচারনা চালানোর জন্য লিখতে বসিনি।
বাংলাদেশে এ ধরনের উদ্যোগ সবসময় আমি খুব পছন্দ করে আসছি কিন্ত সেখানে বেড়াতে গেলে যদি নিজের জীবনের নিরাপত্তার প্রশ্ন ওঠে তবে আসলেই ভেবে দেখার দরকার আছে আমাদের সবার।
প্রশাসনের কাছে আমার প্রশ্ন যে তারা কেন এমন একটা জায়গা খুলে বসবে যেখানে মানুষকে বেড়ানোর লোভ দেখিয়ে ডাকা হবে ঠিকই কিন্ত নিরাপত্তা দেয়া হবে না। গাজীপুরের প্রশাসনের কাছে আমি প্রশ্ন করতে চাই যে, আপনারা কি জানেন না এখানে প্রায়ই এমন ঘটনা হয়?তবে জেনে শুনে চোখ বন্ধ করে বসে থাকেন কেন?ওখান থেকে পুলিশ ফাঁড়ী খুবই কাছে। ঘটনার সাথে সাথেই যখন আমাদের একজন শিক্ষক ফোন করে সাহায্য চাইলেন তখনই কেন পুলিশ আসলো না। যদি আসত তবে অনেকগুলো ছেলে অযথা মার খাওয়া থেকে বেঁচে যেত আর আমাদের এক লক্ষ বিশ হাজার টাকার আয়োজন পানিতে পড়ত না।
সবচেয়ে বড় কথা নিচের বন্ধু, ভাই আর শিক্ষকদের একদল অশিক্ষিত সন্ত্রাসীর হাতে লাঞ্ছিত হতে দেখার দূর্ভাগ্য আমাদের হতো না।
এখানে দেখুন কিভাবে আমাদের এক সিনিয়র ভাইকে পেটানো হয়েছে
এখানে ডিসি সাহেব সকলকে শান্তনার বানী শোনাচ্ছেন
এখানে আতংকিত ছাত্রদের একদল পুলিশ ফোর্সের আশায় অপেক্ষা করছে
পুলিশ প্রহরায় পার্ক ত্যাগ করার সময়
নেট খারাপ তাই এখন ভিডিওগুলো দিতে পারছি না। সকালে আপডেট দেব।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।