মিতা নূর আত্মহত্যা করেছেন। তবে যে তিনি বিষন্নতায় ভূগতেন, তা তার নিকটজন/ সহকর্মী সহ গাড়ীর ড্রাইভারও স্বীকার করেছেন। কি এমন কথা ছিল যা নাকি তিনি কাউকেই বলতে পারেননি? দীর্ঘদিন নাকি তিনি ঘুমের ট্যাবলেট ব্যবহার করতেন?
মায়ের মৃত্য প্রসঙ্গে বড় ছেলে বলেন, সন্তান হিসেবে বিশ্বাসই করতে পারছি না আমার মা মারা গেছেন। সে আবেগতাড়িত কণ্ঠে বলে, বেশ কয়েক মাস ধরে মা হতাশায় ভুগছিলেন। নিয়মিত ঘুমের ট্যাবলেট খেতেন।
একপর্যায়ে আসক্ত হয়ে পড়েন। অল্পতেই তার মেজাজ গরম হয়ে যেতো। খিটখিটে স্বভাবের হয়েছিলেন। ঘনিষ্ঠ স্বজনদের ধারণা- বিষণ্ন্নতার কারণেই আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে পারেন মিতা নূর। গত কয়েক মাস ধরে তিনি অত্যধিক বিষণ্ন্নতায় ভুগছিলেন।
বাড়ির বাইরে যেতেন কম, অভিনয় জগৎ থেকেও গুটিয়ে নিয়েছিলেন নিজেকে। কথা বলতেন কম, নিয়মিত খাবারেও আগ্রহ ছিল না। সারাক্ষণ ঘরের ভেতর দরজা বন্ধ করে শুয়ে কাটাতেন। কেউ ডাকাডাকি করলে হতেন বিরক্ত। কারণে-অকারণে রাগারাগি করা ছিল তার নৈমিত্তিক বিষয়।
তার বিষণ্নতার নেপথ্যে স্বামী শাহনূর রহমান মজুমদার ওরফে রানার কোন পরকীয়া, মিতা নূরের নিজেরই কারো সঙ্গে কোন বিশেষ সম্পর্ক নাকি শোবিজে আগের মতো অবস্থান ধরে রাখতে না পারা, জানা যায়নি এসব বিষয়েও। কিন্তু শোবিজসহ সবখানেই এখন এসব প্রশ্নই ঘুরপাক খাচ্ছে। (মানবজমিন)
আত্মহত্যা একটি অপ্রতিরোধ্য সামাজিক এবং মানসিক ব্যাধি। অনেকেই একে সমস্যার সমাধান মনে করলেও এটি কোন সমস্যার সমাধান নয় বরং সমস্যার কারণ। ২০০১ থেকে ২০০৯ পর্যন্ত আত্মহত্যা নিয়ে যে পরিসংখ্যান দাঁড় করানো হয়েছে তা থেকে দেখা যায় যে এই ৮ বছরে প্রতিবছর দেশে গড়ে ১০ হাজার ৪শ’ ৮৪ জন আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছে।
বাংলাদেশের বিভিন্ন মেডিকেল কলেজের গবেষণায় দেখা যায় যারা আত্মহত্যার চেষ্টা করে তাদের অধিকাংশই মানসিকরোগে আক্রান্ত থাকে। যারা অধিকাংশই পরিবারের সদস্য, বন্ধু-বান্ধবের কাছে আত্মহত্যার ইচ্ছা প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে প্রকাশ করে থাকে। পরিসংখ্যানে আরো পাওয়া যায় যারা আত্মহত্যা করেছে তাদের ৮০ ভাগই আত্মহত্যার পূর্বাভাস দিয়েছে কিন্তু যথাযথ গুরুত্ব পায়নি বলে কেউ প্রতিরোধের ব্যবস্থাও গ্রহণ করেনি। মানুষ যখন হতাশায় আক্রান্ত হয় এবং সেই সমস্যা থেকে বের হওয়ার আর কোন পথ খুজে না পায়, চারপাশে কাউকে আপন করে না পায় তখনই কেবল এই পথ বেছে নেয়। আত্মহত্যার পূর্বে ব্যক্তি নানাভাবে সিগন্যাল দেয় একটু লক্ষ্য করলেই তাকে বাচানো সম্ভব।
তখন যদি কেউ যুক্তি দিয়ে তাকে না বোঝায় যে তার সমস্যার সমাধানের ভিন্ন ভিন্ন পথ আছে তখনই সে আত্মহননের পথ বেছে নেয়। মানুষের ক্রোধ যখন তার ভিতরটাকে কুড়ে কুড়ে খায় তখনই সে সাধারণত আত্মহননের পথ বেছে নেয়। তবে এই সময় তার পেছনে আশাহীনতা, হতাশা, অপরাধবোধ, অপমান, প্রতিশোধস্পৃহা ইত্যাদি সক্রিয় থাকে।
অধিকাংশ ক্ষেত্রে পরিকল্পনার মাধ্যমে আত্মহত্যা করে, অন্যদিকে আবার এটা অনেকটা "ইমপুল`স" তাড়িত। যা নাকি তাৎক্ষণিক উত্তেজনা বা তাড়নায় ইমপালসিভ আত্মহত্যা।
পরিকল্পনাকারীদের মনে প্রথমে আত্মহত্যার ইচ্ছা জাগে, ইচ্ছার পর পরিকল্পনা করে সে, তারপর আত্মহত্যার জন্য attempt গ্রহণ করে। বড় ধরনের বিষণ্ণতা রোগের শেষ পরিণতি হচ্ছে পরিকল্পনার মাধ্যমে আত্মহত্যা।
সবচেয়ে যে কারনে বেশী মানুষ আত্মহত্যা করে তার নাম বিষন্নতা। বিষণ্ণতা মানসিক রোগগুলোর মধ্যে অত্যন্ত সাধারণ এবং ধ্বংসাত্মক একটি রোগ। কারণ এ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি জীবন চলার ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ে এবং কোনো কোনো রোগী অবলীলায় আত্মহত্যার মাধ্যমে মুক্তি পেতে চেষ্টা করে এবং কখনো কখনো সফল হয়।
তাই আর কিছু দিনের মধ্যেই হয়তো বিষণ্ণতা রোগটি পৃথিবীতে এক নম্বর ‘কিলার ডিজিজ’ হিসেবে পরিচিতি পাবে। যেকোনো লোক যেকোনো সময়ে বিষণ্ণতা রোগে আক্রান্ত হতে পারে তবে সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসার মাধ্যমে শতকরা ১০০ ভাগ রোগীই ভালো হয়ে যেতে পারে।
আর মিতা এই বিষন্নতার শিকার।
জটিল মানসিক রোগ সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্তরা অন্যদের তুলনায় অনেক বেশি আত্মহত্যাপ্রবণ হয়ে থাকে। ১০ শতাংশ সিজোফ্রেনিক রোগী আত্মহত্যা করে।
গবেষণায় দেখা গেছে, ২০-৪০ শতাংশ রোগী অসুস্থ থাকা অবস্থায় অন্তত একবার আত্মহত্যার চেষ্টা চালায়। সিজোফ্রেনিক রোগীদের মধ্যে যাদের বিষণ্ণতার উপসর্গ থাকে, তারা আত্মহত্যাপ্রবণ হতে পারে। অনেক সিজোফ্রেনিক রোগী ‘গায়েবী আওয়াজ’ শোনে, চিকিৎসা শাস্ত্রের পরিভাষায় যাকে ‘Auditory Hallusination’ বলা হয়। অনেকে শোনে, কেউ তাকে উপদেশ বা আদেশ দিচ্ছে আত্মহত্যা করতে। অনেক রোগীই এই ‘গায়েবী’ আদেশটি অবশ্য পালনীয় হিসেবে গণ্য করে।
অনেক সিজোফ্রেনিক রোগীর মধ্যে অস্বাভাবিক সন্দেহ ও ভয় থাকে, যা তাকে পর্যায়ক্রমে সমাজ থেকে দূরে ঠেলে দেয়, একাকী করে রাখে, যাতে রোগী এক সময় আত্মহত্যা করে। আবার কোন কোন রোগী সুস্থ হওয়ার পর্যায়েও আত্মহত্যার ঝুঁকিতে থাকতে পারে। কারণ, এ সময়টায় অনেকের রোগটি সম্পর্কে ধারণা হয়, ফলে নিজেদের অন্যদের চেয়ে আলাদা ও অস্বাভাবিক মনে করে।
আত্মহত্যা সম্পর্কিত কিছু তথ্যঃ
১- মেয়েরা পুরুষদের চেয়ে তিনগুন আত্মহত্যার চেষ্টা করে কিন্তু মরেনা। আর আত্মহত্যার হার মেয়েদের চেয়ে পুরুষদের মধ্যে বেশি(তবে বর্তমানে মেয়েদের আত্মহত্যার হার ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছে)
২- যারা একবার আত্মহত্যার চেষ্টা করে তারা সাধারণত দ্বিতীয়বার আর সে মুখী হয়না।
৩- যুবক বয়সে মানুষ আত্মহত্যার চেষ্টা বেশি করে কিন্তু সফল বেশি হয় বয়ষ্করা।
৪- যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি বিশ মিনিটে একজন আত্মহত্যার চেষ্টা করে। কিন্তু তারপরও দেখা যায় তারা প্রতি দুইশ জনে একজন সফল হয়।
৫- বসন্ত ও শীতকালে আত্মহত্যার হার বেড়ে যায়।
৬- আত্মহত্যার চেষ্টার আগে যারা দার্শনিক কথা লিখে যায় তারা মূলত মরেনা কিন্তু যারা স্বাভাবিক খবর লিখে যায় তারা মরে।
৭- গণমাধ্যমে প্রকাশিত আত্মহত্যার বিবিরণী মানুষকে আত্মহত্যার জন্যে প্ররোচিত করে।
৮- সবচেয়ে আশ্চর্যজনক বিষয় হচ্ছে মানুষ গলায় ফাঁস নিয়ে ঝুলে পড়ার পর পরই নিজেই আবার বাঁচার চেষ্টা করে। তবে মজার ব্যপার হলো গলায় ফাঁস নিয়ে ঝুলে পড়া মাত্রই মানুষের গলার নিম্নাঙ্গ সমূহ অকার্যকর হয়ে যায়। বিধায় সে মানসিকভাবে বাঁচার জন্য ইচ্ছা বা আপ্রাণ চেষ্টা করলেও সেটা আর নিজের দ্বারা সম্ভব হয় না। তবে অন্য কোন মানুষের সামান্য সাহায্য পেলেই অর্থাৎ অন্য কোন মাধ্যমে সে পায়ে সামান্য শক্তি পেলেই মৃত্যু থেকে রক্ষা পায়।
এরকম আত্মহত্যার চেষ্টা থেকে বেঁচে যাওয়া মানুষ আর কখনো আত্মহত্যা করতে যায় না।
৯- একইভাবে মৃত্যুর উদ্দেশ্যে বিষপান করার পর মৃত্যুযন্ত্রনা থেকে মুক্তি পেতে মানুষ বাচার চেষ্টা করে, সে চেষ্টা সকলের ক্ষেত্রে সফল হয় না।
১০- আত্মহত্যাকারীদের হার সবচেয়ে বেশি বিশ্বের স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলোতে
আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতিতে আত্মহত্যাকে মানসিক অসুস্থতাসংক্রান্ত বিষয় হিসেবে চিহ্নিত করেছে। উপযুক্ত চিকিৎসা পদ্ধতি গ্রহণের মাধ্যমে এ ব্যাধি থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভবপর। যখন একজন ব্যক্তি আত্মহত্যার বিষয়ে ব্যাপক চিন্তা-ভাবনা শুরু করেন, তখনই তাকে দ্রুত চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যেতে হবে
মনে রাখতে হবেঃ
=> আত্মহত্যা মানে, আইন লঙ্ঘন করা, অপরাধ করা।
=> আত্মহত্যা মানে, ধর্মীয় অনুশাসন অবজ্ঞা করা।
=> আত্মহত্যা মানে সমাজে পচনশীল ক্ষত বাড়িয়ে দেয়া, সমাজকে পেছনের দিকে ঠেলে দেয়া।
=> আত্মহত্যা কখনো প্রতিবাদের অস্ত্র কিংবা ভাষা হতে পারে না। আত্মহত্যার ইচ্ছা, আগ্রহ জয় করতে পারা মানেই একটি সুন্দর জীবনের নতুন করে সূচনা। জীবন থেকে পালিয়ে যাওয়া হচ্ছে কাপুরুষতা।
=> আত্মহত্যা মানে অন্যায়ের সাথে আপোষ করা।
=> আত্মহত্যা মানে খুব সহজে হার মানা।
যদি কখনো মনে হয়, আপনি বিষন্নতায় আক্রান্ত; তাহলে অতি সত্বর কারো সাথে খোলাখুলি কথা বলুন। যদি মনে হয়, তাহলে আমার সাথে ও যোগাযোগ করতে পারেন।
আমার ব্লগটি ঘুরে দেখুনঃ http://ptohelp.blogspot.se/
কৃতজ্ঞতাঃ ভূতাত্মা ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।