আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বিমল বাউলের শিঙ্গাটা দুই মাস আগে চুরি হয়ে গেছে

বিমল বাউলের মনখারাপ। খুবই শোকার্ত তাঁর গলা। এই মানুষটার বাড়ি মাগুরার শালিখা থানার সীমাখালিতে। প্রায় ৩৫ বছর লালনের গান গেয়ে, দেশে দেশে, পথে পথে দিন কাটে তাঁর। গলাটা ভারী দরদভরা।

লালনের গান তো আর কম গায়কের গলায় শুনলাম না, কিন্তু বিমল দা'র তুলনা মেলে না। ...একবার ছেউড়িয়াতে, দোলের লালন-উৎসবে, মাঝরাতে, লালন-সমাধিসৌধের পাশে দেখলাম তাঁর আসন। শুনলাম লালন, শুনলাম তাঁর লালন-গায়কী। সেই থেকে বিমল দা'র সঙ্গে আমার ভাব। পুঁজির দৌরাত্মের বাইরে প্রতিষ্ঠিত হেন ভাব, এ ভাব দিনে দিনে বাড়ে।

বিমল দা মাঝেমধ্যেই ঢাকায় আসেন। টেলিভিশন-মঞ্চ-সিনেমায় কেউ কাজ করালে করেন। চারুকলার ওদিকটায় ঘোরাঘুরি করেন। গেলেই, দেখা হয়ে যায়। দাদুর মৃত্যুর খবরটা যখন তাঁকে ফোনে জানালাম, তিনি মাগুরায় তখন, খবরটা শুনেই ডুকরে উঠলেন।

চারুকলায়, দাদু যেখানে তাঁর নন-কনভেনশনাল শেলফমেইড অর্নামেন্টস নিয়ে বসতেন, তার পাশেই তো লাবু ভাই বাঁশির সুরধ্বনিতে ভিজিয়ে তোলেন...বিমল দা ঢাকায় এলে দাদু ও লাবু ভাইযের মাঝামাঝিতে বসতেন। দিতেন শিঙ্গায় ফুঁক...ফুঁ...উম...ম... সেই বিমল দা'র খুব মনখারাপ। আমি তাঁর মনখারাপটা ধরার ক্ষমতা রাখি না। ...ক'বছর আগে একবার, সমকাল পত্রিকায় আমার এক লেখায় এমনি একটা ইমেজ ক্রিয়েট করতে গিয়ে আমি হয়তো লিখেছিলাম...লালবাউলের বাড়ি পুড়ে যাচ্ছে...মুড অফ নায়িকার মুড অ্যাকশান দিলেও অন হচ্ছে না...আরো কিছু ইমেজ...লেখাটা শুক্রবার কালের খেয়া'তে ছাপা হলো, রবিবারদিন দুপুরে মাগুরার শালিখা থেকে কারো সেলফোনে বিমল দা কেঁদে ফেললেন এক্কেবার। বললাম, কি হইছে বিমল দা? বিমল দা ফোনের ওপারে দীর্ঘশ্বাস-স্বরে কথা বলছিলেন।

বললেন, আমার বাড়ি পুড়ে গেছে। বললাম, কবে? গতকাল। আপনি টের পেয়ে গেছিলেন, তাই না? আমি বিমল দা'র কথা কিছু বুঝতে পারি না। বললাম, বাড়ি কিভাবে পুড়ল? বিমল দা'র অভিমান আরো বাড়ল। বললেন, আপনি শুক্রবারদিন সমকাল পত্রিকায় লেখেছেন, লালবাউলের বাড়ি পুড়ে যাচ্ছে, গতকাল ছিল শনিবার, আমার বাড়ি পুড়ে গেল! তুমি আসলে জানতে, আমার বাড়িতে আগুন আসবে...সব পুড়ে যাবে... বললাম, বিমল দা, এটা মোটেও ঠিক না।

এটা হয়তো সম্পূর্ণ কাকতাল। আমি থাকি ঢাকায়। বিমল দা'র বাড়ি মাগুরায়। আমার একটা লেখায় সেফ একটা ইমেজ হিসেবে আমি লিখলাম, লালবাউল প্রসঙ্গটা, সেটা কাগজে ছাপা হলো শুক্রবার, আর শনিবার কোথাও সত্যি-সত্যি এক লালবাউলের বাড়ি পুড়ে যাবে_এ আমি বিশ্বাস করি না। আমার বিশ্বাস তো এতো গায়েবী না।

কিন্তু জগতের সহজ-সরলশিশু বিমল বাউলকে তা বিশ্বাস করাবে কে?... বিমল দা এরপর ঢাকায এসে তাঁর সাধকী আমাকে অনেক ভক্তি দেখালেন। কদিন আমার বাসায় থাকলেন। ঘটে যাওয়া পরিস্থতিতে আমারও একধরনের মনখারাপ হলো। একরাতে তাঁকে নিয়ে গেলাম ধ্রুব দা'র বাসায়। অনেক রাত পর্যন্ত গান করলেন বিমল দা।

... সম্প্রতি বিমল দা আবারও ফোন করে জানালেন, তাঁর মনখারাপ...রাতে তাঁর ঘুম হচ্ছে না, স্বপ্নের মধ্যে তিনি তাঁর শিঙ্গাটা খুঁজে বেড়াচ্ছেন, কারণ, কোথায় যেন গান গাইতে ডেকেছিল কারা। তারপর সেখানেই ঘুমের ব্যবস্থা করেছিল তারা। সকালে উঠেই বিমল দা দ্যাখেন, তাঁর কুড়ি বছরের শিঙ্গাটা পাওয়া যাচ্ছে না। অনেক খুঁজেও শিঙ্গাটা পাওয়া যায়নি... আমি এই সহজ-সরল অর্ধশতাব্দি পেরুনো শিশুবাউলকে কি সান্ত্বনা দেব? হায় রে...বাউলের শিঙ্গাও চুরি হয়ে যাবে মনবাউলের দেশে? বিমল দাকে বললাম, আরেকটা শিঙ্গা যোগাড় করা যায় না? বিমল দা বলেন, তা যায়। কিন্তু আমি আমার শিঙ্গাটাই খুঁজে বেড়াচ্ছি... দুই দশকের অধিক সময়ের সঙ্গী বিমল বাউলের শিঙ্গাটা দুই মাস আগে চুরি হয়ে গেছে।


এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.