পৃথিবীর প্রচন্ড প্রতাপশালী স্বৈরশাসকদেরও নরসুন্দরদের(নাপিত) কাছে মাথা নত করতে হয়। সে হিসেবে আমি সমাজে বিমল, পরিমলদেরই সর্ব্বোচ্চ ক্ষমতাধর মনে করি। বছর দুয়েক আগে ক্রসফায়ারে নিহত হওয়া আমাদের এলাকার এক শীর্ষ সন্ত্রাসীর অস্ত্র, বোমা, মারের ভয়ে শহর যখন ভয়ে অস্থির তখনও বিমল কি নির্ভয়ে তাকে সাইজ করেছে। পাশের সিটে বসে আমিতো অবশ্যই, এলাকাসহ সবাই কি হয়, কি হয় সে ভয়ে কেঁপেছে। সেই সন্ত্রাসীর মাথা এবং শরীর ম্যাসেজ করানোর অভ্যাস থাকলেও ম্যাসেজের ষ্টাইল দেখে অনায়াসে অনুধাবন করা গেছে বিমল তার কোনো পূর্বের ঝাল মিটিয়েছে।
আর সে বেচারা চেহারা বাকাটাকা করে সে মার হজম করেছে। কারন সে এটাকে ম্যাসেজ বলেই জানে।
সাইড থেকে যতই চ্যালা-চামুন্ডারা বলেছে, এই দেখিস ভাইয়ের যাতে না লাগে, এই ব্যাটা আস্তে দে।
বিমল নির্বাকার। সে জানে, এই লাইনেই কেবল নিউটনের তৃতীয় সূত্র অকার্যকর।
এখানে আঘাত করলে, সমান তো নয়-ই, কোনো প্রকার বিপরীত প্রতিক্রীয়া হবার চান্স নাই।
যে কাজ প্রশাসন পারে নাই, সে কাজ বিমলেরা পারে। প্রচলিত ভাষায়, প্রশাসন যেখানে সন্ত্রাসীর গায়ে ফুলের টোকা দিতে অক্ষম, সেখানে বিমল পরিমলেরা মাথা উচু করে দাঁড়ায় অ্যাকশন কিং হয়ে।
বারবার বিমল পরিমল নামটা ব্যাবহার করছি এই কারনে যে, আমি জানিনা কার অভিজ্ঞতা কী? কিন্তু আমার দেখা অধিকাংশ সাধারণ মানের সেলুনে বিমল, পরিমল বা এই নাম-গোত্রীয় নামের কেউ না কেউ থাকেন।
বহু জায়গায় খোঁজও নিয়ে দেখেছি।
সেলুনে সর্বাধিক পাঁচজন কারিগর থাকলে তার মধ্যে এক পিস বিমল, পরিমল বা এই নাম-গোত্রীয়ের কেউ আছে-ই।
আমি অবশ্য বিষয়টা নিয়ে দেশের বাইরেও খোঁজ চালিয়েছিলাম। আমেরিকা প্রবাসী আমার এক খালাতো বোনের স্বামীকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ভাই ওইদিকেও কী সেলুন'অলাদের নাম বিমল পরিমল হয় নাকি?
সে হেসে উড়িয়ে দিয়ে বলল, কি যে কও! তবে একটা জিনিস আমি দুই জায়গায় যাই যার প্রতিটিতে মিখাইল নামে একজন করে আছে। আমি বললাম, আমগো দেশের বিমলরাই তাইলে ওই দেশে মিখাইল।
আমার দুলাভাই কী বুঝলো কে জানে, যথেষ্ট বিশ্বাস নিয়ে মাথা নাড়ালো।
বিমল পরিমলদের এই সেলুন যতই 'সাইজের' হোক কিন্তু জায়গাটাই আকর্ষনীয়। এখানে নির্দ্ধিধায় মানুষ পার করে দেয় ঘন্টার পর ঘন্টা। আর যুবক বয়সীদের তো মোটামুটি তীর্থ বলা যায়। আয়না ধারণ করা এই সেলুনে তাকায় না এমন চোখ থাকা যুবক দেশে হাতে গোনা।
আমার দেখা দামী সেলুনগুলো নিরস আর প্রফেশনাল লাগলেও এই সব এলাকার সেলুনগুলো যথেষ্ট প্রাণময়।
এর কারিগরগুলোও বেশ প্রাণময় হয়। এলাকার সবার নাড়ী নক্ষত্র স্বভাব বৈশিষ্ট তাদের জানা। একবার শীতের সময় সেলুনে চুল কাটাচ্ছি হঠাৎ দেখলাম, কারিগরদের মধ্যে হুড়োহুড়ি পড়ে গেছে, এই কিরিম( ক্রিম) আর ভেজলিন( ভ্যাসলিন) সরা।
বুঝলাম না, কাহিনী কি?
পরক্ষনেই এক তরুণের আবির্ভাব, এ্যাই ক্রিমটা কইরে?
দুই দিক থেকে একসাথে জবাব, শ্যাষ হইয়া গেছে।
ওই ব্যাটা কাইলাকা না দেখলাম, আছে।
আইজ শ্যাষ হইয়া গেছে।
বুঝলাম সামর্ম। জিজ্ঞাসাও করতে হলোনা। ওই তরুণ চলে যেতেই আমার চুল কাটায় ব্যাস্ত থাকা কারিগরের বিরক্তিসূচক বয়ান, হালা বাড়ীততে গুসুল কইরা এইহানে আইসা ক্রিম মাহে।
আরেকবার দেখলাম এক পাতি ক্যাডার হুড়মুড় কইরা সেলুনে ঢুইকা ক্ষুর নিয়া দৌড়।
বুঝলাম গ্যাঞ্জাম। খারাপও লাগছে অল্প, না জানি কাকে, গায়ে ...!
কিছুক্ষণ পর দেখলাম, সে নিজেই নিজের গালে চেপে ক্ষুর ফেরত দিতে এসেছে। গালে রক্ত। দুএকজন তাকে ধরাধরি করে নিয়ে যাচ্ছে। এই কঠিন অবস্থায়ও হাসি চেপে রাখতে পারিনি, ভাইজান মারতে গিয়ে উল্টো মার খেয়ে এসেছে।
বহু মানুষের সাথে মিশতে মিশতে এই কারিগরদের রসিকতার ক্ষমতাও বেশ থাকে। একদিন এক পিচ্ছি এসেছে, চুল কাটতে চাই। আমার চুল কাটা বন্ধ করে পিচ্ছির দিকে তাকিয়ে বলল, বসো।
পিচ্ছি জানতে চাইলো, কত নেবেন?
১৫ টাকা।
বাসা থেকে শিখিয়ে দেয়া উপদেশ অনুযায়ী পিচ্ছির আবদার, কম রাখা যায়না?
সে জবাব দিল, না ভাইয়া, কম রাখা যায়না।
আমরা ১২ টাকা করে কিনেই আনি।
তবে সবচেয়ে মজা লাগে আমাদের শহরে কিছু মোবাইল সেলুন আছে যারা রাস্তার পাশে, রেললাইনে বসে প্রতিষ্ঠান চালায়। জীবিকা নির্বাহ করে। এদের কয়েকটি সেলুন মোটামুটি অবস্থিত রেললাইনের পাশে। সেখানে কোনো নর'কে সুন্দর করাকালীন হঠাৎ ট্রেনের বাঁশী পড়লে শুরু হয় হুড়োহুড়ি 'নর' এবং 'নরসুন্দরের' জীবন নিয়ে দৌড়।
সঙ্গে নিতে ভুলেনা আয়না, বালতিসহ আর যা যা আছে।
এই একটা জায়গায় নরসুন্দরদের আমি ভয় পেতে দেখি।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।