বুদ্ধিজীবী হতে ডিগ্রী লাগেনা। সবুজ ধানক্ষেতের বুক চিরে সোজা সামনের দিকে চলে গেছে পিচের রাস্তাটি। দূরে কালো কালো যে গ্রাম দেখা যাচ্ছে ওখানেই গিয়ে শেষ হয়েছে রাস্তা। আচ্ছা রাস্তার কি শেষ আছে? রাস্তার শেষ যেখানে সেখান থেকেই তো নতুন রাস্তার শুরু। উক্তিটি কোথায় যেন পড়েছে।
ঠিক কোথায় সেটা কিছুতেই মনে করতে পারছেনা লালন। খুব সম্ভবত বিভূতিভূষণের পথের পাঁচালীতে। অনেক দিন গল্প সাহিত্য আর পড়া হয়ে ওঠেনা। স্কুল কলেজে পড়ার সময় গল্পের বই পেলে সে গ্রোগ্রাসে গিলত। স্কুলে থাকার সময় অবশ্য মাসুদ রানা, টেনিদা সমগ্র তার প্রিয় ছিল।
কলেজে এসে শরত, বিভূতি তাকে নতুন দুনিয়ায় নিয়ে যায়। গ্রোগ্রাস মানে কি গরুর মত খাওয়া! তাহলে তো বানানটা হওয়া উচিত ছিল গোগ্রাস। লালন কনফিইউজড হয়ে গেল। গতকাল থেকে সে অনেক কনফিউশনে আছে। মাথাকে তাই আর প্রেশার দিল না।
বাসের সিটে হেলান দিল সে। চারপাশে শুধু সবুজ আর সবুজ। এইরকম কোন সিন দেখেই কবি লিখেছেন ও আমার দেশের মাটি তোমার পরে ঠেকাই মাথা। নিশ্চই মঙ্গা অঞ্চলের মাটি দেখে এই রকম সরেস গান লেখা হয় না। নাহ মাথা আবার ডিসকাশান শুরু করে দিয়েছে।
কিছুতেই কি সে চুপ করে বসে থাকতে পারে না।
পাশের সিটে শুভ্র ঘুমিয়ে ঘোগর টানছে। ভ্রমনের সময় মানুষ কিভাবে ঘুমায় এটা কিছুতেই লালনের মাথায় আস না। শুভ্র , লালনের জান-পরাণের দোস্ত। শুভ্র খুব আবেগী একটা ছেলে।
মা-বাবার একমাত্র ছেলে, তাই একটি বেশী আবেগের। বাবা-মা দুজনেই চাকরী করে। যখন যা চেয়েছে তাই পেয়ে গেছে। এজন্য সে অনেক সময় বাস্তবতা বুঝতে চায় না। এই যেমন মিতার সাথে শুভ্র’র প্রেম লালন মেনে নিতে পারে না।
সে শুভ্র কে অনেক বুঝিয়েছে। কোনই লাভ হয় নি।
মিতার সাথে শুভ্রই পরিচয় কিভাবে তা লালন দেখে নি কিন্তু শুনেছে। শুভ’র কাছেই এতবার শুনেছে যে চোখ বুঝলে সেটা স্পস্ট দেখতে পায়। এমন অনেক কিছুই আছে যা লালনের সামনে খুব স্পস্ট মনে হয় কিন্তু তা সে জীবনে দেখেনি।
যেমন তার মায়ের বিয়ের দিনের কথা। মায়ের কাছে এতবার শুনেছে যে তার মনে হয় সেও সেদিন সেখানে উপস্থিত ছিল। ঝড়-বাদলের রাত। কাদা ভেঙ্গে বরযাত্রীর দল লালনের নানা বাড়ীর ঊঠানে এসে দাড়িয়েছে। সবার পায়ে একহাটু কাঁদা।
নানাজান খুব ব্যস্ত হয়ে ছোটাছুটি করতে লাগলেন সবাইকে বসানোর জন্য। বৈঠক ঘরে সবার জায়গা হল না। এসব কিছুই লালনের দেখার কথা নয়। মায়ের মুখেই শোনা। তবে মজার ব্যাপার কি জান সে ২৮ বছর আগের এই ঘটনার দিনে তার বাবা মায়ের এখনকার চেহারাটা দেখতে পায়।
ঘটনাটা মনে এলে লালনের খুব হাসি পায়।
শুভ্র’র সাথে মিতালীর দেখা হয়েছিল ইডেন কলেজের সামনের রাস্তায়। প্রথম দেখাতেই শুভ্র মিতালীর প্রেমে পড়ে যায়। প্রথম দেখাতে প্রেম পড়ার মত এমন কোন বিশেষত্ব সে মিতালীর ভিতর দেখতে পায় না। দেখতে পেলে হয়তো সেও মিতালীর প্রেমে হাবুডুবু কিংবা ডুবুহাবু কিচছু একটা খেত।
তখন হয়তো গল্পকারকে ত্রিভুজ প্রেমের ষড়ভুজ কাহিনী লিখতে হত। মিতালী শুভ্রকে প্রথম প্রথম খুব একটা পাত্তা দিত না। লালন্র মাথায় আসত না এই সাধামাটা মেয়েটার কিসের এত অহঙ্গকার। এমনিতেই প্রেম ভালবাসা জিনিসটা তার মাথায় ঠিক মত আসে না। প্রেম ভালবাসা মানুষ কেন করে।
সেটা কি বিবাহের আগে জৈবিক তাড়না পূরণের জন্য নয়? পরে লালন বুঝতে পারে মিতালী মেয়েতা আসলেই অসাধারণ। তার বাস্তবজ্ঞান খুবই প্রখর। গরীব পরিবারের মেয়ে মিতালী জানত সে কিছুতেই শুভ্রর যোগ্য হতে পারেনা। তাই সে শুভ্রকে প্রতিনিয়ত এড়িয়ে চলত।
আর শুভর ভাল লাগত মিতালীর সারল্য।
কোন কিছুই সে গোপন করে না। মিতালীরা এমনিতেই গরীব ছিল। বাবা মারা যাওয়ার পর আরো গরীব হয়ে যায়। স্কুলের গনিত স্যারের বাসায় সে ঝিয়ের কাজ নেয়। তখন সে ক্লাস নাইনে পড়ে।
স্যারের মেয়ে পড়ত ক্লাস টেনে। কাজের ফাঁকে ফাঁকে সে স্যারের মেয়ের বই গুলো পড়ত। তার পড়াশুনার আগ্রহ দেখে স্যার তাকে স্কুলে পড়ার ব্যাবস্থ্যা করে দিলেন। স্যারেই বাড়িতে কাজ করেই এসএসসি পরীক্ষা দিল। কয়েকমাস পর রেজাল্ট বেরুল।
তার স্কুল থেকে সেই একমাত্র এ প্লাস পেয়েছে। স্যার তাকে কলেজে পড়ার ব্যাবস্থা করে দেন। আবারো একটা এ প্লাস। অনেক আশা নিয়ে এসেছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এডমিশান নেবে বলে। ওয়েটিং এ ছিল।
কিন্তু সে আর ডাক পেল না। অবশেষে ইডেন কলেজে ইংরেজিতে ভতি হল। টিউশনি করেই সে নিজের খরচ চালাত। এরি মধ্যে শুভ্র এসে জোটে তার জীবনে। শুভ্রকে সে ঠিক ভালবাসে কিনা বোঝা যায়না।
তবে সে শুভ্রকে বারবার বোঝানোর চেষ্টা করে যে তাদের বিয়ে কিছুতেই সম্ভব নয়।
গত সপ্তাহে মিতালী শুভ্রকে তাদের বাড়ি সাতক্ষীরায় নিমন্ত্রণ করে চিঠি দিয়েছে। আর সে জন্যই লালনকে শুভ্রই সাইডব্যাগ হয়ে আজ ছুটতে হচ্ছে সাতক্ষীরার সেই প্রত্যন্ত গ্রামে। মিতালীর প্লানটা শুভ্র’র কাছে ঠিক স্পষ্ট না। প্রথমে সে যেতে রাজি হয় নাই।
কিন্তু শুভ্র’র জোরাজুরিতে অবশেষে রাজী হতে হল।
রাস্তার অবস্থা এতই বেহাল যে তারা আর নিজেদের সামাল দিতে পারছে না। বাথায় শরীরের প্রতি জয়েণ্ট খুলে পড়তে চাইছে। বিকেলের একটু পরে তারা তিন চাকার ভ্যান গাড়িতে করে মিতালীদের বাড়ি পৌঁছে গেল। শেষ বিকেলের ম্লান আলোয় মিতালীদের বাড়ীটিকে বাংলা ক্লাসিক ম্যুভির বাড়ীগুলোর কথা মনে করিয়ে দিল লালনকে।
সাদামাটা বাড়ী। এক খান মাত্র ঘর। মাটির দেয়ালের উপর গোলপাতার ছাউনি। পেছনে দুটো নারিকেল গাছ। বারান্দায় এক খান চৌকি পাতা।
চৌকির উপরে মাদুর পাতা।
বারান্দার পাশ ঘেঁশে এক চালা গোয়াল ঘর। সেখানে একটা গরু বাধা। শুকনো খড় চিবুচ্ছে। লালনদের দিকে মুখ তুলে তাকাল সে একবার।
তারপর আপনমনে খড় চিবুতে লাগল। মিতালীর মা লালনদের সামনে এল না প্রথম। ঘর থেকেই সে ভালমন্দ জিজ্ঞেস করল। খুব বেশী কথা বলতে পারল না তারা। এরকম পরিবেশে মুরুব্বীদের সাথে কি কথা বলা উচিত তা তাদের মাথায় এল না।
মিতালী সেরকম কোন কথা বলছে না।
রাতে ডিম ভাজি আর তেলাপিয়া মাছের ঝোল দিয়ে ভাত খেল তারা। কেরসিনের বাতি জ্বলছে চোকির কোনায়। মাদুরে বসে তারা দুজন ভাত খাচ্ছে। লালনের কাছে ব্যাপারটা বেশ রোমান্টিক লাগছে।
রাতে তাদের দুজনকে ঘুমাতে হল সেই চোকিটার উপর। গরুর গন্ধ নাঁকে এসে ঝাপটা মারে। নরমালি তারা হাফপ্যান্ট পরে ঘুমায়। লুঙ্গির ধার ধারেনা। আজ ফুল প্যান্ট পরে শুয়ে পড়ল।
কিছুতেই ঘুম আসেনা। ভোরের দিকে ঘুমের ভাব এসেছে একটু আর অমনি পাখিরা কিচিরমিচির শুরু করে দিল। অন্যদিন হলে লালন মাথামাটাকে একটু ভাবনার সুযোগ করে দিত।
টয়লেটের ব্যবস্থা দেখে তারা দুজন আঁতকে উঠল। মাটি খুড়ে বানানো কাঁচা পায়খানা।
কাঠের উপর দুই পা রেখে বসতে হয়। নিচের দিকে তাকালে যা দেখা যায় তা ভেবে লালনের শরীর গুলিয়ে উঠল। কিন্তু ঘুম থেকে উঠে শুভ্র’র প্রথম কাজ হল কমোডে বসে দাত ব্রাশ করা। পুকুর থেকে বদনা ভরে পানি নিয়ে শুভ্র টয়লেটে গিয়ে বসল। প্লাস্টিকের বস্তা দিয়ে ঘিরে আড়াল করা হয়েছে।
কিন্তু সেটা এতটাই উঁচু যে শুভ্র’র মাথা দেখা যেতে লাগল। লালন পকেট থেকে মোবাইল বের করে টয়লেটে বসা শুভ্র’কে ভিডিও করতে লাগল। শুভ্র’র বিব্রত অবস্থা দেখে লালন বেশ মজা পাচ্ছে। টয়লেট থেকে ফিরে এসে শুভ্র দাঁতে দাঁত রেখে বলল। ভিডিওটা ডিলিট কর না হলে তোর মোবাইল সহ তোকে পুকুরে ছুঁড়ে ফেলব আজ।
শুভ্র রেগে গেছে। এতে রাগ করতে পারে এটা তো লালনের মাথায় ছিল না। একদিন শুভ্র’র রুমে শুভ্র আন্ডারওয়্যার পরে শুয়েছিল। লালন মজা করে শুভ্র’র ছবি তুলতে গেছে। শুভ্র আন্ডারওয়্যারে হাত রেখে হাসতে হাসতে বলল, পুরোটাই খুলে দেব? সেই শুভ্র আজ রেগে গেল!
দুজন মিলে গ্রাম দেখতে বেরুল।
শুভ্র গম্ভীর হয়ে আছে। লালন তাকে সহজ করার চেষ্টা করল। পকেট থেকে মোবাইল বের করে হাতে নিল। ভিডিওটি ডিলিট করতে যাবে। শুভ্র মোবাইল টা হাতে নিল।
বলল থাক , স্মৃতি হয়েই থাক। অনেকক্ষণ পর শুভ্র একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল, আচ্ছা দোস্ত বিয়েটা তো শুধু আমার জন্য নয়, আমার বাবা মাও তো আমার বিয়ে নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখে। আমি সেটাই ভাবছি। কোন দিকে যাওয়া উচিত আমার। কিছুতেই ভেবে পাচ্ছি না।
কাল রাতে তুই যখন আমাকে প্রশ্ন করলি, দোস্ত তোর বিয়েতে বরযাত্রী হয়ে বসব কোথায়। তখন থেকেই আমার মাথায় আরেকটি প্রশ্ন ঘুরছে। আমার বাবা মা তো এই বিয়ে মেনে নেবে না। কেন মেনে নেবে! না নিলে সেটা তাদের দোষ নয়। তাহলে?
লালন কি বলবে বুঝতে পারছে না।
সে শুভ্রর কাধে হাত রাখল, দোস্ত, সিদ্ধান্ত নেয়ার এখনো সময় আছে। ভেবে চিন্তে তোকেই ডিসিশান নিতে হবে। আবেগের পৃথিবীতে মানুষ খুব বেশীদিন থাকে না।
তারা সামনের দিকে তাকিয়ে আছে দুজন। বাস্তবতার পৃথিবীতে কুঁয়াশা ভেজা সবুজ ধানক্ষেত নিশ্চুপ দাঁড়ীয়ে আছে
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।