আমি লিখি মানুষের কথা,মানুষ পড়ে না। তারা হাসে। তাদের হাসির জন্যে আমি লিখি 'সবকিছু হাসির বিষয় নয়' তারা হাসে না! তবু আমি লিখব।
বিধবা হয়ে রাশদো ভেবেছিল,বাপ-ভাই দেখবে।
আরিফের লাশের সামনে রাশেদার দুই ভাই আয়াজ-রিয়াজের
বুক চাপড়ানি দেখে মহরমের মাতমজারির কথা মনে পড়ছিল অনেকের।
রাশেদার বাপ বুড়ো মানুষ। সে মেয়েদের সুরে তাল মিলিয়ে ইনিয়ে-
বিনিয়ে কাঁদছিল। তাই দেখে কাঁদতে না পারা অনেকেই ফিসফিস করছিল-এই না হলে বাপ ভাই!
আরিফের দাফন-কার্য সেরে দুই ছেলেকে নিয়ে নিজের গ্রামে ফিরছিল ইলিয়াস। মেঠো পথে হাঁটতে-হাঁটতে সে খুকখুক করে কেশে
বলল--কাল আমার সাথে রেজস্ট্রি অফিস চল তোরা।
--কেন ?
বড়ছেলে আয়াজের থমকে দাঁড়ানো কৌতুহল।
রাখাল ছেলেরা দাম-শেওলা ভরা পুকুরে লাফঝাঁপ খেলছে।
সেদিকে তাকিয়ে ইলিয়াস বলল--মরণজিয়ন গালের কথা লয়রে
বাপ,আমার জোতজমা সব তোদের দুজনের নামে লিখে দিব।
জমির আলে ঘাস খাওয়া থামিয়ে একটা গরু নাদছে,চোখ
সরিয়ে নিয়ে রিয়াজ বলল-তার আর দরকার কী,তোমার য-কিছু
আছে সব-ই তো আমরা দুই ভাই পাব।
--স্কুল-কলেজে পড়ে তোর এই বুদ্ধি ?চোখ রাঙিয়ে বলল
ইলিয়াস। তারপর থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে পড়া দুই ছেলের মুখোমুখি
দাঁড়িয়ে বলল--রাশেদা বেওয়া হয়েছে,আমি মরলেই বাপের
সম্পত্তির ভাগ দাবি করবে সে।
তাই তোদের সব লেখে দেব।
রেজস্ট্রি অফিস থেকে ফিরে ইলিয়াসের বাড়িতে যখন খানাপিনা
হৈ-হুল্লোড় চলছে,পাশের গ্রামে তার বিধবা মেয়ের ঘরে গুমরে
মরছে বাতাস।
আরিফের ছোটভাই তারিফ কলমিস্ত্রীর কাজ করে। প্রতি রাতে
সে মদ খেয়ে বাড়ি ফিরে বুক চাপড়ে কাঁদে--ওরে আমার সোনামুখো
ভাই-রে,কোথা গেলি ভাই-রে,আমাকে নিয়ে যা-রে।
আরিফের বড় ভাই শারিফ গরু-ছাগলের পাইকার।
হাট থেকে ফিরে
আরিফের ঘরে ঢোকে সে। দেওয়ালে ঝোলানো আরিফের প্যান্ট-শার্ট
পরা ফটোর দিকে তাকিয়ে হাপুস নয়নে কাঁদে--ওরে আমার সাহেবসুবো ভাই-রে, তোকে ছাড়া এই ঘর মানায় না -রে!
দুই ভাই কাঁদে আর হাত ধরাধরি করে আরিফের ঘরের
জিনিষপত্র বের করে নিজেদের ঘরে ঢোকায়। রাশেদা বারান্দায়
বসে জুগজুগ করে দেখে সব। তার মুখে কথা ফোটে না। গর্ভভারে
শরীর ভারি তার,শোকভারে বুক।
রাশেদার গর্ভে নড়াচড়া করছে আরিফের স্মৃতি,সত্তা। বিয়ের সাত বছর পর সন্তান। উচ্ছ্বসিত আরিফ আগন্তুকের ভবিষ্যত সুনিশ্চিত
করতে আরিফ ছুটেছিল মুম্বাই। সেখানেই কালব্যধি। হলুদ শরীর
নিয়ে বাড়ি ফিরছিল,কুলি চৌরাস্তায় লিভার ফেটে যায়।
তার দুই
সঙগী ট্রেকার ভাড়া করে লাশ নিয়ে আসে। আরিফের শেষ সফরের
সেই দুই সঙগী এখন প্রতি সন্ধ্যায় দরজায় হাঁক পাড়ে--কই-গো
শারিফ-তারিফ,একবার বাইরে এসো।
তারিফের ঘরে বেজে চলা আরিফের টেলিভিশন থেমে যায়।
বিরক্ত মুখে কব্জিতে বাঁধা আরিফের ঘড়ির রেডিয়াম-ছটা দেখতে
-দেখতে দরজা খোলে শারিফ। হাসিমুখে বলে--সেই ট্রেকারের
ভাড়া নিবা তো,এসো ভেতরে এসো।
পাওনাদার দেখলেই বুক কাঁপে রাশেদার। তার গহনাগুলো চুড়ি
ভাঙার সময় কে খুলে নিয়েছে মনে নেই। বলে--একবার আব্বার
কাছে যাই,আমার সব দেনা তিনি শোধ করে দেবেন।
কথা বলতে গিয়ে জ্বিভে তোতলা ধরে তার। হাঁটতে গিয়ে পা টলে।
একিদন কলতলায় পড়ে গর্ভপাত হয়ে গেল তার।
হাসপাতাল থেকে তাকে নিজের বাড়িতে নিয়ে আসে ইলিয়াস।
আরিফের দুই-ভাইয়ের সঙেগ তার প্রচণ্ড ঝগড়া। তারা শেষ যুক্তি
দেখিয়েছে,আরিফের কাফন-দাফনের সব খরচা আমরা করেছি,
তাই তার ভিটে মাটিতে ছুঁচ পরিমান অধিকার নেই রাশেদার।
অসুস্থ রাশেদার উপস্থিতিতে কলবল করে আয়াজ-রিয়াজের
বউ।
পাওনাদারদের আসা-যাওয়ায় বাড়ি কাদা। একজন প্রস্তাব
দিয়েছে,আমাদের যে-কোন একজনের সঙগে রাশেদার নিকাহ দেন,
সব পাওনা মকুব।
ইলিয়াসের সফেদ দাড়ি নড়ে। চোখের তারায় ঝলসানি। বেওয়া হলেও
রুপসী মেয়ের দাম থাকে সংসারে।
একের পর এক প্রস্তাব আসে। বাড়ে ইলিয়াসের লোভ। বলে --
বিনা পণে বিয়ে দিলাম,বেওয়া হয়ে ফিরল খালি হাতে। এবার দেন-
মোহর নেব। সব চেয়ে যে বেশি টাকা দেবে,আমার মেয়ে তার।
সেদিন মুখ-আঁধারী বেলায় একজন প্যান্ট-শার্ট-চশমা পরা তরুন
এসে হাজির। বলল-আরিফ আমার বন্ধু ছিল। আমি তার স্ত্রীর সঙেগ
কথা বলতে চাই।
--কত টাকা পান?ইলিয়াসের হিসেবি কৌতুহল।
--আরিফের-ই কিছু পাওনা আছে আমার কাছে।
আমি বোম্বায়ে
থাকি,কাল রাতে বাড়ি ফিরে শুনলাম,তাই ছুটে এসেছি।
দলিজ-ঘরে তাকে খাতির করে বসাল ইলিয়াস। বলল-তোমার নাম,মানে কী বলব রাশদোকে।
--বলবেন,পুব-পাড়ার রফি এসেছে।
গনগনে উনুনের মত মুখ নিয়ে রফির সামনে দাঁড়াল রাশেদা।
বলল-টাকা নেব না,আপনি আমার মানুষটাকে ফিরিয়ে দেন।
বোম্বাই-এ খাটলে লাখপতি হওয়া যায়,এই লোভ দেখিয়ে ওকে আপনি নিয়ে গেছিলেন।
রফি নিরব। রাশেদার মর্মবেদনা উপলব্ধি করে সে। বছর খানেক হল
বিপত্নীক হয়েছে সে।
দু-বছরের মেয়েকে তার নানার বাড়িতে রেখে
মুম্বাই গেছিল সে। ফিরেছে অনেক টাকা,এক বুক আশা নিয়ে। ফিরে
দেখল,মা-মরা মেয়েটি কঙ্কাল সার। ছোট শালী রঙিলা। হাইস্কুলে
পড়ে।
দেখতে ভাল। কথায় ও কাজে চটপটে। সংসারী। তার দায়িত্ব
নিলে,সে নিশ্চয় মা-মরা মেযেটির দায়িত্ব নেবে। সব ওলট-পালট
হয়ে যাচ্ছে রাশেদার অভিযোগে।
দাড়িতে আঙুল চালিয়ে ইলিয়াস বলল--বাদ দে মা ওসব কথা
বাদ দে। কই বাপ দাও তো দেখি টাকাটা।
--না,নেব না টাকা,আমি মানুষটাকে চাই। ঝাঁজের গলায় বলল
রাশেদা।
--শুনুন ভাবি,আরিফকে নিয়ে গেছিলাম ঠিক-ই,কাজও ধরিয়ে
দিয়েছি।
ডাক্তার দেখিয়েছি,অবহেলা করিনি। সে যখন বাড়ি ফেরার
জেদ ধরল,শেঠের কাছ থেকে দু-হাজার টাকা এনে দিয়েছি। পরে
শেঠের কাছে হিসাব মোকাবিলা করে আজ ওর পাওনা দু-হাজার
টাকা দিতে এসেছি।
রাশেদার ওসব শোনার মানসিকতা নেই,সে একনাগাড়ে বলে চলেছে
--আমার টাকা চাই না,স্বামী চাই,সংসার চাই,সন্তান চাই।
--তবে যে ওরা বলছে,আরিফের পকেটে কিছু ছিল না,ওরা খরচা করে লাশ এনেছে?ইলিয়াসের কৌতুহল।
--মিছে কথা,,আমি আরিফের টিকিট
কেটে,ট্রেনে চড়িয়ে ওদের হাতে তিন হাজার টাকা গুনে দিয়েছি।
আমার সামনে মিছে বলার সাহস ওদের হবে না।
রাশেদা চোখ পাকিয়ে বলল--আমার হবে,আমি বলব,তুমিই আমার স্বামী-সংসার-সন্তান সব কেড়ে নিয়েছো,ফেরৎ দাও।
রাশেদার চিৎকারে মাথায় আগুন জ্বলে গেল রফির। রাশেদার বাহুমূল
ধরে টান মেরে বলল--চল,আমার ঘরই তোমার সংসার হবে আজ
থেকে।
রাশেদা কাঁপছে। ইলিয়াস বলল--ওসমানপুরের সোলেমান হাজি
দশ হাজার টাকা দেনমোহর দেবে বলেছে।
--আমি বিশ হাজার দেব। কন্ঠস্বরের মত কাঁপছে রফির শরীরও।
--কেন টাকা দেবেন আপনি,বাপ আমার টাকা নিয়ে ব্যাঙ্কে জমাবে
ভাইদের নামে।
ওদের সংসারে আমি কাঁটা হয়ে থাকব না,আমি
সংসার চাই...বলতে -বলতে সজল হয়ে উঠল রাশেদার চোখ।
রফির হাত ধরে মেঠো পথে হাঁটছে রাশেদা। রফির ভাঙাচোরা
আগাছা-লাঞ্ছি ত বাড়িটি তাকে যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে। ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।