কিছুটা আমার কিছুটা তোমার.. মেলেনা তো কিছু এখন আর! তোমার কাছ থেকে কিছু শুনার আশা করছিনা,শুধু বললাম..''কথাটা শুনে মনে মনে কিছুটা অবাক হলো মাহির। কিন্তু প্রকাশ করল না,চুপ করে রইল,আসলে ওর কিছু বলার নেই উত্তরে। আর আজ ও তেমন কিছু বলতে বা শুনতে আসেনি,স্রেফ ওর সিদ্ধান্তের কথাটা মিমিকে জানাতে এসেছিল,কিন্তু কিছুই বলতে পারল না। অনেকক্ষন হয়ে গেল,মিমি আর কিছু বলছে না,মাহির মাথা নিচু অবস্থাতেই দেখতে পেল,মিমির দৃষ্টি অনেক অনেক দূরে..। মাহির জানে মিমি নিজেকে কন্ট্রোল করার চেষ্টা করছে,যত কিছুই হোক এখন আর মাহিরের সামনে ও নিজেকে প্রকাশ করবে না।
আরও কিছুক্ষন পর হঠাৎ উঠে দাড়াল মিমি,ব্যাগ টা হাতে নিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে বলল,
--আমি আসি,আর কিছু বলতে ইচ্ছে করছেনা আমার,আর বলেই কি হবে,কিছুই হবে না,ঠিক আছে ভালো থেকো..আমি আসি,আল্লাহ হাফেজ।
মাহির অনেকক্ষন মিমির চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইল,মিমি চলে গেল,মাহির জানে মিমি একবারও আর পিছনে ফিরে তাকাবেনা..আর মাহির ও ডাকবে না,তবে দুই বছর খুব কম সময় না..
মেডিকেল জীবনের প্রায় তিন বছর ধরে মিমিকে দেখছে মাহির,প্রচন্ড ব্যাস্ত একটা মেয়ে হিসেবে ওকে সবাই চিনে,ক্লাসের কয়েক মিনিট আগে আসবে আর ক্লাস শেষে বাতাসের মতো দৌড়ে চলে যাবে,অনেকবার নানা অজুহাতে মাহির ওর সাথে কথা বলতে চেষ্টা করেছে কিন্তু মিমির খেয়াল করার সময় কই..!মিমির ব্যাচের সবাই বলতো,নিশ্চয়ই এই মেয়ে অনেক ছেলের সাথে প্রেম করে আর না হলে ভাব দেখায়!''খুব সাধারন ভাবেই মিমি চলত আর সব সময় হাসি মুখে থাকতো,কিন্তু কারো সাথে সেভাবে আড্ডা বা গল্প করতে ওকে দেখা যেত না। আর সবার মতো মাহির ও এমনই ভেবেছে কিন্তু যখনই মিমিকে দেখতো কেন জানি মিমিকে সবার থেকে আলাদা মনে হতো,মিমির চোখ দেখেই মাহির অবাক হয়ে যেত..এতো মায়া কেন ওর চোখে..?..
অনেক দিন পর চাচীর বাসায় বেড়াতে আসে মাহির,সময়ের অভাবে আসা হয় না,কিন্তু চাচা অসূস্থ তাই বাবার সাথে দেখতে আসা,চাচার সাথে কথা বলে চাচাত ভাই আকিফের সাথে দেখা করার জন্য ওর রুমে ঢুকে মাহির,ঢুকেই খুব অবাক হয়ে যায়!
মিমি!!!কিন্তু মিমি খুব একটা অবাক হয় না,তাড়াতাড়ি আকিফকে পড়ানো শেষ করে তারপর বেরিয়ে যাবার সময়,একবার মাহিরকে জিজ্ঞেস করে,''ভালো আছেন?আপনি এখানে?''মাহির জবাব দেয়,
--হুম ভালো আছি,এটা আমার চাচার বাসা।
--ওহ,আচ্ছা ঠিক আছে আসি,আল্লাহ হাফেজ।
মাহির বেশ অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে,আকিফের খুব ভালো টিচারের যে গল্প এতদিন আকিফের মুখে সে শুনেছে এই তাহলে সেই টিচার!যাক,তাহলে মিমিকে সে চিনতে ভুল করেনি..
অনেক ভেবে চিন্তে কোন উপায় না পেয়ে গত ২বছর ধরে বন্ধুদের দেয়া বুদ্ধি মতোই মিমিকে পটানোর চেষ্টা শুরু করছে মাহির,প্রথমে আগ বাড়িয়ে হেল্প করা,তারপর বন্ধুত্ব ইত্যাদি ইত্যাদি..তবে গত দুই বছরে মাহির বুঝেছে মিমি নিজেকে খুব আড়ালে রাখতে চায়,কারো সাথেই তেমন গভীর সম্পর্ক করতে চায় না,এমনকি মাহিরকেও অনেক এভোয়েড করে কিন্ত কেন তা বুঝেনা মাহির!মিমির ভেতর খুব সরলতা দেখতে পায় ঠিকই কিন্তু সবার সাথে একটা দুরত্ব কেন রাখে তা বুঝে না।
হঠাৎ কাল মিমি নিজে থেকেই বলল,
--তোমার সাথে কিছু কথা আছে,একটু সময় দিও।
মাহির খুব অবাক হয়ে শেষ বিকেলে,লেকের পাড়ে মিমির সাথে বসে,লেকের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে একা একাই মিমি বলে যায়..
--তোমাকে আমি কখনো আমার বাসা সম্পর্কে কিচু বলিনি,শুধু তোমাকেই না,আমি তেমন কাউকেই বলিনা,কিন্তু মনে হচ্ছে বলা দরকার,আমরা তিন বোন,আমার আপুর বিয়ে হয়েছিল কিন্তু বিয়ের দু'বছরের মাথায় ওর স্বামী আরেকটা মেয়েকে বিয়ে করে তারপর থেকে ও আমাদের সাথেই থাকে,একটা স্কুলে চাকরী করে,২বছর বয়সি একটা ছেলে আছে,আমার ছোট বোন স্কুলে পড়ে,আর আমি একটা কোচিং এ ক্লাস নেই আর একটা টিউশনি করি,আমার মা একটা সরকারী অফিসে খুব সামান্য একটা পোষ্টে চাকরী করেন..এই হলো আমার পরিবার
--আর তোমার বাবা?
লেকের পানিতে একটা ঢিল ছুঁড়ে মিমি,তারপর বলে
--বাবা,আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন অনেক বছর আগে,পর পর তিন মেয়ে জন্ম দেয়াই ছিল আমার মায়ের অপরাধ!কখনো খবর নেননি তিনি আমাদের,আমরাও ভুলে গেছি তার কথা।
মাহির কিছুক্ষন চুপ করে থাকে,কি বলবে ঠিক বুঝতে পারেনা,ওকে চুপ থাকতে দেখে মিমিই আবার বলে উঠে,
--কথাগুলো আমি এভাবে কেন তোমাকে বললাম,তা নিশ্চয়ই তুমি বুঝতে পারছ,আমি চাইনা কোনদিন তুমি আমাকে বলে বস,''ভালোবাসি'',তুমি উচ্চমধ্যবিত্ত ঘরের বুদ্ধিমান ছেলে জীবনের এমন একটা বিষয়ে বোকার মতো কোন সিদ্ধান্ত নিও না,আমার সাথে তোমার বন্ধুত্ব ছাড়া আর কোন কিছুই সম্ভব নয়। আমি জানি আমি কেমন অবস্থানে বসবাস করি আর তাই সবাইকে একটু এড়িয়ে চলি,কারন সবাই বুঝার ভান করতে পারে কিন্তু বুঝতে পারেনা,তবে তুমি ডিফরেন্ট মানুষ,তোমার মাঝে অন্যদের মতো বাহ্যিক দেখার চোখ নেই,অন্তর দিয়ে দেখার চোখ আছে,যাই হোক,আমার ব্যাপারটা নিয়ে আর ভেবনা,আমাকে আমার মতো থাকতে দাও। ''
মাহির কেন জানি কিছু বলতে চেয়েও বলতে পারেনা,অনেক কথাই মনের মধ্যে ঘুরছে,কিন্তু মুখে আসছেনা,সময় চলে যাচ্ছে,মিমি উঠে দাঁড়ায় তারপর চলে যায়..
প্রায় একমাস ধরে মাহির ভাবছে,এর মধ্যে মিমির সাথে কয়েক বার দেখা হয়েছে কিন্তু কথা হয়নি,প্রফ পরিক্ষা নিয়ে খুব ব্যাস্ত সে।
মাহিরের বাবা-মা দুইজনই অনেক গুলো সামাজিক সংঠনের সাথে জড়িত,বাবা-মাকে অনেক উদার মনের মানুষ হিসেবেই দেখে আসছে মাহির,কাউকে ছোট বড় হিসেব করে কথা বলতে দেখেনি কিন্তু তারপরেও মিমির ব্যাপারটা বলতে সাহস পাচ্ছে না,শত হলেও নিজের বাবা-মা,অন্যের জন্য হাজার করলেও নিজের সন্তানের বেলা এমন পরিবারের মেয়েকে মানবেন বলে মনে হয় না। তারপরেও মাহির নিজের কথা ভেবে মায়ের সাথে এ ব্যাপারে কথা বলার সিদ্ধান্ত নেয়। ছোট বোনের সাথে ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা করে,সেও একই কথা বলে,
--ভাইয়া মেয়ে হিসেবে মিমি আপু খারাপ না,অনেক অনেক ভালো মেয়ে,কিন্তু আমাদের সমাজের মানুষগুলোকে তো চিনই,কথা শুনাতে ছাড়বেনা,বাবা-মা,আত্নীয়-স্বজন সবাই না করবে।
কিন্তু মাহির কি করবে?মিমিকে ছাড়া অন্য কাউকে নিয়ে সে ভাবতে পারবে না,আর সবচেয়ে বড় কথা হল,মিমির পরিবারের এই অবস্থার জন্য তো মিমি দায়ী না,তাহলে তার সমাজের মানুষ কেন মিমিকে বিয়ে করলে কথা শুনাবে?..
অনেক ভেবে চিন্তে শেষমেষ চাচীর কাছে সব খুলে বলল মাহির। চাচী খুব অবাক হলেন সব শুনে,তারপর অনেক ভেবে মাহিরের মায়ের সাথে কথা বলার জন্য রাজী হলেন।
মিমিকে তিনি অনেক বছর ধরেই চিনেন,খুব ভালো এবং ব্যাক্তিত্ব সম্পন্ন মেয়ে। ওর মা আর বোনেরাও খুব ভালো,অবস্থা খারাপ হলেও নিজেদের সম্মান এরা ঠিকই ধরে রেখেছে।
মাহির হাসপাতাল থেকে বাসায় এসে দেখে বাসার অবস্থা বেশ থমথমে। মনে হচ্ছে কারফিউ চলছে,রুমে ঢুকার আগে ছোট বোনের ইশারা থেকে যতটুকু বুঝলো,মিমির ব্যাপারটা নিয়ে বাবা-মা খুব আপসেট। রাতে মা ডেকে পাঠালেন তাদের রুমে।
মাহির বুঝতে পারছেনা,কি বলবে?অনেকক্ষন ধরে বসে আছে কিন্তু কেউ কিছু বলছেনা,একট পর বাবা কথা বলে উঠলেন,
--কয়েকদিন আগে তোমার চাচীর কাছ থেকে তোমার কথা শুনেছি আমরা,ব্যাপারটা নিয়ে আমরা সবাই অনেক ভেবেছি,অনেক বছর থেকেই আমার কেন জানি মনে হতো,আমি নিজে যে মত বিশ্বাস করি আমার সন্তানও কি তা বিশ্বাস করবে?নাকি নিজেদের কে অন্যদের মতো সময়ের সাথে বিলিয়ে দিবে?আমার রেখে যাওয়া কাজ সমাপ্ত করার মানসিকতা তাদের থাকবে তো নাকি আমার রেখে যাওয়া প্রাচুর্যের মাঝেই আমার অস্তিত্ব খুঁজবে শুধু?আমি কখনো এই আশা করিনি আমার ছেলে মেয়েকে অনেক বড় ঘরে বিয়ে দিব,আশা করেছি একটা সত্যিকারের ভালো মানুসিকতা সম্পন্ন পরিবারে আত্নীয়তা করব,সারা জীবন নিজে যেভাবে চলেছি আমার সন্তানও সেভাবেই চলবে আশা করব,মাহির,আমি কি বলছি তা তুমি বুঝতে পারছ নিশ্চয়ই?''
মাহির অবাক হয়ে মাথা নাড়ে..মাহিরের মা উঠে এসে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে,
--সব সময় মনে রাখবে,মানুষকে দুই চোখ দিয়ে দেখে তার গুন বিচার করা যায় না,মনের চোখ দিয়ে দেখতে হয়,মানুষের সাথে সম্পর্ক করতে হয় আন্তরিকতা দিয়ে। তাহলেই সত্যিকারের মানুষ খুঁজে পাবে। এবার যাও,আমরা মিমির পরিবারের সাথে কথা বলছি। ''
স্বপ্নগুলো অবশেষে সত্যি হয় দু'জনের। সময়ের হাত ধরেই ভালোবাসা আর কিছু সুন্দর স্বপ্ন দিয়ে নিজেদের চলা শুরু করে মাহির আর মিমি...
[আমার একটা ধারনা ছিল,এখনকার সমাজ সেবক নামের মানুষ গুলো কখনো নিজেরা অন্যের জন্য ভালো উদাহরন হতে পারেনা,কিন্তু মাহির ভাইদের পরিবারকে দেখে সে ধারনা ভেঙ্গে গেছে..]
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।