আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গণতন্ত্রের দূর্বলতায় সেনা অভ্যুত্থান ঘটে

সত্য সন্ধানে সর্বদা নির্ভিক বিশ্বের যে সব দেশে সেনা অভ্যুত্থান ঘটেছে বা সামরিক শাসন এসেছে সে সব রাষ্ট্রের দিকে তাকালে দেখা যায় দীর্ঘ দিন গণতন্ত্র চর্চা না থাকার কারণেই এমনটি ঘটেছে। বিশ্বের ইতিহাসে সর্বাধিক সংখ্যক বার সেনা শাসন এসেছে পাকিস্তানে। কিন্তু স্বাধীনতার ৬৫ বছরে পাকিস্তানে গণতন্ত্রের চর্চায় হয়ে এসেছে। সে সত্ত্বেও এই রাষ্ট্রটি সেনা শাসক দ্বারা পরিচালিত হয়েছে বেশির ভাগ সময়। তবে স্বাধীনতার ৪০ বছরে বাংলাদেশেও কম সংখ্যকবার সেনা শাসন আসেনি।

স্বাধীনতা পাওয়ার চার বছরের মাথায় সেনা অভ্যুত্থান সংঘটিত হয় বাংলাদেশে। আর সেই অভ্যুত্থানে স্বপরিবারে নিহত হন শেখ মুজিবর রহমান। এই সেনা অভ্যুত্থানটি পরিচালিত হয় কিছু বহিস্কৃত সেনা কর্মকর্তাদের নেতৃত্বে। তবে এই সেনা অভ্যুত্থানটিকে প্রত্যক্ষভাবে না হলেও পরোক্ষ ভাবে সমর্থন দিয়েছিলেন তৎকালিন সেনা প্রধান জেনারেল শফিউল্লাহ ও জাসসের অন্যতম স্বপ্নদ্রষ্টা কর্ণেল আবু তাহের। কারণ সেসময় বঙ্গবন্ধুকে হত্যার যে ষড়যন্ত্র হয়েছিল তার সাথে জাসসের একটি সম্পর্ক ছিল।

আর বর্তমান আওয়ামী লীগ নেতা জেনারেল শফি উল্লাহ বাংলাদেশের ইতিহাসে একজন কাপুরুষ সেনা প্রধান হিসেবে নিজের পরিচয় দিয়েছিলেন। আসল কথাটি হল কেন ঘটেছিল এই সেনা অভ্যুত্থান। একটু বিশ্লেষন করলে দেখা যাবে বঙ্গবন্ধুর সরকার ১৯৭০ সালের একটি গণতান্ত্রিক নির্বাচনের মাধ্যমে আসলেও ক্ষমতায় থাকাকালিন সময় গণতন্ত্রকে অগ্রাহ্য করেছিলেন। যুদ্ধ বিধ্বস্ত একটি স্বাধীন রাষ্ট্রকে পূনর্গঠনের জন্য দেশের সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহন প্রয়োজন ছিল কিন্তু মুজিব সরকারে এই বিষয়টির কোন নাম গন্ধও ছিলনা। মজার বিষয় হল ৭০ এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বড় ধরণের সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ায় স্বাধীনতার পর তাদের কোন রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল না।

সে সময় দেশের সার্বিক উন্নয়নের জন্য জাসদ নেতা সিরাজ শিকদার বঙ্গবন্ধুকে একটি চিঠিও লিখেছিলেন। তখন সিরাজ শিকদার, কর্ণেল তাহের, হাসানুল হক ইনুর মতো নেতারা উপলব্ধি করেছিলেন দেশের একটি নির্বাচিত সরকার থাকলেও প্রকৃত গণতন্ত্র ছিল না। আর যেকারণে জাসদ তখন চরমপন্থিতার পথ বেছে নেয়। বঙ্গবন্ধুর জীবদ্দশায় জাসদ কোন রাজনৈতিক দল হিসেবে স্বীকৃতি না পেলেও এই দলটিকে বঙ্গবন্ধু তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিরোধী দল হিসেবেই নিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে রাজনৈতিক দলের কোন প্রকার কর্মকান্ড আওয়ামী লীগ সরকার মেনে নিতে পারেনি ফলে সেসময় জনগণের হয়ে কথা বলার মতো কোন শক্তিরও বৈধতা পায়নি।

আর যখন একটি ক্ষমতাসীন দলের অনিয়ন্ত্রিত কাজের বিরুদ্ধে কথা বলার জন্য কোন গণতান্ত্রিক শক্তি না থাকে তখনই তৃতীয় একটি শক্তি অভ্যুত্থান ঘটানোর মতো শাসক ও সমর্থন পেয়ে যায়। যেমনটি ঘটেছিল ৭৫ এর ১৫ আগষ্ট থেকে ৭ নভেম্বর। নভেম্বর মাসে দেশ পরিচালনার ক্ষমতাটি চলে যায় সেনা বাহিনীর হাতে। আর এই সময়ের মধ্য সেনা বাহিনীতে ঘটতে থাকে অভ্যুত্থান পাল্টা অভ্যুত্থান। আর সেনা বাহিনীর এই অনিয়ন্ত্রিত কর্মকান্ডকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য জনগণের কোন শক্তি সে সময় বাংলাদেশে ছিল না।

তবে সেনা শাসক হওয়া সত্ত্বেও একটা জায়গায় আমি জিয়াউর রহমানকে সমর্থন দিই আর সে জায়গাটা হল গণতন্ত্র চর্চার ব্যবস্থা করে দেয়া। লোক মুখে শোনা যাই জিয়া সর্বদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করলেও দলগুলো শক্তিশালী হতে দেয়নি। পরবর্তীতে তিনি নিজে রাজনৈতিক দল গঠন করে নিজের সৈরশাসনকে বৈধ করেন। কিন্তু সমস্যা হল অন্যান্য নামমাত্র রাজনৈতিক দলগুলোকে প্রকৃত গণতন্ত্র চর্চা করতে না দেয়ার কারণে আরও একটি সেনা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তাকে জীবন দিতে হয়। এরপর দেশে চলে টানা ১০ বছরের সেনা শাসন।

জেনারেল এরশাদ তার স্বৈরশাসনকে টিকিয়ে রাখতে গণ আন্দোলনগুলোকে দমন করেছে নগ্ন ভাবে। ফলে ডা. মিলন, নূর হোসেন ও জিহাদের মতো মুক্তিকামী মানুষকে জীবন দিতে হয়। অবশেষে গণতন্ত্রপ্রেমী জনগণ সেনা অভ্যুত্থান নয় গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে এরশাদের পতন ঘটায়। এরপর বাংলাদেশে গনতন্ত্র আক্ষরিক প্রতিষ্ঠা লাভ করে। বলা যায় তথাকথিত গণতন্ত্র।

কারণ প্রতিষ্ঠা পাওয়ার ৫ বছরের মাথায় একটি গণতান্ত্রিক সরকারের প্রতি অন্য সকল গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল অনাস্থা প্রকাশ করে সংসদ থেকে পদত্যাগ করে। ফলে দেশে বৈধতা পায় ৯০ দিনের একটি অগনতান্ত্রিক সরকার। আর এই ব্যবস্থা মাত্র দুই বার আসলেও তৃতীয় বারে ঘটে বিপত্তি আর তখন জনগণের শক্তির মধ্যে অনৈক্য ও দূর্বলতাকে পুজিকরে ক্ষমতায় আসে একটি অঘোষিত সেনা শাসন। এই সেনা সরকারকে বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকার সমর্থনও দিয়েছিল সে সময়। পরবর্তীতে ফলাফল যা হওয়ার তাই হল।

সময়টা ১/১১ ২০০৬ কিন্তু এখন ২০১২ অজানা/অজানা কিছু একটা ঘটার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে বা সে পরিবেশ সৃষ্টি করে দেয়া হয়েছে। বর্তমান গণতান্ত্রিক সরকারের শাসন ব্যবস্থায় নাম মাত্র গণতন্ত্রের গন্ধ নেয়। বিরোধী দল ও সরকার বিরোধী শক্তিকে ( গণমাধ্যম, শ্রমিক শ্রেণী) দমন করছে নগ্নভাবে। অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক জবাবদিহিতা সরকারের কাছে নেয় বললেই চলে। সরকার বিরোধী আলোচনা যতটুকু চলছে তাও টকশো ও বল্গ কেন্দ্রিক।

মাঠে নামার কোন সুযোগই দেয়া হচ্ছেনা। জনগণের সমর্থিত অন্যান্য রাজনৈতিক দল পিঠ বাঁচাতে সর্বদা পিছ পা হচ্ছে। এমন সময় তৃতীয় কোন শক্তি অভ্যুত্থান ঘটালে তা হয়তো ১/১১ এর আওয়ামী লীগের মতো অন্য কোন রাজনৈতিক দলও সমর্থন দিয়ে দিবে। আর তা হবে দেশের জন্য দীর্ঘস্থায়ী স্বৈরশাসনের একটি বন্দোবস্ত। কেন এই গণতন্ত্রের দূর্বলতা : একটু চিন্তা করলে দেখা যাবে গণতন্ত্রের এই দূর্বলতা বা অনুপস্থিতিতার কারণ বাংলাদেশের তথা কথিত গণতান্ত্রিক রাজনীতি ব্যবস্থা।

ব্যক্তি কেন্দ্রিক রাজনৈতিক দল, উত্তরাধিকার সুত্রে পাওয়া ক্ষমতায় এই গণতান্ত্রিক দূর্বলতার কারণ। দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল এখন দেশের বৃহৎ আর্থিক প্রতিষ্ঠানে রূপ নিয়েছে। দল দুটি জনগণের সম্পত্তি না হয়ে দুটো পরিবারের সম্পত্তিতে পরিণত হয়েছে। হ্যা, একই পরিবারের থেকে রাজনৈতিক দল পরিচালনা হতেই পারে তবে তা হতে হবে গণতান্ত্রিক পন্থায়। দলের প্রধানের কথা বাদ দিলাম, দল পরিচালনার জন্য গঠিত কমিটির দিকে তাকালে দেখা যাবে বেশির ভাগ নেতাই জনগণের নেতা নয়।

কেউ সামরিক কর্মকর্তা, কেউ ব্যাংকার, কেউ বিদেশি দালাল, কেউ বা বড় ব্যবসায়ী ( শ্রমিক শোষক)। এদের কারও অতীত ইতিহাস জনগণের কথা বলে না। আগেই বলেছি দলদুটো হচ্ছে দুটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান। এখানে যারা বড় অংকে ডোনেশন দিতে পারবে তারাই বড় নেতা হবে। আর সংসদ নির্বাচনের ক্ষেত্রে দেখা যায় আসল খেলা।

চেনা নাই জানা নাই এমন সব প্রার্থীদের মনোনয়ন দেয়া হয় যাদের কেউই তৃণমূল রাজনীতির সাথে যুক্ত নয়। তবে মজার বিষয় হল এসব প্রার্থীদের দুটো যোগ্যতাকে বেশি প্রাধন্য দেয়া হয়। একটি হল টাকা অন্যটি পেশি শক্তি। যে বেশি টাকা দিবে সে হবে প্রার্থী আর ক্ষমতায় গেলে মন্ত্রী। অনুরুপ যে বেশি প্রতিপক্ষের হাত পা ভাঙতে পারবে সেও এমপি মন্ত্রী।

যে কারণ সংসদ সদ্স্যদের দ্বারা সাংবাদিকের হাত-পা ভাঙা, নিজের দলের নেতা-কর্মীকে হত্যার করার ( পরবর্তীতে সাক্ষি হওয়া) অভিযোগ উঠছে। বিষয়টি এমন দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশের এই দুটি রাজনৈতিক দল চাইলে ছাগল-পাগল, কচুগাছ-কলাগাছকে প্রার্থীতা দিতে পারে। আর আরও মজার বিষয় হল জনগণও চোখ বুজে তাদের ভোট দিবে। কারণ আমরা পরিবর্তন চাই তা যদি হয় কোন সন্ত্রাসীর হাতে কিংবা কোন পাগলের হাতে তবে তা চেষ্টা করতে দোষ নেই। হয়তো অনেক সংসদ সদস্য আমার এমন কথাকে সমর্থন দিবেন না।

কারণ তারা বলবেন তারা জনগণের সমর্থিত (ভোটে নির্বাচিত) এমপি। আমিও স্বীকার করি তারা জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত এমপি কিন্তু জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত প্রার্থী নন। আর এই জায়গাটায় হচ্ছে গণতন্ত্রের দূর্বলতা। আর এই দূর্বলতাকে যত দিন না শক্তিশালী করা যাবে ততোদিন এদেশে সামরিক শাসন আসার সম্ভবনা জেগে থাকবে। রাষ্ট্র পরিচালনা যতদিন না জনগণের হাত যাবে ততো দিনই অভ্যুত্থান, ব্যর্থ অভ্যুত্থান, পাল্টা অভ্যুত্থান ঘটতে থাকবে।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।